রাজীবের কাটা হাত ডাকছে!

বেপরোয়া বাস: দুই বাসের ফাঁকে আটকে পড়েছে কলেজছাত্র রাজীব হোসেনের ডান হাত। বাসের চাপে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে হাতটি। প্রথম আলো ফাইল ছবি
বেপরোয়া বাস: দুই বাসের ফাঁকে আটকে পড়েছে কলেজছাত্র রাজীব হোসেনের ডান হাত। বাসের চাপে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে হাতটি। প্রথম আলো ফাইল ছবি

ঢাকার রাজপথ নদীর মতো, রক্তের দাগ তাড়াতাড়ি মুছে যায়। মঙ্গলবার যেখানে বাসচাপায় রাজীব নামের এক ছাত্রের ডান হাতটা সম্পূর্ণ কাটা পড়েছিল, সেই জায়গাটা আজ নিদাগ। কাটা হাতটা যার, তাঁকে নেওয়া হয়েছে হাসপাতালে। হাতটা তখনো বাসের চিপায় আটকে, সম্পূর্ণ অনুভূতিহীন। কিন্তু যে দেহটায় তখনো প্রাণ আছে, সেই দেহে যন্ত্রণার অনুভূতি তীব্র।

শারীরিক যন্ত্রণা মাপার যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। একটার নাম ডোলোরিমিটার, আরেকটির নাম পালপোমিটার। সেগুলো তেমন কাজের নয়। যন্ত্রণা মাপার নিজস্ব মিটার আমাদের মস্তিষ্কেরই রয়েছে। অসহ্য হলে মস্তিষ্ক তাই দেহটাকে অজ্ঞান করে ফেলে। যাতে মানুষটা আর কষ্ট না পায়। মনের কষ্ট মাপার যন্ত্র অবশ্য আজতক কেউ বানায়নি। রাজীব নামের ছেলেটি অজ্ঞান-ঘোরের মধ্যেও বাঁ হাত দিয়ে কাটা ডান হাতটি খোঁজে যখন, তখন তার যন্ত্রণাটা অনুমান করা যায়। ওর মস্তিষ্ক এখনো ভাবছে ডান হাতটি বোধহয় আছে। তাই সেখানে সংকেত পাঠায়। কিন্তু সাড়া আসে না। বহুদিন তার মস্তিষ্ক না-থাকা ডান হাতের কাছে সংকেত পাঠাবে। সেই ভুতুড়ে হাতটিতে ব্যথা হবে, সুড়সুড়ি লাগবে। এই ব্যথার নাম ঘোস্ট পেইন—ভুতুড়ে ব্যথা। কখনো হয়তো সেই কাটাপড়া হাতটি দিয়ে কাউকে জড়িয়ে ধরতে চাইবে সে। কিন্তু সাড়া পাবে না!

কেননা ঘটনার সামনে পড়ে ছবি তোলার চেয়েও জরুরি দায়িত্ব পালন করেছিলেন যাঁরা, তাঁরা ছেলেটিকে নিয়ে ছুটেছিলেন হাসপাতালে। সেই হাসপাতাল এমনই জনসেবক যে আত্মীয়স্বজন ছাড়া ছেলেটির চিকিৎসা শুরু করেনি। চিকিৎসা শুরু হয় আত্মীয়রা আসার পর। এভাবে দুর্ঘটনার পরের জরুরি সময়টায় ছেলেটি অসহায় হয়ে পড়ে থাকে। তারপর, চিকিৎসকদের মনে পড়ে কাটা হাতের কথা!

আবার লোক ছোটে। বাংলামোটর আর সোনারগাঁও হোটেলের মাঝামাঝি জায়গা থেকে হাতটা উদ্ধার হয়। কাটা হাত নিয়ে আবার তাঁরা ছোটেন পান্থপথের ওই হাসপাতালে। ততক্ষণে হাতটা মরে গেছে। এই হাত আর জোড়া লাগবে না দেহের সঙ্গে। পরদিন বিল আসে প্রায় দেড় লাখ টাকা। পুরো টাকা দিতে না পেরে মুচলেকা দিয়ে রাজীবকে নেওয়া হয় সরকারি হাসপাতালে—ঢাকা মেডিকেল কলেজে।

