‘নিরাপত্তা ঘাটতি’ দেখিয়ে দিল জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়া

পুরান ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণ থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের সহযোগীরা
ছবি: সংগৃহীত

রোববার দুপুর ১২টা। পুরোদমে চলছে আদালতের কার্যক্রম। আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের পাশাপাশি পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতিতে সরগরম ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) কোর্ট। এর মধ্যে এজলাস থেকে হাজতখানায় নেওয়ার পথে আদালতের প্রধান ফটকের সামনে পুলিশের ওপর হামলা চালায় জঙ্গিরা। পুলিশ সদস্যদের আহত করে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামিকে ছিনিয়ে নেন জঙ্গিরা।

আদালতের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এটা কীভাবে সম্ভব হলো, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সেখানে পুলিশের প্রস্তুতির ঘাটতির চিত্র উঠে এল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা মহানগর ও ঢাকা জেলার আদালতগুলোতে প্রতিদিনই সাড়ে ছয় শ থেকে সাত শ আসামিকে হাজির করা হয়। পৃথক চারটি হাজতখানা থেকে আদালতগুলোতে আসামিদের হাজির করা এবং সেখান থেকে আবার হাজতখানায় আনার জন্য নিয়োজিত রয়েছেন ১৯০ থেকে ২০০ জন পুলিশ সদস্য। প্রয়োজনের তুলনায় এই সংখ্যা কম। এর ফলে আদালতে আসামি আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তায় ঘাটতি থেকে যায়। এ দুর্বলতাকেই কাজে লাগিয়েছেন জঙ্গিরা।

আরও পড়ুন

আজ দুপুরে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির ও মো. আবু ছিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিবকে ছিনিয়ে নেন তাঁদের সহযোগী জঙ্গিরা। এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার আদালত থেকে হারুনুর রশিদ নামের এক ডাকাত পালিয়ে যান।

এ বিষয়ে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) গোলাম ছারোয়ার খান প্রথম আলোকে বলেন, মোহাম্মদপুর থানার সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি মামলার ১২ জন আসামিকে আজ ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে তোলা হয়। এঁরা সবাই দুর্ধর্ষ জঙ্গি। অথচ মাত্র চারজন পুলিশ কনস্টেবল তাঁদের আদালতে তুলেছিলেন। দুর্বল নিরাপত্তাব্যবস্থার কারণে দুই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন সহযোগী জঙ্গিরা।

আরও পড়ুন

আসামি আনা-নেওয়ায় যত সংখ্যক পুলিশ রয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় কম বলেও পুলিশ কর্মকর্তাদের কথায় উঠে আসে। ঢাকা জেলার প্রসিকিউশন বিভাগের পরিদর্শক মতিয়ার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যে পরিমাণ আসামি প্রতিদিন আদালতে আসে, সেই তুলনায় পুলিশ সদস্য কম।

আর ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) ফরিদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, যত সংখ্যক আসামি প্রতিদিন কারাগার থেকে আদালতে আনা হয়, সেই তুলনায় আরও বেশিসংখ্যক পুলিশ সদস্য পাওয়া গেলে আরও ভালো হতো।

আরও পড়ুন

ঢাকার আদালতের হাজতখানার দায়িত্বে থাকা মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা জানান, ঢাকার কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগার ও গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে আসামিদের আদালতে আনা হয় সকাল ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে। পরে তাঁদের রাখা হয় হাজতখানায়। পরে আদালতের শুনানি শুরু হওয়ার আগে হাজতখানার দায়িত্বে থাকা পুলিশ কনস্টেবলসহ অন্যরা আসামিদের আদালতে তোলেন। আদালতের শুনানি শেষ হলে পরে আবার তাঁদের আদালতের এজলাস কক্ষ থেকে হাজতখানায় রাখা হয়। দুপুর থেকে বিকেলের মধ্যে আবার আসামিদের প্রিজন ভ্যানে করে কারাগারে নেওয়া হয়ে থাকে।

আগে দুর্ধর্ষ আসামি আনা-নেওয়ার সময় ডান্ডাবেড়ি পরানো হতো। তবে তিন বছর আগে উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী, কোনো আসামিকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে হাজতখানা থেকে আদালতে তোলা হয় না। শুধু হাতে হাতকড়া পরিয়ে তোলা হয়ে থাকে।

আরও পড়ুন

আদালতে আসামি আনা–নেওয়ায় নিরাপত্তা ঘাটতির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক রাতে টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে যাঁদের গাফিলতির বিষয়টি প্রমাণিত হবে, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর কমিটি পুলিশ সদস্য বাড়ানোর সুপারিশ করলে সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (অপারেশন) নাজমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার আদালত এলাকায় কোতোয়ালি থানা–পুলিশের একটি দল নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকে। আজও একটি টিম ঢাকার সিএমএম আদালতের সামনে ছিল। জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনার পরপরই ওই টিমের সদস্যরা সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুল্লাহ আবু প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী কিংবা জঙ্গি আসামি আনা নেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশকে আরও অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে। সতর্ক না হলে যেকোনো মুহূর্তে বিপদ ঘটার সম্ভাবনা থাকে। দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা সেটি প্রমাণিত হয়েছে।’