Thank you for trying Sticky AMP!!

বিতর্কের বড় পুরস্কার এখন বাংলাদেশের

সৌরদীপ ও সাজিদের ছবিতে অলংকরণ করেছেন আরাফাত করিম

‘বাংলাদেশের একজন ক্রিকেটার যেমন বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন নিয়ে খেলতে নামেন, প্রতিটি টুর্নামেন্টে নিজেকে প্রস্তুত করেন, বিতার্কিক হিসেবে আমাদেরও স্বপ্ন ছিল, একদিন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিজ ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপ জিতব। সেই লক্ষ্য পূরণ হয়েছে।’ বলছিলেন সাজিদ আসবাত খন্দকার। নামটা হয়তো এখন অনেকের কাছেই পরিচিত। কেননা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এরই মধ্যে রীতিমতো শোরগোল পড়ে গেছে—বিতর্কের বিশ্বকাপ জিতেছেন বাংলাদেশের দুই তরুণ।

ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিজ ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপকে (ডব্লিউইউডিসি) বলা হয় বিতর্কের বিশ্বকাপ। করোনার কারণে গত দুই বছর অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয়েছে এ প্রতিযোগিতা। ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং কাউন্সিলের নিয়ম অনুযায়ী, এবারের আসরের আয়োজক ছিল সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডের ইউনিভার্সিটি অব বেলগ্রেড। আর বেলগ্রেড ডব্লিউইউডিসি ২০২২–এরই শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশের তরুণদের দল ‘ব্র্যাক এ’। দলটির প্রতিনিধিত্ব করেছেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির দুই শিক্ষার্থী সৌরদীপ পাল ও সাজিদ আসবাত খন্দকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে স্নাতক করে তাঁরা দুজনই এখন ফলিত অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পড়ছেন।

Also Read: পোল্যান্ড থেকে পুরস্কার আনল ব্র্যাকের শিক্ষার্থীদের তৈরি ড্রোন

Also Read: মহাকাশে যাঁরা পৌঁছে দিয়েছেন ‘আমার সোনার বাংলা’

এই প্রথম ডব্লিউইউডিসির ফাইনালে উঠল বাংলাদেশের কোনো দল। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, শিকাগো স্টেট ইউনিভার্সিটি, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে হারিয়ে মিলেছে ফাইনালের টিকিট। ফাইনালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের মতো দলের সঙ্গে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, এশিয়া মহাদেশের আর কোনো দেশই এর আগে মর্যাদাপূর্ণ এই প্রতিযোগিতার শিরোপা জিততে পারেনি। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পাশাপাশি ইংরেজিকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ব্যবহারকারী বিভাগে সাজিদ আসবাত খন্দকার দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ বক্তা ও সৌরদীপ পাল ষষ্ঠ শ্রেষ্ঠ বক্তার খেতাব পেয়েছেন। ওপেন ক্যাটাগরিতে যৌথভাবে নবম শ্রেষ্ঠ বক্তা নির্বাচিত হয়েছেন সাজিদ আসবাত খন্দকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে একসঙ্গে বিতর্ক করতে শুরু করেছিলেন দুজন

ডব্লিউইউডিসি কেন বিশেষ

ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিজ ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিতর্ক প্রতিযোগিতা। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে প্রতিবছর প্রায় চার শতাধিক দল এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। ১৯৮১ সালে বসেছিল প্রতিযোগিতাটির প্রথম আসর। আয়োজক ছিল স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়। এর পর থেকে প্রতিবছরই বসছে বিতর্কের এই বৈশ্বিক আসর। বাঘা বাঘা বিতার্কিকের চোখ থাকে এ আয়োজনের দিকে। প্রতিযোগিতার শেষ কয়েকটা আসরের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, এখানে বিজয়ী হওয়া সহজ নয়। ২০১৬ থেকে ২০২০, এই পাঁচ বছরে প্রতিযোগিতার বিজয়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম দেখুন—হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সিডনি, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সিডনি এবং অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি। বুঝতেই পারছেন, বেশ সম্মানজনক একটা তালিকায় ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশের নাম।

ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটির সভাপতি শেখ মো. আরমানের কাছে জানতে চাইলাম, বিতর্কের সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্মে এত বড় অর্জনকে তিনি কীভাবে দেখেন? আরমান বলেন, ‘বিতর্কের অনেকগুলো বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা আছে। তবে সেই সব আয়োজনে বিশ্বের সব দেশ অংশগ্রহণ করে না। একমাত্র এই প্রতিযোগিতায় পৃথিবীর সব মহাদেশের প্রায় প্রতিটি দেশ অংশগ্রহণ করে। ফলে এই প্রতিযোগিতার মান ও গ্রহণযোগ্যতা অন্য রকম৷ এ জন্যই একে বিতর্কের বিশ্বকাপ বলা হয়। সৌরদীপ ও সাজিদ যেটা অর্জন করেছেন, সেটা আমাদের পুরো দেশের জন্য গর্বের। বাংলা বিতর্ক তো স্বাধীনতার পর থেকেই হয়ে আসছে। তবে, ইংরেজি বিতর্ক আমরা মাত্র ১৫ বছর ধরে করছি। এই জয় আমাদের অত্যন্ত আকাঙ্ক্ষিত ছিল। বিশেষ করে ইংরেজি বিতর্কের জন্য এটা একটা মাইলফলক হয়ে থাকল।’ আরমান মনে করেন, আগামী দিনগুলোয়ও বিশ্বকাপের এই আসরে বাংলাদেশের ভালো করার সুযোগ আছে।

