Thank you for trying Sticky AMP!!

সম্ভাবনার পথেই এগোচ্ছে ব্র্যাক

ব্র্যাকের প্রতি মানুষের আস্থা তৈরি হয়েছে স্যার ফজলে হাসান আবেদের কারণে

আজ থেকে ৫০ বছর আগে যখন দেশ স্বাধীন হয়েছিল, তখন আমি সদ্য যুবা। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। স্বাধীনতার পরের তিন বছর আমার ব্র্যাককে দেখার সুযোগ হয়েছিল। তখন ব্র্যাকের কাজ এ জন্য চোখে পড়েছে যে আমার প্রয়াত বাবাও এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। যদিও তিনি ব্যবসায়ী ছিলেন, কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তরকাল থেকে তিনি এসব কাজের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিলেন। আমাদের পরিবার তখন থাকত পাবনায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা পুরোপুরিভাবে ঢাকায় চলে আসি।

ঢাকায় আসার পর ফজলে হাসান আবেদের নাম কানে আসে। ছাত্রাবস্থায় আমার তখন ভীষণ আগ্রহ ছিল তিনি কী করছেন তা জানার। মানুষ তো এসব কর্মকাণ্ড সাদাচোখে দেখে না। অনেক রকম সমালোচনা ছিল। অনেকেই বলতে চাইত, দরিদ্র মানুষের নামে সাহায্য এনে কী হচ্ছে? সাধারণ মানুষ ভাবত, ওই সব মানুষের কোনো উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু প্রথম থেকেই যেটা লক্ষ করতাম, ব্র্যাকের কর্মকাণ্ড একটু ব্যতিক্রমী ছিল। দরিদ্র মানুষ বা গ্রামের প্রান্তিক মানুষকে সংগঠিত করে স্বাভাবিকভাবে যখন তিনি ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প শুরু করলেন, তখনই সমালোচনা বেশি হচ্ছিল। বলা হচ্ছিল, হয়তো অল্প কিছু অর্থ দিয়ে অনেক বেশি সুদ নেওয়া হচ্ছে বা হবে। কিন্তু স্যার ফজলে হাসান আবেদ জানতেন তিনি কী করতে চাইছেন। তাই তিনি তাঁর লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন।

ব্র্যাকের প্রতি মানুষের বিশ্বাস সৃষ্টির মূলে স্যার ফজলে হাসান আবেদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। কর্মসূচিগুলো শুরুর প্রথম থেকেই তিনি নিজেই যুক্ত হয়ে যেতেন। গ্রামেগঞ্জে গিয়ে প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে কথা বলতেন। তাদের সঙ্গে উঠানে বসে সময় কাটাতেন। তখন তো তাঁর বয়স খুব বেশি ছিল না। তাঁর মতো মানুষ ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করে একটা ভালো চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসে সাধারণ মানুষের সঙ্গে একেবারে মিশে গেলেন! যার ফলে মানুষ কিন্তু প্রথম থেকেই তাঁকে বিশ্বাস করেছে।

ব্র্যাকের কাজ নিয়ে একটি উদাহরণ তুলে ধরি। আমার কাছে অবিশ্বাস্য লেগেছে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা (নন-ফরমাল এডুকেশন)। কখনো কেউ ভাবতে পারেনি যে স্কুল ছাড়া শিশুরা লেখাপড়া শিখতে পারে। স্কুলের কোনো ঘর নেই। বাড়ির বৈঠকখানায় স্কুলের ক্লাস চলছে। এভাবে খরচ কমানো হয়েছে। ওই গ্রামের ভেতর থেকেই শিক্ষক এসেছে। এমনকি গ্রামের যেসব শিশু জমিতে কাজ করত বা পরিবারের কাজে সহায়তা করত, সেসব ছেলেমেয়েকে এক করে তাদের লেখাপড়া শেখানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ওই সব শিশুর মা-বাবা, অর্থাৎ কিষান-কিষানিদেরও শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। শুধু লেখাপড়া নয়, তাদের নানা ধরনের ব্যবহারিক জ্ঞান, যেমন স্বাস্থ্যশিক্ষা, ফসলসংক্রান্ত জ্ঞান বা ধারণা দেওয়া, এটা তো সম্পূর্ণ নতুন ধরন। এসব উদ্যোগ দেখে তখন কিন্তু মানুষের মধ্যে বিশ্বাস তৈরি হয়েছে। যে কারণে আমাদের দেশের মানুষ এ রকম নতুন ধরনের কাজের জন্য নিজের জমি পর্যন্ত দিয়েছে।

