Thank you for trying Sticky AMP!!

নাক ভেঙে কি বাঁধ ভাঙার প্রতিশোধ নেওয়া যায়

সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার গুরমার বর্ধিতাংশ হাওরের শালদিঘা ফসলরক্ষা বাঁধের ফাটল অংশ মেরামত করেন আটটি গ্রামের তিন শতাধিক মানুষ

একাত্তরে রথীন্দ্রনাথের গলায়, ‘পরানের বন্ধুরে... আমার খেতের সোনার ধান খাইলো ইন্দুরে’ শুনলে মনে হতো দেশ স্বাধীন হলে মেহনতের ধান চাষির গোলায় উঠবে। আজও মেহনতের ধান নিয়ে সংশয় কাটে না। গত তিন মাসে প্রায় ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭০০রও বেশি বাঁধের কাজ শেষ করার কথা ছিল। উঠেছে নানা অনিয়ম–দুর্নীতির অভিযোগ।

আগাগোড়ায় আশঙ্কা ছিল। ৩ এপ্রিল রাতে তাহিরপুরের সংবাদকর্মী উপজেলা চেয়ারম্যানের বরাত দিয়ে জানিয়েছিলেন ‘বুক কাঁপছে। যদি পানি আরও বাড়ে, তাহলে সর্বনাশ হবে।’ দুই দিন পর থেকেই একের পর এক বাঁধ দিয়ে পানি ঢুকতে থাকে, আর ছটফট করতে থাকে অভাবে ধুঁকতে থাকা কৃষককুল। দুই দিন পর শাল্লা হুরামন্দির হাওরের ৫৫ নম্বর পিআইসির বাঁধে ফাটল দেখা দিলে আশপাশের চার গ্রামের মানুষ মেরামতের কাজে লেগে যান। ধান বাঁচাতে ব্যাকুল বিক্ষুব্ধ মানুষ কথিত প্রকল্পের সদস্যসচিবকে এ সময় নাগালের মধ্যে পেয়ে যান। মেরে তাঁর নাক ফাটিয়ে দেন। মানুষ জানে, পেয়াদা ঠেঙিয়ে কোনো লাভ নেই। কিন্তু সব হারানোর আশঙ্কায় থাকা মানুষের মাথা ঠিক রাখা কঠিন।

হাওরের শান্ত, গানপ্রিয় মানুষ এখন জ্বলছে। এই ধান রক্ষা করতে না পারলে তাদের মান থাকবে না। ঋণ করে সর্বস্ব দিয়ে যে ধানের স্বপ্ন কৃষক দেখেছিলেন, তা পূরণ না হলে তাকে দেশান্তরি হতে হবে। ২০১৭ সালের ঘা এখনো শোকায়নি, তারপর শুরু হয়েছে বাইশের বাঁধ ভাঙার পালা। দেশে সাতটি হাওর জেলার ৩৭৩টি হাওরের বাঁধের অবস্থা কমবেশি একই রকম। ঢল নামলে রক্ষা থাকবে না।

পানিসম্পদমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, সুনামগঞ্জ জেলায় মোট ২ লাখ ২৩ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে মাত্র ৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। মোট আর গড়ের পরিসংখ্যানের এটাকে ‘সামান্য ক্ষতি’ বলে মনে হবে। কোথাও কোথাও চরম সর্বনাশ হয়ে গেছে। দিরাই উপজেলার ৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে। বাঁধ যে আরও ভাঙতে পারে, সে ইঙ্গিত মন্ত্রির বক্তব্যে আছে। পানি চুয়াচ্ছে (‘সিপেজ’) ১৩৬টি স্থানে।

Also Read: হাওরের বাঁধ, কৃষকের খেদ ও হিরালির গল্প

মানুষ বিপদ মাথায় নিয়ে লড়ছে

মোহনগঞ্জে ফসলরক্ষা বাঁধ মেরামতে মাটিভর্তি বস্তা ফেলার সময় হঠাৎ ১৪ কৃষক জ্ঞান হারান। অনেকে বমি করতে থাকেন। দুজনকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠাতে হয়। ইউএনও জানিয়েছেন, ‘প্লাস্টিকের ওই বস্তাগুলোতে হয়তো কোনো ধরনের কেমিক্যাল ছিল। কেমিক্যালের প্রভাবে অজ্ঞান হয়ে থাকতে পারেন।’এ রকম ঘটনা যেন আর না ঘটে, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