ধরা যাক, ঘটনাটা ঘটেনি। সেদিনও সে অন্যদিনের মতো বাসে ঝুলে ঝুলে গন্তব্যে পৌঁছাত। রাতে মেস নামক ছোট্ট কুঠুরিটায় ফিরে দুহাত দিয়ে মুখ ধুতো, ভাত খেত, মশারি টাঙাত কিংবা দুহাতে মশা মারতে মারতে ঘুমাত। এভাবে তিল তিল করে এগিয়ে যেত স্বপ্নের দিকে। মানুষ কত কিছুর স্বপ্ন দেখে। কেউবা রাজা-উজির হবে, কেউবা বিয়ে করবে রাজকন্যা-রাজপুত্রকে, কেউবা হতে চায় নায়ক বা নায়িকা। কেউ সিসিলি দ্বীপে আলিশান প্রাসাদ কিনতে চায়, কেউ হতে চায় বিলিয়নিয়ার। এগুলো হলো স্বপ্ন, যা রঙিন, যার কথা ভাবলে শরীর-মন শিহরিত হয়।

কিন্তু দারিদ্র্য নামক শতমণি নৌকার গুন টেনে যাদের শরীর ও মনে কড়া পড়ে গেছে, সেই রাজীবদের স্বপ্ন খুব সামান্য। একটা চলনসই চাকরি, মোটামুটি আয় আর একটা সচ্ছল পরিবার। সভ্য-স্বাভাবিক দেশে যা প্রত্যেক মানুষের পাওনা, তা পাওয়ার জন্য হাড়-মাংস পানি করা সংগ্রাম করার দরকার হওয়ার কথা নয় কোনো মানুষেরই। কিন্তু এই দেশে এটুকু পেতেও স্বপ্ন দেখা লাগে। মৌলিক চাহিদাটুকুও সোনার হরিণের মতো অধরা থেকে যায় অনেকের কাছে। কুৎসিত প্রতিযোগিতা করতে হয় নিজেদের মধ্যে।

ছেলেটি বহু আগেই এতিম হয়েছে। তিন ভাইবোনের মধ্যে সে বড়। টিউশনি করে আর চাচা-খালুদের সাহায্য নিয়ে সে ঢাকার তিতুমীর কলেজে পড়ালেখা করত। যত কঠিনই হোক, দুই হাত থাকলে এই জীবননদী সে হয়তো ঠিক সাঁতরে পেরোত। এই আত্মবিশ্বাস তাকে জোগাত তারই দুই হাত। শরীরই এই দেশে নিম্নবিত্তের মানুষের প্রধান সহায়। শরীর কাটা পড়ল তো ভাগ্যরেখা কাটা পড়ল। ভাগ্যহীন এই শহরে রাজীবদের জন্য আশা কম, বিপদ বেশি।

এর সব থেকে রাজীব আজ ছিটকে পড়ল। জীবনের পাহাড় এখন তাকে এক হাতে বেয়েই উঠতে হবে। সে ব্যতিক্রম নয়। পুলিশের টিয়ার শেলে চোখ হারানো সিদ্দিকুর রহমান , কিংবা সিলেটে ভুল চিকিৎসায় অন্ধ হয়ে যাওয়া ২০ জন, অথবা র‍্যাবের গুলিতে পা হারানো লিমনদের  এভাবে স্বপ্নের সিঁড়ি থেকে ছিটকে পড়তে হয়। তবুও তারা হারে না। নিজের চেষ্টায়, অন্যদের চেয়ে বহুগুণ অধ্যবসায় নিয়ে তারা আবার আসে জীবনের সড়কে, যে সড়ক তাদের পঙ্গু করে দিয়েছিল! কিন্তু সবাই ফিরতে পারে না। সংগ্রামী লিমন এভাবে ফিরেছে আইনজীবী হয়ে, কিন্তু ফিরতে পারেনি অব্যবস্থাপনাজনিত দুর্ঘটনার শিকার বিমানযাত্রীরা।

