Thank you for trying Sticky AMP!!

বইয়ের উৎসবের বাইরে চিরকাল

‘আমি ফুল বেচি, হ্যায় পাখি ব্যাচে, হ্যায় পানি ব্যাচে, হ্যায় চকলেট ব্যাচে, হ্যায় ট্যাকা চায়...’

এভাবেই একটি শিশু তার বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল বাংলা একাডেমির চত্বরে, ২০০৩ সালের বইমেলায়।

পাখি মানে নারকেলপাতায় বোনা সবুজ টিয়া। কিন্তু টাকা চাওয়ার বিষয়টা কী? টাকা তো আমরা সবাই চাই? পরে বুঝলাম, ‘ট্যাকা চাওয়া’ মানে ভিক্ষা করা।

আমি বিবিসি বাংলা রেডিওর জন্য বইমেলার গল্প সংগ্রহ করছিলাম। আর ওরা দারোয়ান-পুলিশের বাধা ঠেলে মেলায় ঢুকে পড়েছিল জীবিকার খোঁজে।

মনে লেগে আছে ওদের রুক্ষ ধূসর চুল, খড়ি ওঠা রোগা রোগা খালি পা আর মুখভরা হাসির ছবি। সময় গড়িয়েছে, বইমেলায় ওদের ঢোকার অধিকার আরও কমেছে। আমারও মেলায় যাওয়া অনিয়মিত হয়েছে।

গত বছর শাহবাগের মোড়ে তরুণ বয়সী একটি মেয়ে ফুলের মালা হাতে আমার গাড়ির জানালায় এসে বলেছিল, আমাকে সে অনেক দিন খুঁজেছে। আবছা মনে হয়েছিল, ও সেই শিশুদেরই একজন।

পুরোনো নোটখাতা ঘেঁটে দুটি নাম পেলাম—সোনিয়া আর আম্বিয়া। ওদের খুঁজতে সোমবার আমি মেলায় গেলাম।

মেলায় মুকুট-বাহার। আজ বসন্তে আরও জমবে। ছবি: হাসান রাজা

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পরিপাটি মেলায় ছোট-বড় মেয়েদের হিজাব ছাড়া অথবা হিজাব পরা মাথায় সাদা-তারা জিপসি, ক্যালেন্ডুলা, চন্দ্রমল্লিকা আর লাল গোলাপে গাঁথা ফুলের মুকুট। কিন্তু বিক্রেতারা কই?

একাডেমির একটি তথ্যকেন্দ্রে জিজ্ঞাসা করতেই তথ্যদাতার সন্ত্রস্ত প্রশ্ন, ‘ঢুকেছে না কি?’ তিনি বললেন, বেচাকেনা করতে ঢোকা নিষেধ। তবে এমনি ঢুকতেই পারে—‘মেলা সবার জন্য উন্মুক্ত।’

ওদের হাতে বই পৌঁছানোর আলাদা কোনো ব্যবস্থা আছে? আরেকজন তথ্যদাতা বললেন, নেই, তবে আমার মন কাঁদলে আমি একাডেমির মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করতে পারি। প্রথমজন মাথা নাড়েন, ওরা ঢুকলে ‘কন্ট্রোল’ করা যাবে না।

রমনা কালীমন্দিরের ফটক দিয়ে বেরিয়ে আসতে একদঙ্গল ছেলেমেয়ে আমাকে ছেঁকে ধরল। ওদের কবজি থেকে কনুই পর্যন্ত মুকুটের বোঝা।

সোনিয়ার খোঁজ করতে গোলাপি সালোয়ার-কামিজ পরা চেনা মেয়েটি এসে দাঁড়াল। স্মৃতি খুঁড়ে পাতার টিয়ার বর্ণনা দিল। আমি ভিডিও করতে চাইলাম, সে গুটিয়ে গেল। ছবি ‘নেটে ছাড়লে’ স্বামী রাগ করবেন।

এগিয়ে এল ১১ থেকে ১২ বছর বয়সী কুলসুম। বলল, মেলায় ঢুকতে পারলে বেশি বিক্রি হতো, কিন্তু ‘পুলিশে খ্যাদায়া দ্যায়।’ লুকিয়ে-চুরিয়ে ঢুকতে গেলে পাহারাদারেরা ফুল ছিঁড়ে দেয়।

কুলসুম পড়তে পারে না। তবে বলল, ভার্সিটির ভাইয়া-আপারা উদ্যানে ‘বৃক্ষমায়া শিশু বিকাশ কেন্দ্র’ চালায়। ফুরসত পেলে সেখানে যায়। সোনিয়া পড়েছে ‘ক্লাস ফাইভ’ পর্যন্ত। বই ‘দেখতে’ ওদের সবারই ভালো লাগে।

কুলসুম (বাঁয়ে) ও সুমাইয়া (ডানে) মুকুট বিক্রির একফাঁকে। ছবি: হাসান রাজা

বিক্রির ধান্দার মধ্যে কথা বলা মুশকিল। তারই ফাঁকে ইয়াসির আরাফাত ‘বকুল ফুল বকুল ফুল’ গান গেয়ে দিল গলা খুলে।

কয়েকটি মেয়ে এই এলাকাতেই বড় হয়েছে। কিন্তু সোনিয়াই কি আমার সেই টিয়াবিক্রেতা মেয়েটি? এত বছর পর একই মানুষকে একই জায়গায় ফিরে পাওয়া যায়?