জগন্নাথপুরের নলুয়া হাওরের হামহামির বেড়িবাঁধ রক্ষায় চার দিন ধরে লড়ছেন স্থানীয় কৃষকেরা। পরিকল্পনামন্ত্রীর নির্দেশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নলুয়া হাওরের পোল্ডার-১–এর আওতাধীন ৪ নম্বর প্রকল্পের হামহামি বাঁধ প্রকল্পটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠায় সোমবার স্লুইসগেটে বিকল্প আরেকটি বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।

৫ এপ্রিল খালিয়াজুরী সদর ইউনিয়নের কীর্তনখোলা হাওরের বাঁধে ৭ কিলোমিটারে ফাটল দেখা দেয়। স্থানীয় লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বাঁশের খুঁটি পুঁতে বালিভর্তি বস্তা ফেলে বাঁধরক্ষার চেষ্টা চালান। এখন পানি বাড়ার প্রবণতা কমে আসায় মানুষের মনে ফসল হারানোর শঙ্কা একটু কম, তবে একেবারে দূর হয়নি।

হাওরের শান্ত, গানপ্রিয় মানুষ এখন জ্বলছে। এই ধান রক্ষা করতে না পারলে তাদের মান থাকবে না। ঋণ করে সর্বস্ব দিয়ে যে ধানের স্বপ্ন কৃষক দেখেছিলেন, তা পূরণ না হলে তাকে দেশান্তরি হতে হবে। ২০১৭ সালের ঘা এখনো শোকায়নি, তারপর শুরু হয়েছে বাইশের বাঁধ ভাঙার পালা। দেশে সাতটি হাওর জেলার ৩৭৩টি হাওরের বাঁধের অবস্থা কমবেশি একই রকম। ঢল নামলে রক্ষা থাকবে না।

ক্ষতিপূরণের বাঁশি শোনা যাচ্ছে

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পরিবারের জন্য চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ মোট সাড়ে ১৪ কেজি পরিমাণের নিত্যপণ্যের এক হাজার প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে। আরও এক হাজার প্যাকেট বিতরণের জন্য পাঠানো হয়েছে। বলাবাহুল্য, কৃষকের বছরের ফসল তলিয়ে গেছে, তার কাছে সাড়ে ১৪ কেজির প্যাকেট চৌদ্দশিকে তাকে ঝুলিয়ে দেওয়ার মতোই মশকরা।

এখন বেশির ভাগ খেতে জমির মালিক নিজে খরচ করে জমি চাষ করেন না, তিনি আগাম টাকা নিয়ে জমি দিয়ে দেন কৃষকের হাওলায়। এসব কৃষকের নাম কি সরকারের খতিয়ানে আছে? নাই, তাই প্রণোদনা রিলিফ সবই পৌঁছায় বসে বসে মজা খাওয়া মালিকের কাছে।

হাওরের ফসলের ক্ষতির আগুন পৌঁছে যায় দূরদূরান্তের জেলাগুলোতে। ধান কাটতে আসা ‘ভাগালু’দের কথা পরম যত্নে লিপিবদ্ধ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু; আন্দোলন করেছিলেন তাঁদের জন্য। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র পাতায় তাঁদের কথা আছে।

করোনাকালে যখন শ্রমিক-সংকট ছিল, যাতায়াতে বিধিনিষেধ ছিল; তখন দিরাইয়ের ইউএনও ভোলার জামালুদ্দিনকে ফোন করে নিয়ে এসেছিলেন। প্রশাসন তাঁর দলের আসার খরচ দিয়েছিল। ইউএনও ঠিকানা পেয়েছিলেন স্থানীয় কৃষকদের কাছে। জামালুদ্দিনরা বোরো মৌসুমে দলবল নিয়ে ধান কাটতে আসেন সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায়। চাপতির হাওরে তিনি কুড়ি বছর ধরে ধান কাটছেন। এবার ধান তলিয়ে যাওয়ায় ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন তিনি। ক্ষতিপূরণের তালিকায় তাঁদের নাম ওঠাবে কে? সেই মাপের রাজনীতিবিদ কই? ধান কাটতে আসে ‘ভাগালু’দের অনেকে দুর্ঘটনা মারা যান, মারা যান বজ্রপাতে। গত তিন বছরে প্রায় ১১ জন ভাগালুর প্রাণ গেছে বজ্রপাতে।