রাজীব কেন ডান হাত সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলল? কারণ, দুই চালক একে অন্যকে টেক্কা দিতে গিয়েছিল। দুই নির্বোধ চালকের প্রতিযোগিতার বলি হলো রাজীব। কিন্তু দোষ কি শুধু চালকদের? জাতীয় জীবনের মতো ভয়ানক বৈষম্য আর রেষারেষিতে ভরা রাজধানীর রাজপথ। রাস্তার রাজতন্ত্রে রাজা হলেন ভিআইপিরা। তারপরে ভেঁপুবাজানো আমির-অভিজাত প্রাডো-পাজেরো। তারপর সাধারণ প্রাইভেট কার, তারপর বাস-ট্রাক। এই শ্রেণিবিন্যাসের মধ্যে বাসযাত্রীরা হলেন সবার নিচে। যেদিন ভিআইপি-দৌড় বেশি, সেদিন তাদের মুরগির খাঁচার মতো গাদাগাদি বাসের জানালা দিয়ে আরেক বাসের যাত্রীদের দিকে দেখা ছাড়া উপায় থাকে না। কেননা গাড়ি চলে কম, আটকে থাকে বেশি। তারপর ছাড়া-পাওয়া প্রাণীর মতো সুযোগ পাওয়ামাত্রই সব গাড়ি একসঙ্গে এমন ছুট লাগায় যে দুর্ঘটনা অনিবার্য। কেন এ রকম ইঁদুর দৌড়ের সড়ক হলো আমাদের? কেন, চালকেরা এত বেপরোয়া, কেন যাত্রীদের তারা মানুষই মনে করে না? বাসমালিক ও চালক সমিতি এবং তাদের নেতা মন্ত্রী মহাশয় এবং সর্বোপরি সরকার নির্বিকার। কেন মধ্যম আয়ের দেশের সড়কে জান-মান হাতে নিয়ে অশেষ কষ্টে চলাচল করতে হবে?

জীবন যায়, বয়স ফুরায়, তবু সমাধান হয় না যে যন্ত্রণার, তার জন্য কাকে দোষ দেব? এগুলোকে দুর্ঘটনা বলে না। দুর্ঘটনার ওপর কারও হাত থাকে না। রাজীব বা সিদ্দিকুর বা লিমনের অঙ্গহানিগুলো সিস্টেমের ভুলের খেসারত। অবহেলা আর অমানবিকতার কত খেসারত যে সাধারণ মানুষকে দিতে হয়! ভাগ্যকে দায়ী করে লাভ নেই। দায়ী করতে হবে এই অমানবিক ও ভেঙেপড়া কাঠামোকে। কাঠামোর দোষেই এসব কাঠামোগত মানব-বিপর্যয়। সুতরাং কর্তৃপক্ষ দায়ী নয় লেখা নোটিশ ঝোলালেই ‘কর্তৃপক্ষ’ দায়মুক্ত হতে পারে না।

আমাদের দায়টাও স্বীকার না করা ভুল হবে। প্রতিটি মানুষ প্রতিটি মানুষকে পেছনে ফেলে বা কনুই মেরে এগিয়ে যাওয়ার যে তরিকা নিতে আমরা বাধ্য হয়েছি, তার শিকার কিন্তু আমরাই। পাওনা অধিকার আটকে রেখে ‘তারা’ যে অবস্থা বানিয়ে রেখেছে, তাতে ‘আমরা’ বাধ্য হয়ে নিজেদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ি। নিয়ম ভাঙাকেই তখন আমরা বীরত্ব ভাবি। কিন্তু দিনের শেষে খেসারত টানতে হয় আমাদেরই। দুই চালকের বা দুই যাত্রীর বা দুই সুযোগপ্রত্যাশীর পরস্পরকে টেক্কা দেওয়ার এই আত্মঘাতী ইঁদুর দৌড় থামাতে পারলে আমরা জনতা হয়ে উঠতে পারতাম। যদি নিয়ম মানতাম, যদি পাশের লোকটির প্রতি দরদ রাখতাম, কষ্টটা ভাগাভাগি করে নিতাম এবং এভাবে একসঙ্গে নিজেদের পাওনাটা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করতাম।

পাথরে আঘাত করলে শব্দ হয়, ডাকলে পর্বতও প্রতিধ্বনি করে। কিন্তু আমাদের ওপরমহল যেন অন্ধ-মূক ও বধির, ডাকলে সাড়া আসে না। কিন্তু যারা এখনো মানুষ, সাড়া দিতে হবে তাদেরই। রাজীবের কাটা হাত ডাকছে!

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]