ব্র্যাকের প্রতি মানুষের বিশ্বাস সৃষ্টির মূলে স্যার ফজলে হাসান আবেদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। কর্মসূচিগুলো শুরুর প্রথম থেকেই তিনি নিজেই যুক্ত হয়ে যেতেন। গ্রামেগঞ্জে গিয়ে প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে কথা বলতেন। তাদের সঙ্গে উঠানে বসে সময় কাটাতেন। তখন তো তাঁর বয়স খুব বেশি ছিল না। তাঁর মতো মানুষ ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করে একটা ভালো চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসে সাধারণ মানুষের সঙ্গে একেবারে মিশে গেলেন! যার ফলে মানুষ কিন্তু প্রথম থেকেই তাঁকে বিশ্বাস করেছে।

স্যার ফজলে হাসান আবেদ কিন্তু আরেকটা কাজ করেছেন। কখনো দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়াননি। তিনি খুব স্বচ্ছতার সঙ্গে তাঁর কাজগুলো করেছেন এবং দিন দিন অন্য অনেক খাতে তাঁর কাজের বিস্তার ঘটিয়েছেন। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি যখন শুরু হলো, তখন কেউ বিশ্বাস করতে পারেনি যে এত ভালো মানের শিক্ষকেরা এখানে আসবেন, সারা পৃথিবী থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে ইন্টার্নশিপ করতে আসবে। ব্র্যাকের সূচনালগ্নে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁদের মুখ থেকে যখন শুনি, তখন ফজলে হাসান আবেদ এবং তাঁর প্রতিষ্ঠানের প্রতি আমাদের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়। মানুষের দূরদৃষ্টি তাকে কোথায় পৌঁছে দিতে পারে, সেটিই স্যার আবেদ তাঁর জীবদ্দশায় প্রমাণ করেছেন।

স্যার ফজলে হাসান আবেদ কুমুদিনী ট্রাস্ট, বারডেম ও স্কয়ার—এই তিন প্রতিষ্ঠানের কথা উদাহরণ হিসেবে বহুবার বলেছেন। তিনি বলতেন, এই প্রতিষ্ঠানগুলো তাঁর প্রিয়। তিনি ছিলেন ফাইন্যান্স ব্যাকগ্রাউন্ডের মানুষ। সে কারণেই হয়তো তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, দান নিয়ে বা দান করে সত্যিকার অর্থে মানুষের অবস্থা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়; বরং এমন যদি কিছু করা যায়, যার মাধ্যমে তারা নিজের পায়ে দাঁড়াবে, স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে। সেই ভাবনা থেকেই উন্নয়নের এই মডেল তিনি একদম হাতে–কলমে দাঁড় করিয়েছেন। তিনি যে তিনটি প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করেছেন, সেগুলোর সঙ্গে তাঁর আদর্শগত মিল ছিল। অনেকেই মনে করেন, লাভ করা খুব খারাপ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, লাভের টাকাটা কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে? যদি তা ব্যক্তির ভোগবিলাসের জন্য ব্যবহার করা হয়, তাহলে নিশ্চয় সেটা কেউ ভালো চোখে দেখবে না। আর যদি সেটা মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা হয়, তবে সেই মুনাফা অর্জনও একটি মহৎ কাজ।

