মহাকাশে যাঁরা পৌঁছে দিয়েছেন ‘আমার সোনার বাংলা’

বাঁ থেকে সুহাইল হক, মো. হাসিবুল ইসলাম, তাহসিনুল হক, রাজীন বিন ঈসা, আবরার মুসতাকীম ও মুরছালিন আহমেদের ছবিতে অলংকরণ করেছেন এস এম রাকিবুর রহমান

ধরা যাক, পৃথিবী থেকে প্রায় ৪০৮ কিলোমিটার দূরে একটি পাঁচ বেডরুমের বাসা। ঘণ্টায় ১৭ হাজার ৫০০ মাইল বেগে বাসাটি পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে। জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়াসহ নানা দেশের মানুষ সেখানে থাকে। তবে নেই কোনো বাংলাদেশি, বাংলাভাষী। অথচ এই বাসাতেই একদিন শোনা গেল, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি!’

খোলাসা করেই বলি। ‘পাঁচ বেডরুমের বাসা’ যাকে বলছি, আদতে তার নাম ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন (আইএসএস)। নাসার এই স্পেস স্টেশনে নানা দেশের বিজ্ঞানীরা থাকেন। মহাকাশে থেকে মহাকাশ নিয়ে গবেষণা করেন তাঁরা। সম্প্রতি কিবো রোবট প্রোগ্রামিং চ্যালেঞ্জ (আরপিসি) নামে একটি প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়ে আইএসএসে বাংলা ভাষা পৌঁছে দিয়েছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের একটি দল।এনিগমা সিস্টেমস নামের এই দলের সবাই ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের ছাত্র। দলের সদস্যরা হলেন—মো. হাসিবুল ইসলাম, রাজীন বিন ঈসা, তাহসিনুল হক, মুরছালিন আহমেদ, সুহাইল হক ও এস এম আবরার মুস্তাকীম। জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি (জাক্সা) দুই বছর ধরে এই প্রতিযোগিতা আয়োজন করছে।

প্রথমবারেই দ্বিতীয় অবস্থান

আরপিসি হলো একটি শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম, যেখানে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে ফ্রি-ফ্লাইং রোবট (অ্যাস্ট্রোবি এবং ইনট-বল) প্রোগ্রামিং করে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করেন। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের দল এনিগমা সিস্টেমস প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল; হয়েছে রানার্সআপ।

এনিগমা সিস্টেমসের দলনেতা মো. হাসিবুল ইসলাম বলছিলেন, ‘প্রোগ্রামিং নিয়ে অনেক কাজ করেছি। তবে এ ধরনের প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া এবারই প্রথম। যেহেতু মহাকাশ স্টেশনের একটি রোবটকে প্রোগ্রামিং করতে হয়েছে, তাই পুরো বিষয়টি অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল। কঠিন বিষয়টা সহজ করে দিয়েছেন এমআইটিতে কর্মরত বাংলাদেশি মহাকাশবিজ্ঞানী মিজানুল চৌধুরী। তাঁর সরাসরি তত্ত্বাবধানে এবং তাঁর নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম স্টেমএক্স ৩৬০–এর মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা অনেক কিছু শিখতে পেরেছি, যা আমাদের এ জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে।’

এই পর্যায়ে যেতে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করেছে বাংলাদেশি মহাকাশবিজ্ঞানী মিজানুল চৌধুরীর প্ল্যাটফর্ম—স্টেমএক্স ৩৬০

শিক্ষার্থীরা জানালেন, বাংলাদেশি মহাকাশবিজ্ঞানী মিজানুল চৌধুরীর আন্তরিক প্রচেষ্টাতেই আরপিসির প্রথম আসরে বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতার পর্যবেক্ষক হিসেবে যুক্ত করা হয়। দ্বিতীয় আসরে বাংলাদেশ সরাসরি অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়।

বাংলাদেশ থেকে মোট ২২টি দল নিয়েছিল। প্রথম পর্ব শেষে এনিগমা সিস্টেমস বাংলাদেশের দলগুলোর মধ্যে প্রথম হয়। এরপর দ্বিতীয় পর্বে বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, মালয়েশিয়া, জাপান, ইন্দোনেশিয়াসহ নয়টি প্রতিযোগী দেশের মধ্যে প্রোগ্রামিং স্কিলস রাউন্ড শেষে তৃতীয় স্থান অর্জন করে এনিগমা সিস্টেমস। গত ২৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত চূড়ান্ত পর্বে তারা হয় দ্বিতীয়।

আমার সোনার বাংলা

আইএসএসে জাপানের একটি গবেষণা মডিউল রয়েছে, যার নাম কিবো। কিবোতে কাজ করে অ্যাস্ট্রোবি নামের একটি রোবট। সহজ করে বললে, এই অ্যাস্ট্রোবির জন্য প্রোগ্রাম তৈরি করাই আরপিসির প্রতিযোগীদের কাজ।