Also Read: আবার বিপর্যয় ঘটার আগেই দ্রুত ব্যবস্থা নিন

কেন এবার বান ডেকেছে আগেভাগে

স্থানীয় অভিজ্ঞতা বলে প্রতি চার বছর পর আগাম বান আসে। ২০১৭ প্রবল বানের পর এবার যে কোনো ছাড় পাওয়া যাবে না, তা প্রায় নিশ্চিত ছিল। তারপরও মন্ত্রী বলেছেন, অগ্রিম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে ২০১৭ সাল থেকে এ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। এসব আত্মতুষ্টিমূলক কথার লাগাম টানা দরকার। চেরাপুঞ্জির বৃষ্টির অজুহাত দিয়ে গাফিলতি ঢাকা যাবে না। গত পাঁচ বছর যে বাঁধের জোরে হাওরের ফসল ঘরে উঠেছে, সেটা নয়। অনেক জায়গায় ঠিকমতো কাজ হয়নি। বাঁধ বাধা নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে, দেরি হয়েছে, ধরপাকড়, মামলা ইত্যাদি সবই চলেছে ধারাবাহিকভাবে। স্রেফ কপালের জোরে পাহাড়ে আগাম বাদল না হওয়ায় আরও বড় ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে।

অমাবস্যা পূর্ণিমায় মেঘবৃষ্টির আশঙ্কা বেশি থাকে। এপ্রিলের ১ তারিখ অমাবস্যার ঠেলা আমরা সামলাতে পারেনি। সামনের পূর্ণিমায় ঝড়বৃষ্টির আরেকটা চোট আসবে, সেটা মাথায় রেখে আমাদের কাজ করতে হবে। পূর্ণিমার প্রভাবে আগামী ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং ভারতের আসাম (বরাক অববাহিকা) এবং মেঘালয়ে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা। বৃষ্টি হলে আগামী ১৭ এপ্রিল নাগাদ উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা, কুশিয়ারা, যাদুকাটা, লুভাছড়া, সারিগোয়াইন, ধলাগাং, পিয়াইন, ঝালুখালী, সোমেশ্বরী, ভুঘাই-কংস, ধনু-বাউলাই নদনদীর পানি আবার বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। ফলে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলায় বন্যার আশঙ্কা আছে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন হাওর জেলার জেলা প্রশাসকরা দ্রুত ধান কেটে নেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। নেত্রকোনায় মানুষ কোমর পানিতে নেমে আধা পাকা ধান কাটা শুরু করেছেন। মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী তিন উপজেলায় বিভিন্ন হাওরে দুই দিনে ৫ হাজার ৩২০ হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে বলে জানায় কৃষি বিভাগ। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং কৃষি বিভাগের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ২৭৫টি আধুনিক কৃষিযন্ত্র (কম্বাইন হারভেস্টার) প্রস্তুত আছে।

Also Read: খারাপ নয়, ভালো খবরের নাম হোক হাওর

বাঁধ কেন বাঁধা যায় না

‘হাওর বাঁচাও আন্দোলনের’নেতারা বলছেন, শুধু উজানের দোহাই দিলে চলবে না, ফসল ঝুঁকিতে পড়ার মূল কারণ হচ্ছে বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও গাফিলতি। নির্ধারিত সময়ের এক মাস পরও বাঁধের কাজ শেষ হয়নি। মূল কাজ রেখে প্রশাসন, পাউবোর কর্মকর্তারা কীভাবে একের পর একে প্রকল্প আর প্রাক্কলন বাড়ানো যায়, সেটিতেই গুরুত্ব দিয়েছেন।

মন্ত্রী বলেছেন অন্য কথা, তার মতে হাওরের পানি জমে থাকার কারণে ডিসেম্বরে সব জায়গায় কাজ শুরু করা যায়নি। হাওর থেকে কেন পানি সরতে দেরি হলো? কেউ সেটা জানতে চাননি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাওরের বুক চিরে বানানো কথিত ‘আবুরা’ সড়কের (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রামের মধ্যে প্রায় ২৯ দশমিক ১৫ কিলোমিটার) কারণে হাওরে পানি আগের মতো গতিতে আর সাগরে যাচ্ছে না। জমে থাকছে। ৩০ কিলোমিটারের বদলে ৮০০ মিটার রাস্তা দেওয়া হয়েছে পানিকে। পানির কী দোষ? কে জানে সামনে আরও কত খারাপ দিন অপেক্ষা করছে।

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক। ই–মেইল: nayeem5508@gmail.com