প্রতিযোগিতার এবারের আসরে মোট ৩৭২টি দল অংশগ্রহণ করে। অংশগ্রহণকারীর তালিকায় ছিল বিশ্বের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের নাম। ব্রিটিশ সংসদীয় ব্যবস্থার বিতর্কের আদলে অনুষ্ঠিত হয় এই প্রতিযোগিতা, যেখানে ফাইনালে চারটি দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ‘ব্র্যাক এ’ ছাড়া বাকি দলগুলো হলো অ্যাটিনিও ম্যানিলা এ, প্রিন্সটন বি ও এনইউএস এ। ফাইনালে বক্তারা প্রায় সাত মিনিট করে সময় পান।

বিজয়ীরা কী বলছেন

স্কুলজীবনেই বিতর্কের হাতেখড়ি হয়েছিল সৌরদীপ পালের। বহু প্রতিযোগিতামূলক বিতর্কে অংশ নিয়ে নিজেকে পরিণত করেছেন। নটর ডেম কলেজে পড়ার সময় মেধাবী বিতার্কিকদের সঙ্গে বিতর্কচর্চার সুযোগ পেয়েছেন। সাফল্যও এসেছে অনেক। সৌরদীপ বলেন, ‘নটর ডেম কলেজে এসেই মূলত বিতর্কের নেশা বেড়ে যায়। একের পর এক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে থাকি। জাতীয় স্তরের প্রায় সব শাখাতেই আমি অংশগ্রহণ করেছি৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে পড়ার সময় সাজিদের সঙ্গে দল গঠন করি। এরপর দেশে–বিদেশে অনেক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছি। কখনো সাফল্য এসেছে, কখনো খালি হাতে ফিরতে হয়েছে৷ তবে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, সেটা সব সময় এ জয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।’ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্ক ক্লাব এবং ঢাবি আইবিএর অগ্রজদের ধন্যবাদ জানাতে চান সৌরদীপ। বিভিন্ন বিতর্ক সংগঠন ও অগ্রজ বিতার্কিকদের সমর্থন ও পরামর্শ এত দূর এগোতে সাহায্য করেছে বলে মনে করেন তিনি৷

‘কেমব্রিজ ইন্টারভার্সিটি ২০২১’–এও চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল সাজিদ-সৌরদীপের দল। সেবার ইংরেজিকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ব্যবহারকারী বিভাগে শ্রেষ্ঠ বক্তা হয়েছিলেন সাজিদ। দুজনের ঝুলিতেই আছে এ রকম বহু প্রতিযোগিতার সুখস্মৃতি ও অভিজ্ঞতা। সাজিদ বলেন, ‘সাফল্য যেমন এসেছে, হেরে যাওয়ার অভিজ্ঞতাও কম হয়নি। তবে আমরা কখনো হাল ছাড়িনি।’

মন্ত্রী, ক্রিকেটার, অভিনয়শিল্পী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবার প্রশংসায় ভাসছেন সদ্য বিজয়ী এসব তরুণ। কেমন উপভোগ করছেন? দুজনই জানান, বেশ ভালো লাগছে। বিতর্ক নিয়ে এই উন্মাদনা উপভোগ করছেন তাঁরা।

সৌরদীপ পাল বর্তমানে বিশ্বব্যাংকে পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। আর ইউনিলিভার বাংলাদেশের কর্মী সাজিদ আসবাত খন্দকার ভবিষ্যতে এই বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানেই ক্যারিয়ার গড়তে চান।

গুরুত্বপূর্ণ হলো অংশগ্রহণ করে যাওয়া

ভিনসেন্ট চ্যাং

ভিনসেন্ট চ্যাং, উপাচার্য, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি

গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় আমাদের ছাত্রদের বিজয়ী হতে দেখে ভালো লাগছে। এই বিতার্কিক দল সারা বিশ্বের সামনে নিজেদের প্রতিভার প্রমাণ দিয়েছে। গত অক্টোবরে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির একটি রোবোটিকস দল ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন আয়োজিত একটি প্রতিযোগিতায় জয় লাভ করেছিল। বিশ্বের বুকে উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে এবং পৃথিবীর মানচিত্রে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শক্ত অবস্থান করে নেওয়ার চেষ্টাকে মাথায় রেখে আমি তাঁদের এই অর্জনকে ‘এ প্লাস’ দিতে চাই। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় আপনি কখনো জিতবেন, কখনো হারবেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ হলো অংশগ্রহণ করে যাওয়া। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ, বৈশ্বিক মান অর্জন, অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করার মাধ্যমে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি মূর্ত হয়। আমি এই প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানাই, উৎসাহিত করি এবং আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করি। বিশ্বাস করি, আমার যেকোনো শিক্ষার্থীরই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সক্ষমতা আছে। শ্রেষ্ঠত্ব দেখানোর প্রশ্নে পৃথিবীতে কোনো সীমানা নেই।