পরদিন মনে পড়ল, ২০০৬ সালে ঈদের আগ দিয়ে প্রথম আলোর নারীমঞ্চ পাতায় শাহবাগে ফুলবিক্রেতা এক মেয়েকে নিয়ে আশানুজ্জামানের একটি ফিচার ছাপা হয়েছিল। খুঁজে পেতে পড়ে দেখি, তার নামও সোনিয়া, বয়স তখন নয় বছর।

১৮ অক্টোবর ২০০৬। নারীমঞ্চ, প্রথম আলো

অতঃপর মঙ্গলবার বিকেলে আবার আমি বইমেলার সামনে। আচমকা বিড়াল-ইঁদুর খেলায় পুলিশের দাবড় দেওয়া দেখে ফেলি। ঝুঁটি দোলানো সুমাইয়ার হাসিটা খুব মিষ্টি। বলে, ‘মেলার ভিতরে পলায়া গিয়া ফুল বেইচ্যা আইসি!’

ধাওয়া-খাওয়া একজন বলে, ‘পুলিশ বলল কী, আমগোরে এইখানের থে যাইতে লাইগ্যা। আমরা একটু ফুলও বিক্রি করার পারুম না!’ মেলার দিকে হাত তুলে বলে, ‘এগো এক ব্যবসা, আমগো একটা ব্যবসা—আমরা যেইখানে যামু, লাত্থি দিয়া বাইর করে। আমগো একটা ব্যবসা আছে না? আমগো প্যাটের ভাত হজম হয় না, অ্যাঁ?’

বিজ্ঞ জিসানের জেরায় নাজেহাল বেচারা ফরহাদ (ডানে)।

মেট্রোরেলের নির্মাণযজ্ঞ পটভূমিতে রেখে ছোট্ট ফরহাদকে জিজ্ঞাসা করি, পড়তে পারো? প্রতিদ্বন্দ্বী জিসান তাকে অ-আ, এ-বি-সি-ডি বলতে চ্যালেঞ্জ করে। তারপর বিজ্ঞের অহংকারে নির্মমভাবে রায় দেয়, ‘পড়ে না, পড়ে না!’ আর জানায়, বৃক্ষমায়া ছাড়াও এলাকায় আছে ‘মজার স্কুল’।

জিসানের হাতে মায়ের দেওয়া এক বালতি হলুদ-কমলা ক্যালেন্ডুলা। মুন্সিগঞ্জে গ্রামে থাকে, স্কুলে পড়ে। বইমেলায় আয়-রোজগারের জন্য সপরিবারে ঢাকায় আগমন।

আরেকটু এগোতে কানে আসে সোনিয়ার রাগী গলা, ‘একজনের বেচা, আরেকজন মাইর‌্যা খায়!’ শুনলাম, সে মুকুটের দর ৩৫ টাকা হেঁকেছিল। আরেকজন এসে ২০ টাকা হেঁকে খদ্দের ছিনিয়ে নিয়েছে।

পুরোনো ফিচারটার কথা জিজ্ঞাসা করতেই সোনিয়ার মুখ হাসিতে ঝলমল করে। লেখাটার শেষ বাক্য সে নির্ভুল আউড়ে যায়—‘ফুল ফোটে, ফুল ঝরে, সোনিয়ার ঈদ হয় না।’ বলে, বাবাহারা ছোট ছোট ছয় ভাইবোন আর মা মিলে তখন ‘দিন আনতাম, দিন খাইতাম।’

এখন কষ্ট কমেছে। স্বামী ‘দ্যাশে দ্যাশে’ কাজ করেন, সোনিয়া কামরাঙ্গীরচরে থাকে। মায়ের কাছে দুই মেয়েকে রেখে সে ফুল বেচতে আসে। দিনে ৫০টা মুকুটও বেচতে পারে।

বেলা একটা থেকে সে ময়দানে হাজির। মুকুট গুছিয়েছে, টিফিনবাটি খুলে আলুভাজি-ডাল-ভাত খেয়েছে। ওর বড় মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। সোনিয়া বলে, ‘আল্লাহর কাছে কই, মেয়েরা কোনো দিন য্যান রাস্তায় না আসে। রাস্তায় অনেক কষ্ট।’

পথ আটকে দাঁড়ান এক নারী। নাম ইয়াসমিন, বয়স ৩৫ বছর। স্বামী কামরাঙ্গীরচরে ভাঙারি ব্যবসা করেন। বড় ছেলে অনীক চায়ের দোকানি। মেজ ছেলে ইমন চকবাজারে রঙের দোকানে কাজ করে। ছোট ছেলে রিমন মায়ের সঙ্গে ফুল ব্যাচে।

ফুল বেচতে বেচতে ইয়াসমিনের বয়স হয়েছে ৩৫ বছর। ছবি: লেখক

হয়তো তিনি ইতিমধ্যে আমার স্মৃতি-অভিযানের কথা শুনেছেন। হয়তো না। ইয়াসমিন বলেন, আমাকে নাকি কিশোরকালে বইমেলায় দেখেছেন—‘চিনতে পারসি, আপনার চেহারা মনে আছে।’

পোড়খাওয়া চেহারার মানুষটি কান থেকে কান পর্যন্ত হাসি দিয়ে বলেন, ‘তখন ফুল বিক্রি করছি, এখনো করতেছি।’

ওদের ফটকের বাইরে রেখে আমি আবার বইয়ের উৎসবে ঢুকি। কিন্তু মেলায় সেদিন আমার মন লাগে না।

কুর্‌রাতুল-আইন-তাহ্‌মিনা: সাংবাদিক
qurratul.tahmina@prothomalo.com

আরও পড়ুন:
মেহেদী ও হাজেরার স্বপ্নে শরৎচন্দ্র
ছেঁড়া ৫০ টাকা, মানুষ আর কুকুরের ছানা