এনিগমা সিস্টেমসের অন্যতম সদস্য রাজীন বিন ঈসা বলছিলেন, ‘ফাইনাল রাউন্ডে আমাদের প্রোগ্রামটি অ্যাস্ট্রোবিতে ইনস্টল করা হয়। নয়টি দলের প্রোগ্রামের মধ্যে মাত্র দুটি দল পুরো মিশনটি সম্পন্ন করতে পেরেছিল। তাদের মধ্যে আমরা অন্যতম।’

এই প্রথমবারের মতো আরপিসিতে দেওয়া হলো ‘ক্রু অ্যাওয়ার্ড’, যা জিতে নিয়েছে বাংলাদেশের দল। নিয়ম হলো মিশন শেষে অ্যাস্ট্রোবি রোবটটি প্রতিযোগী দলের পাঠানো একটি বার্তা শোনায়, যা আগে থেকেই রেকর্ড করা থাকে। এনিগমা সিস্টেমসের বার্তা ছিল:

It is an honor to be to operate Astrobee inside the International Space Station. A big milestone for Bangladesh in space research area. This message is for Bangladesh.

আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।

Mission complete, take care.

Over.

শেষ বার্তায় মাতৃভাষা ব্যবহারের বিষয়টি বেশ ভালো লেগেছে আইএসএসে থাকা মহাকাশচারীদের। আইএসএসের জাপানি মহাকাশচারী আকিহিকো হোশিদে তাই সেরা ক্রু হিসেবে বাংলাদেশের এনিগমা সিস্টেমসের নাম ঘোষণা করেন।

দলনেতা মো. হাসিবুল ইসলাম বলেন, ‘প্রোগ্রামটি মহাকাশ স্টেশন থেকে ইউটিউবে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিল। তাই সেখানে যখন আমার মাতৃভাষা বেজে ওঠে, সেটা শুধু আমার নয়, বাংলাদেশের জন্যও গর্বের। বাংলা ভাষাকে মহাকাশে নিতে পেরে আমরা এনিগমা সিস্টেমস সত্যিই আনন্দিত।’

যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) মহাকাশবিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত মিজানুল চৌধুরী। এমআইটিতে শিক্ষকতার পাশাপাশি এমআইটি লিঙ্কন ল্যাবে কাজ করেন স্যাটেলাইট নিয়ে। কিবো রোবট প্রোগ্রামিং চ্যালেঞ্জের মতো প্রোগ্রামে বাংলাদেশের সরাসরি অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করছেন তিনি। মুঠোফোনে কথা বললেন স্বপ্ন নিয়ের সঙ্গে।

যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) মহাকাশবিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত মিজানুল চৌধুরী
ছবি: সংগৃহীত

‘প্রোগ্রামিংয়ে আমরা কারও চেয়ে পিছিয়ে নেই’

স্বপ্ন নিয়ে: শিক্ষার্থীরাই বললেন, বাংলাদেশকে আরপিসিতে যুক্ত করার পেছনে আপনার বড় অবদান আছে। কীভাবে সম্ভব হলো, একটু বিস্তারিত বলবেন?

মিজানুল চৌধুরী: ২০১৩ সালে আমি এমআইটিতে যোগ দিই। সব সময় দেখতাম, ন্যাশনাল অ্যারোনটিকস অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা) আয়োজিত মহাকাশবিজ্ঞানের বড় প্রতিযোগিতাগুলোতে উত্তর আমেরিকার শিক্ষার্থীরাই বেশি অংশ নেন। আন্তর্জাতিক মহাকাশের সদস্যদেশগুলোই এ ধরনের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। তখন থেকেই ভাবছিলাম, বাংলাদেশসহ এশিয়া অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা এসব প্রোগ্রামে অংশ নিতে পারলে ভালো হতো। সুযোগ পেলে আমাদের দেশের ছেলেরাও বড় জায়গায় কাজ করার ক্ষমতা রাখে। ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে অনেক গবেষণা হয়, যা পৃথিবী ও মহাকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ এসব গবেষণায় অবদান রাখলে তা দেশের জন্য বড় একটি মাইলফলক হবে। এ চিন্তা থেকেই আমি এমআইটিকে প্রস্তাব দিই বাংলাদেশকে সুযোগ দেওয়ার জন্য। তারা সরাসরি না বলে দেয়। কারণ, বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের সদস্যদেশ নয়। তখন আমি একটা প্ল্যাটফর্ম প্রস্তুত করি। নাম দিই স্টেমএক্স ৩৬০। এটা এমআইটি–সংযুক্ত একটি প্ল্যাটফর্ম, যার মাধ্যমে আমি এ ধরনের প্রোগ্রাম শুরু করার চেষ্টা করতে থাকি। সৌভাগ্যক্রমে জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি (জাক্সা) এসেছিল আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তারাও এশীয় অঞ্চলে এ ধরনের প্রোগ্রাম করার চিন্তা করছিল। পরে নাসা ও অন্যান্য স্পেস এজেন্সি মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, একেকটা এজেন্সি একেক অঞ্চলের দায়িত্ব নেবে। জাক্সা নেয় এশিয়ার দায়িত্ব। প্রাথমিক তালিকায় জাক্সা বাংলাদেশকে রাখেনি। আমি তাদের সঙ্গে কথা বললাম। ওরা জানাল, জাক্সা যেহেতু সরকারি প্রতিষ্ঠান, জাপান সরকারের সঙ্গে কথা না বলে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। পরে ২০২০ সালে আমি বাংলাদেশ সরকার ও জাপান সরকারের মধ্যে চুক্তি করাতে সক্ষম হই। ফলে ভবিষ্যতে মহাকাশ, মঙ্গল গ্রহসহ এ ধরনের প্রোগ্রামে বাংলাদেশের অংশগ্রহণে আর বাধা নেই।