Also Read: ৫০ বছরে ব্র্যাক : মানুষের পাশে আমরা

স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে আমি নানা ধরনের প্রজেক্ট নিয়ে যখনই কোনো আলোচনা করেছি, তিনি খুব অল্পতেই আমাদের সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতেন, কোনো মডেলটা কাজ করবে, কোনটি করবে না। আমাদের কথা তিনি খুব মন দিয়ে শুনতেন, তারপর বলতেন, এটা তোমরা যতই বলো না কেন, বাস্তবে কিন্তু খুব বেশি কাজ করবে না। আমি বলব যে বুদ্ধিমত্তা ও দূরদৃষ্টি না থাকলে এ রকম হয় না। এই দূরদৃষ্টি স্যার ফজলে হাসান আবেদের ছিল। তিনি আগে থেকেই যেন বুঝতে পারতেন। দূরদৃষ্টির এই জায়গাগুলোয় আমার বাবার সঙ্গে তাঁর খুবই মিল ছিল। দুজনের চিন্তাধারায় যেমন মিল ছিল, তেমনি পারস্পরিক সমন্বয়ও খুব ভালো ছিল।

ব্র্যাক তো ৫০ বছর পার করল। ফজলে হাসান আবেদ এত দিন প্রতিষ্ঠানের মাথার ওপর ছায়া হয়ে ছিলেন। সেই জায়গাটায় তিনি এখন আর নেই। ব্র্যাককে এখন আমি আরও কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাচ্ছি। ব্যক্তিগতভাবে আগামী ৫০ বছরের ব্র্যাক নিয়ে আমি খুবই আশাবাদী। স্যার আবেদ আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বুঝতে পারছি, তিনি জানতেন, একসময় তাঁর অবর্তমানেই ব্র্যাক চলবে। সে জন্য তিনি ব্র্যাকের মধ্যে সেই পেশাদারি তৈরি করে দিয়ে গেছেন। চ্যালেঞ্জ তো অবশ্যই রয়েছে এবং স্যার আবেদের স্থান পূরণ হওয়ার মতো নয়। কিন্তু এখন যাঁরা নেতৃত্বে আছেন বা যাঁরা এর সংস্পর্শে আছেন, তাঁরা অত্যন্ত যোগ্য। তাঁরা দায়িত্ব নিয়ে এবং প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করে অনেক গভীরভাবে কাজ করছেন। আমি গর্বিত। যখন তাঁদের সঙ্গে কথা হয় বা কাজ করার সুযোগ পাই এবং কর্মকাণ্ডের প্রতিবেদনগুলো পড়ে দেখি, লক্ষ করি তা অনেক বিস্তৃত। এসব দেখে আমি ব্যক্তিগতভাবে আশাবাদী হই।

আমি একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করি। আমাকে যখন কেউ জিজ্ঞাসা করেন, আপনি কীভাবে এত কিছু পরিচালনা করেন? আমি বলি, আমি তো কিছু না। আমি একজন ফ্যাসিলেটর মাত্র। প্রতিষ্ঠানে যাঁরা কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন, তাঁরাই সবকিছু পরিচালনা করছেন। ব্র্যাকের ক্ষেত্রে স্যার আবেদ কখনোই বলেননি যে তিনি সবকিছু করছেন; বরং কর্মীদের মধ্যে সমস্ত কৃতিত্ব বিলিয়ে দেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তাঁর। আমার বাবাও একই মানসিকতার ছিলেন। তিনি সব জায়গায় বলেছেন, আজকে যেখানে পৌঁছেছি, এসবের পেছনে আমাদের কর্মীদের অবদান সবচেয়ে বেশি।

ব্র্যাক পরিবার যত দিন এই আদর্শ নিয়ে চলবে, তত দিন কোনো সমস্যা হবে না। অনেক ঝড়ঝাপটা আসবে, তবে তাকে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করতে হবে। পুরোনো ও নতুনেরা মিলে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া অনেক সহজ হবে। আমি বিশ্বাস করি, ব্র্যাকের আগামী হবে সম্ভাবনাময়।

(সংক্ষেপিত)

  • তপন চৌধুরী স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ও স্কয়ার টেক্সটাইল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং ব্র্যাকের বোর্ড সদস্য