Thank you for trying Sticky AMP!!

আলী আজম কি দুর্ধর্ষ অপরাধী নাকি পুলিশের জন্য ‘হুমকি’

হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি নিয়েই মায়ের জানাজার নামাজ পড়াচ্ছেন বিএনপি নেতা আলী আজম। মঙ্গলবার

গাজীপুরে রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার বিএনপির এক নেতার হাতে হাতকড়া ও পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় মায়ের জানাজায় অংশ নেওয়ার ছবি নিয়ে তুমুল আলোচনা–সমালোচনা চলছে। দুর্ধর্ষ অপরাধী, জঙ্গি, সন্ত্রাসী ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ডান্ডাবেড়ি পরানো হয়ে থাকে। সেখানে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আলী আজমের সঙ্গে কেন এই আচরণ করা হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

আলী আজম কি দুর্ধর্ষ অপরাধী, তিনি কি দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি, তিনি কি উগ্র বা ঘৃণ্য অপরাধী– এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন অনেকে। এ বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) আইন উপদেষ্টা ও সাবেক জেলা জজ এস এম রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেছেন, নিরাপত্তার স্বার্থে দণ্ডপ্রাপ্ত কিংবা দুর্ধর্ষ আসামিদের পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালত চত্বরে নিতে পারে কারা কর্তৃপক্ষ। তবে আলী আজমের মতো একজন সাধারণ আসামিকে মায়ের জানাজায় ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে নিয়ে যাওয়া মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থী।

মুক্তি পেয়ে মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে নিজ বাড়ি কালিয়াকৈরের পাবরিয়াচালায় গিয়ে মায়ের জানাজায় অংশ নেন আলী আজম। বেলা ১১টায় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। মায়ের দাফন শেষে আবার কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। পুরোটা সময় আলী আজমের হাতে ছিল হাতকড়া আর পায়ে ছিল ডান্ডাবেড়ি।

আলী আজমের সঙ্গে যা ঘটেছে

আলী আজম বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায় গত ২৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলার অভিযোগে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা মামলায় ২ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে। ওই মামলার বাদী আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের অফিস সহকারী আবদুল মান্নান শেখ। তিনি ওই সময় প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ঘটনা ও মামলার বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। তিনি বলেছিলেন, ‘কসম, আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না। এখানে আলাউদ্দিন এসআই ছিল। ওই স্যার আমারে বারবার ফোন দিয়া অস্থির কইরা ফেলছে। আমি বলছি, স্যার, আমি দাওয়াতে আছি। আমি দাওয়াতে থাইক্যা মামলা করলাম কীভাবে? আমি ছিলামও না, দেখিও নাই। স্যারেগো আমি কইছিলাম, স্যার, আমারে আপনারা ঝামেলায় ফালাইয়েন না।’

এই মামলায় গাজীপুর জেলা কারাগারে বন্দী ছিলেন আলী আজম। বার্ধক্যজনিত কারণে গত রোববার বিকেলে তাঁর মা সাহেরা বেগমের মৃত্যু হয়। শেষবারের মতো মাকে দেখতে ও মায়ের জানাজা নিজে পড়াতে আইনজীবীর মাধ্যমে পরদিন গাজীপুরের জেলা প্রশাসক বরাবর প্যারোলে মুক্তির আবেদন করেন আলী আজম। কিন্তু ওই দিন দাপ্তরিক কাজ শেষ না হওয়ায় মঙ্গলবার তিন ঘণ্টার জন্য প্যারোলে মুক্তি পান তিনি।

মুক্তি পেয়ে মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে নিজ বাড়ি কালিয়াকৈরের পাবরিয়াচালায় গিয়ে মায়ের জানাজায় অংশ নেন আলী আজম। বেলা ১১টায় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। মায়ের দাফন শেষে আবার কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। পুরোটা সময় আলী আজমের হাতে ছিল হাতকড়া আর পায়ে ছিল ডান্ডাবেড়ি।

বাংলাদেশের জেল কোড অনুযায়ী, দুর্ধর্ষ কিংবা ঘৃণ্য অপরাধী কে বা কারা; সেটি চিহ্নিত করা আদালতে কর্মরত পুলিশ পরিদর্শকের দায়িত্ব। আসামির অতীতের অপরাধের ইতিহাস জেনে পুলিশ পরিদর্শক চিহ্নিত করবেন, কোন ব্যক্তি দুর্ধর্ষ। এমন আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আগে তিনি জেলারকে লিখিতভাবে জানাবেন।

ডান্ডাবেড়ি পরানো যাবে কাকে

বাংলাদেশের জেল কোড অনুযায়ী, দুর্ধর্ষ কিংবা ঘৃণ্য অপরাধী কে বা কারা; সেটি চিহ্নিত করা আদালতে কর্মরত পুলিশ পরিদর্শকের দায়িত্ব। আসামির অতীতের অপরাধের ইতিহাস জেনে পুলিশ পরিদর্শক চিহ্নিত করবেন, কোন ব্যক্তি দুর্ধর্ষ। এমন আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আগে তিনি জেলারকে লিখিতভাবে জানাবেন।