স্বপ্ন নিয়ে: বাংলাদেশ থেকে মোট ২২টি দল অংশ নিয়েছিল। আপনি কীভাবে তাদের সহায়তা করেছেন?

মিজানুল চৌধুরী: প্রতি সপ্তাহে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছি, দিকনির্দেশনা দিয়েছি, মনোবল বাড়ানোর চেষ্টা করেছি। নেতৃত্ব দেওয়ার গুণ ও তথ্য শেয়ার করার দিকে আমি বেশি নজর দিয়েছি। সব কটি দলকে আমি হাতে–কলমে শেখানোর চেষ্টা করেছি।

স্বপ্ন নিয়ে: ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হলো। বাংলাদেশের জন্য এ অর্জন কেন গুরুত্বপূর্ণ?

মিজানুল চৌধুরী: চূড়ান্ত পর্বটি সরাসরি ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে (আইএসএস) থাকা মহাকাশচারীরা পরিচালনা করেছেন। আমাদের ছাত্ররা প্রোগ্রামিং করেছে। সব কটি পর্যায়ে সফলতার স্বাক্ষর রেখে রানার্সআপ হয়েছে। জিতেছে ক্রু অ্যাওয়ার্ড, যা আগে কাউকে দেওয়া হয়নি। আমি মনে করি, এর মাধ্যমে বাংলাদেশ নাসাসহ অন্যান্য স্পেস এজেন্সির কাছে পরিচিতি পাবে। আমাদের ছেলেরা তাদের মেধার প্রমাণ দিয়েছে। তারা বুঝিয়ে দিয়েছে, প্রোগ্রামিংয়ে বিশ্বের কারও থেকে আমরা পিছিয়ে নেই। আমি চাই, ভবিষ্যতে নাসা কিংবা এমআইটি যেন মহাকাশবিজ্ঞান–সংক্রান্ত কাজে নিজে থেকে আমাদের শিক্ষার্থীদের ডেকে নেয়।

স্বপ্ন নিয়ে: মহাকাশ নিয়ে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কেমন দেখলেন?

মিজানুল চৌধুরী: সন্তোষজনক। অংশ নেওয়া ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যে আমি প্রচণ্ড আগ্রহ দেখতে পেয়েছি। প্রোগ্রামিং না জানা অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীরাও আগ্রহ দেখিয়েছে। সঠিক সুযোগ আর প্রশিক্ষণ পেলে এরা প্রত্যেকেই ভালো জায়গায় যাবে। জাক্সার প্ল্যাটফর্মটা আরেকটু সহজ হলে সবার জন্য ভালো হতো। আমি এ ব্যাপারে তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করব।

স্বপ্ন নিয়ে: বৈশ্বিক অনেক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা ভালো করছে। তবে দেশের কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভাবনী চিন্তা বিকাশের সুযোগ কতটা আছে বলে আপনার মনে হয়?

মিজানুল চৌধুরী: সুযোগ অবশ্যই আছে। অনেক প্রতিষ্ঠানই সাধ্যমতো চেষ্টা করছে। তবে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একটা বড় সমস্যা থেকে গেছে। তা হলো শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যকার দূরত্ব। আমি বুয়েটে পড়াশোনার সময় থেকেই বিষয়গুলো দেখেছি। শিক্ষার্থী শিক্ষককে ভয় পায়। অন্যদিকে শিক্ষকদের মধ্যেও একটা ধারণা থাকে, তিনিই সব জানেন। ছাত্ররা কিছুই জানে না, যা আসলে ঠিক নয়। তাই আমি আমার প্রোগ্রামগুলো এমনভাবে প্রণয়ন করেছি, যেন শিক্ষার্থীরা সহজেই আমার সঙ্গে মিশতে পারে, প্রশ্ন করতে পারে এবং তাদের চিন্তাভাবনাগুলো একজন আরেকজনের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে পারে।