Thank you for trying Sticky AMP!!

রাজীব হোসেনের কাটা হাত

২১ বছর বয়সী উজ্জ্বল তরুণ রাজীব হোসেন বাঁ হাত দিয়ে ডান হাত খুঁজছেন। চেতন আর অবচেতনের একটা ঘোরের মধ্যে। তাঁকে শমরিতা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে ৩ এপ্রিল। যখন হাসপাতালে নেওয়া হয়, তখন তাঁর বাঁ হাতটি ছিল। ডান হাত ছিল না। সেটা কনুইয়ের নিচ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে লটকে ছিল দুই বাসের মাঝখানে। পান্থকুঞ্জের উত্তরে সার্ক ফোয়ারার কাছে।

একসময় তাঁর পুরো চেতনা ফিরে আসবে। তিনি জানবেন, তাঁর ডান হাত নেই। দুটি বাসের ঘর্ষণে কাটা পড়ে গেছে সেই হাত। তারও আগে, দুই বাসের মাঝখানে যখন তাঁর হাতটা নিষ্পেষিত হচ্ছিল, অনেকেই মোবাইল ফোনে তার ছবি তুলছিলেন। প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় গতকাল বড় করে ছাপা হয়েছে পথে লুটিয়ে পড়বার আগে নিষ্পেষিত রাজীব হোসেনের কর্তিত হাতখানার ছবি।

কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটা পা কেটে ফেলতে হয়েছিল ক্যানসার চিকিৎসার অংশ হিসেবে। তারপর তিনি বলেছিলেন, যে পা নেই, সেই পা চুলকায়। রাজীব হোসেনের যে হাত নেই, সেই হাতের অনুভূতি অনেক দিন থেকে যাবে। তাঁর হাত চুলকাবে, শিরশির করবে, কিন্তু আর কোনো দিন ডান হাত দিয়ে তিনি ভাত তুলে খেতে পারবেন না, মরহুম মা-বাবার জন্য দুহাত তুলে মোনাজাত করতে পারবেন না। ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতের নখ কাটতে পারবেন না।

আহা! বাবা নেই, মা নেই, তিতুমীর কলেজের ছাত্র তিনি। নিজের পায়ে একদিন দাঁড়াবেন, বিরূপ এই জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার লড়াইয়ে মেহনতি হাত হবে তাঁর অস্ত্র, এই তো ছিল আশা। সেই হাতটাই কিনা কাটা পড়ল!

সোনারগাঁও মোড়ের পাশে কত কত লোক রাস্তায়। রোজ কয়েক লাখ লোক পার হয় কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ, অথচ রাজীব হোসেনের হাতটার উদ্ধার পেতে এক ঘণ্টা লেগে গেল! আমরা এমনই অনুভূতিহীন হয়ে পড়লাম।

কাকে দোষ দেব! ঢাকার যেকোনো বাসের গায়ে দেখবেন, শুধু ঘর্ষণের দাগ, প্রতিটা বাস অগণিতবার ঘষা দিয়েছে অন্য যানবাহনকে, তার প্রমাণ সেসবের গায়ে গায়ে। ঢাকার রাজপথে বাস চলবার নিয়মই হলো, অন্য বাসকে ঘষা দিয়ে যাওয়া। যেমন ঢাকার রাস্তায় বাঁ দিক দিয়ে ওভারটেক করাই নিয়ম। যেমন দেশে যেকোনো জায়গায় যখন ইচ্ছা যেকোনো যান থামানো যায়, যতক্ষণ ইচ্ছা রাখা যায়, আর যাত্রী বা মাল তোলা যায়।

একটা বাস আরেকটার পথ রোধ করে বাঁকা হয়ে দাঁড়ায়। একটা আরেকটার সঙ্গে ভয়াবহ পাল্লায় মাতে। এ যেন নিষ্ঠুর এক কৌতুক। যা ওদের জন্য কৌতুক, আমাদের জন্য তা জীবনমরণের প্রশ্ন।

প্রতিবছর আমাদের সড়কে মারা যান হাজার হাজার মানুষ। এটা প্রায় গণহত্যার পর্যায়ে চলে গেছে। আরও কত হাজার হচ্ছেন আহত। কত পরিবার পথে বসে যাচ্ছে, বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছে। প্রথম আলো খবরের সিরিজ করছে, রাজপথে মৃত্যুর মিছিল থামছেই না।

কিন্তু কোনো নিয়ম নেই। শৃঙ্খলা নেই। কারও কোনো দায় নেই। দায়িত্ব নেই। করণীয় নেই। বিকার নেই। চালকদের প্রশিক্ষণ দরকার পড়বে না। গাড়ির ফিটনেস লাগবে না। সকল নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিয়ন্ত্রক হলো দুর্নীতি। গোষ্ঠীবদ্ধ দুর্বৃত্তপনা। দলগত গুন্ডামি। মাস্তানি। এককথায় নৈরাজ্য। প্রত্যেকে রাজনীতির তেজে বলীয়ান।
রাজীব হোসেনের একমাত্র সান্ত্বনা, মাননীয় উচ্চ আদালত দুই বাস কর্তৃপক্ষকে আদেশ দিয়েছেন চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনের। এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ কেন দেওয়া হবে না, তার কারণ দর্শাও নোটিশও জারি হয়েছে।

রাজীব হোসেনের খালা চেয়েছেন, যেন তাঁকে একটা চাকরি দেন সরকার।

জানি না, এসবের কটা বাস্তবায়িত হবে।

তা ছাড়া রাজীব হোসেনের হাত কি আর ফিরে আসবে?

প্রিয় রাজীব হোসেন, একটা কাজ আপনি করতে পেরেছেন, আপনার কাটা হাত দিয়ে সজোরে একটা আঘাত করতে পেরেছেন আমাদের মূঢ় চৈতন্যে, আমাদের ঘুমিয়ে পড়া বিবেকে। আমরা প্রত্যেকে নতুন করে উপলব্ধি করতে পারছি, আমরা কতখানি অসহায়, কতখানি নিরাপত্তাহীন। ট্রাফিকব্যবস্থাকে আমরা পর্যবসিত করেছি নিয়মহীনতার এক জঙ্গলে।

আপনার এই কাটা হাত আমাদের সময়ের সার্বিক নৈরাজ্যের এক প্রতীকী শিকার। আমরা প্রত্যেকে যেন অনুভব করতে পারছি, আমাদের হাত কাটা। আমরা চেতনারহিত। আমাদের বিবেক পাথরে পরিণত। আমাদের জিবও যেন খনার জিবের মতো, কর্তিত।

আপনি আমাদের ক্ষমা করুন, এটা বলার মতো অবস্থাও তো আর নেই। আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা এখন ক্ষমারও অযোগ্য।
 
আরও পড়ুন...
রাজীবের কাটা হাত ডাকছে!