এ তথ্য পাওয়ার পর কারা কর্তৃপক্ষ আসামি সম্পর্কে সতর্ক থাকবে। সব ধরনের তথ্য বিশ্লেষণের পর কারা কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে, বন্দী দুর্ধর্ষ, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত এবং উগ্র বা ভয়ংকর প্রকৃতির, পালানোর চেষ্টা করতে পারে, তবেই কারারুদ্ধ অবস্থায়ও তাঁর পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরানো যাবে।

জেল কোডের ৭২১ ধারা অনুযায়ী, কেবলমাত্র দুর্ধর্ষ বন্দীদের নিরাপদ আটক নিশ্চিত করার জন্যে আদালতে পাঠানোর সময়ে পায়ে ডান্ডাবেড়ি লাগাতে হবে।

এখন প্রশ্ন হলো, গাজীপুরের আদালতের পরিদর্শক কি গাজীপুর কারাগারের জেলারকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন, আলী আজম একজন দুর্ধর্ষ কিংবা ঘৃণ্য অপরাধী। কিংবা ২ ডিসেম্বর আলী আজম গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর তিনি কি উগ্র আচরণ করেছেন, পালাতে চেষ্টা করেছেন?

এসব প্রশ্নের উত্তর যদি না হয় তাহলে মায়ের মৃত্যুতে প্যারোলে মুক্তি পাওয়া রাজনৈতিক মামলার বন্দি আলী আজমকে একজন দুর্ধর্ষ অপরাধীর মতো পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে জনসম্মুখে আনার পেছনে কি যুক্তি রয়েছে?

যা বললেন কারা কর্মকর্তারা

মায়ের জানাজার সময় আলী আজমের পায়ে ডান্ডাবেড়ি কেন, সে প্রশ্নের জবাবে গাজীপুর কারাগারের জেলার মাসুদ হাসান জুয়েল মঙ্গলবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তো আসামিদের সঙ্গে সব সময় মানবিক আচরণ করি। উচ্চ আদালতের এক রায়ের পর আসামিদের ডান্ডাবেড়ি পরাতাম না। তবে গত নভেম্বরে দুজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গি ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর আমরা সবাই সতর্ক। পুলিশ, কারাগার কিংবা জেলা প্রশাসন সমন্বিতভাবে আসামি যাতে কোনোভাবে পালাতে না পারে, সে ব্যাপারে আমরা সচেষ্ট রয়েছি।’

গত ২১ নভেম্বর ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের (সিজেএম) প্রধান ফটকের সামনে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেন নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (সাবেক আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) সদস্যরা। এ ঘটনায় জঙ্গি, দুর্ধর্ষ অপরাধীদের আদালতে আনা–নেওয়ার সময়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

ওই ঘটনার পর কারা অধিদপ্তরের এক নির্দেশনায় বিশেষ প্রকৃতির বন্দী যেমন– শীর্ষ সন্ত্রাসী, দুর্ধর্ষ, জঙ্গি (জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ, হিজবুত তাহরীর, আনসারউল্লাহ বাংলা টিম, আনসার আল ইসলাম ইত্যাদি) বন্দীদের আদালতে হাজিরা অথবা অন্যত্র স্থানান্তরের পথে ডান্ডাবেড়ি পরানোসহ প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলা হয়।

আলী আজমের ক্ষেত্রে ডান্ডাবেড়ি পরানো হল কেন, সে প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা করা হয়। গাজীপুরের কারা কর্মকর্তা মাসুদ হাসান জুয়েল প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ যদি কাউকে হুমকি মনে করে আমাদের কাছে জানায় তাহলে আমরা ডান্ডাবেড়ি সরবরাহ করে থাকি। তবে আলী আজমের ক্ষেত্রে কী হয়েছে, সে বিষয়ে জেল সুপার ভালো বলতে পারবেন।’

এ বিষয়ে গাজীপুর জেলা কারাগারের সুপার মোহাম্মদ বজলুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, আলী আজমকে নয়জন পুলিশ সদস্যসহ তাঁর বাড়িতে পাঠানো হয়েছিল। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী এবং জেলকোড অনুযায়ী তাঁকে সেখানে পাঠানো হয়েছিল।

Also Read: হাতকড়া-ডান্ডাবেড়ি নিয়েই মায়ের জানাজা পড়লেন বিএনপি নেতা

সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না। এটা নাগরিকের মৌলিক অধিকার।
এস এম রেজাউল করিম , ব্লাস্টের আইন উপদেষ্টা ও সাবেক জেলা জজ

আলী আজমের কি অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে?

আলী আজমের ভাই আতাউর রহমান জানিয়েছেন, মায়ের জানাজা পড়ানোর সময় তাঁর (আলী আজম) হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি খুলে দিতে অনুরোধ করা হয়েছিল; কিন্তু পুলিশ খুলে দেয়নি।

আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রত্যেক নাগরিকের সুবিচার পাওয়ার আইনি অধিকার রয়েছে। একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায়, একজন নাগরিকের যতটুকু সম্মান পাওয়ার অধিকার রাখেন, তাঁকে তাঁর প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধান প্রত্যেক নাগরিকের সেই অধিকারকে নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।

এ বিষয়ে সাবেক জেলা জজ এস এম রেজাউল করিম বলেছেন, সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না। এটা নাগরিকের মৌলিক অধিকার।

Also Read: ‘নিরাপত্তা ঘাটতি’ দেখিয়ে দিল জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়া