আবার বিপর্যয় ঘটার আগেই দ্রুত ব্যবস্থা নিন

সম্পাদকীয়

করোনাকালে খাদ্যসংকটের মুখে পড়তে হয়নি আমাদের। কৃষি উৎপাদনের ওপর ভরসা করেই মূলত বড় একটি অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে আমরা রক্ষা পেয়েছিলাম। কিন্তু সেই কৃষি ও কৃষকদের প্রতি আমরা কতটা সুবিচার করতে পারছি? সরকারের বিপুল পরিমাণ বরাদ্দ ও ভর্তুকির সুবিধা পেয়েও কৃষকদের দুর্দশা ঘুচছে কই। যেমন হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ নিয়ে কোনো আয়োজনের কমতি ছিল না। কিন্তু সেই বাঁধটাই ঠিকঠাক সময়ে পাননি কৃষকেরা। ফলে ধান পাকার আগেই হুমকির মুখে এখন সুনামগঞ্জের হাওরের ফসল। ইতিমধ্যে ভারতের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জিতে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলে হাওরের কিছু জমি পানির নিচে চলে গেছে।

বাঁধ নির্মাণে ধীরগতি ও অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে প্রথম আলো কয়েকটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। আমরা শঙ্কা প্রকাশ করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাঁধের কাজ শেষ করার আহ্বানও করেছিলাম। স্থানীয় প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) আমাদের কোনো কথাই কানে তোলেনি। এবার সুনামগঞ্জের হাওরে ৭২৭টি প্রকল্পে ১২১ কোটি টাকার ফসল রক্ষা হওয়ার কথা। বাঁধ নির্মাণকাজ ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা শেষ হয়নি। সময় নির্ধারিত ছিল ৭৫ দিন এবং ৬৪ দিন চলে যাওয়ার পরও অর্ধেকের বেশি কাজ রয়ে যায়। শেষ মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে যেসব বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলোও টেকসই হয়নি। হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, ‘বাঁধের কাজে নানাভাবে অনিয়ম ও গাফিলতি ছিল। আমরা হাওরে হাওরে ঘুরে এসব তুলে ধরেছি। কিন্তু কোনো ফল হয়নি।’

এমন পরিস্থিতিতে হাওরে ২০১৭ সালের বিপর্যয়ের উদাহরণই বারবার সামনে আসছিল। সে বছর হাওরের ফসলের বড় ক্ষতিতে গোটা দেশে চালের দাম বেড়ে গিয়েছিল ব্যাপকভাবে। তখন বাঁধ নির্মাণে পাউবোর ঠিকাদারদের অনিয়মের বিষয়টি আলোচনায় আসে। এরপর ঠিকাদারদের বাদ দিয়ে বাঁধ নির্মাণে ইউপি সদস্য, কৃষকসহ সুফলভোগীদের নিয়ে গঠন করা হয় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি)। পিআইসি গঠন ও প্রকল্প নির্ধারণ নিয়ে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কমিটি শীর্ষে আছেন যথাক্রমে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সেখানে যুক্ত আছেন পাউবোর কর্মকর্তারাও। কয়েক বছর ধরে পিআইসি নিয়েও নানা অভিযোগ আমরা দেখতে পাই। কাজ শেষ করার পরও পিআইসির সদস্যরা টাকার জন্য দিনের পর দিন ঘুরতে থাকেন। তা ছাড়া স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবে পিআইসি গঠন এবং এ নিয়ে বাণিজ্য নিয়েও অভিযোগ কম নয়।

এ বছর জেলাটিতে দুই লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে ধান উৎপাদন হয়েছে। চাল উৎপাদনের লক্ষ্য প্রায় ৯ লাখ টন। এখন ছোট-বড় ১৫৪টি হাওরে ধান পাকতে আরও ১০ থেকে ১২ দিন সময় লাগবে। কিন্তু সেই ধান কি ঘরে তুলবে পারবেন কৃষক? আমরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম, পিআইসিকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন কিছু অসাধু কর্মকর্তা। এর ফলে বাঁধ নির্মাণের কোটি কোটি টাকার কাজে আবারও ঠিকাদারদের নিয়ন্ত্রণ ফেরত আসবে। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বারবার জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের প্রতি আহ্বান করেছিলাম আমরা। কিন্তু তাদের কোনো পদক্ষেপই আমাদের নজরে আসেনি।

বোরো মৌসুমের হাওরের চালই প্রথম বাজারে ঢোকে। ফলে হাওরের ফসল রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে এ মুহূর্তে। গতকাল সোমবার সংসদে সুনামগঞ্জের হাওরের ফসল রক্ষায় দ্রুত বাঁধ শক্তিশালী করার দাবি উঠেছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয়কে সব কাজ বাদ দিয়ে বিষয়টির দিকে নজর দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন জাতীয় পার্টির একজন সাংসদ। এদিকে পাউবো বলছে, প্রতিটি বাঁধে তাদের লোক আছে। পরিস্থিতি অনুযায়ী সবকিছু করা হচ্ছে। আমরা দেখতে চাই, তারা কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেন।