Thank you for trying Sticky AMP!!

মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে বাবা কারাগারে: চিকিৎসককে রোগীদের প্রতিপক্ষ বানাল কে

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত শিশু মাহিরা। তার চোখেমুখে উৎকণ্ঠা আর ক্লান্তির ছাপ। চট্টগ্রাম নগরের মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতাল। ১৫ জুলাই

এই ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের কালে যে বা যাঁরা সন্তান কোলে সরকারি হাসপাতালে ছুটছেন, ধরে নিতে হবে তাঁদের প্রত্যেকের উদরে আগুন আর বুকে শঙ্কা। তাঁদের প্রতি আমরা যেন সদয় হই। আর যে বা যাঁরা পাঁচ শ শয্যার হাসপাতালে তিন গুণ রোগী সামাল দিচ্ছেন, তাঁরা সময়ের প্রয়োজনে যুদ্ধক্ষেত্রের সৈনিক। তাঁদের প্রতি আমরা যেন আস্থা না হারাই। তো এই যাঁদের অবস্থা, তাঁদের মধ্যে তো বিরোধ থাকার কথা নয়। তাহলে মাঝখানে কোন নেপো দই মারছেন?

এই নেপোর নাম স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা। আর এর কান্ডারি বা ক্যাপ্টেন হলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। বর্তমান কান্ডারির নাম জাহিদ মালেক। কথায় আছে, ‘দ্য ক্যাপ্টেন গোজ ডাউন উইথ দ্য শিপ’। টাইটানিক জাহাজের ক্যাপ্টেন ই জে স্মিথের কথা ধরুন। প্রত্যক্ষদর্শীদের কেউ বলেন, তিনি মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। কেউ বলেন, স্রোতের তোড়ে তিনি ভেসে যান। তারপর আবার টাইটানিকে ফিরে আসেন। জাহাজের ফায়ারম্যান হ্যারি সিনিয়র আরেক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, তিনি একটি নবজাতককে আঁকড়ে ধরে সাঁতরে একটি লাইফবোটের কাছে যান। তাঁকে হস্তান্তর করে ফিরে আসেন জাহাজে। বলেন, ‘আই উইল ফলো দ্য শিপ’।

ডেঙ্গু রোগীদের মেঝেতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা, ১৮ জুলাই

আমাদের ক্যাপ্টেন জাহিদ মালেককে নিয়ে ২৬ জুলাই দৈনিক কালবেলা প্রধান প্রতিবেদন ছেপেছে। এই প্রতিবেদনে তারা বলছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে পরবর্তী সাত মাসে তিনি মাত্র ৪৩ দিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অফিস করেছেন। মহাখালীর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে মন্ত্রীর একটি অফিস আছে। এই সময়কালে একবারও সেখানে যাননি তিনি। করোনাকালে তাঁর অফিস না করা নিয়েও প্রথম আলোয় প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। তবে ৫ জুলাই এক ভার্চ্যুয়াল সভায় তিনি বলেন, সরকারি স্বাস্থ্যসেবার তথ্যগুলো দেশের মানুষকে মনে করিয়ে দিতে হবে, তা না হলে মানুষ অল্প দিনেই ভুলে যায়। করোনাকালে দেশের মানুষকে বিনা মূল্যে ৩৬ কোটি টিকা দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে বিনা মূল্যে টিকা দেওয়া হয়নি।

কিন্তু যেসব কথা স্বাস্থ্য খাতের ক্যাপ্টেন চেপে গেছেন তা হলো, যখনই অতিমারি বা ডেঙ্গুর মতো রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে, তখনই ‘উন্নয়নের’ মায়াবী পর্দা দুলে ওঠে। আর সেই পর্দার ফাঁক গলে ‘চারদিকে ইট আর লোহা ছাড়া কিছুই’ দেখা যায় না। যেকোনো সরকারি হাসপাতালে গিয়ে খুল যা সিম সিম বলার আগেই ইট আর লোহার কাঠামো ঠেলে দৈন্যদশা বেরিয়ে আসবে।

Also Read: নিজেদের জয়গান বন্ধ করে আল্লাহর ওয়াস্তে ডেঙ্গু কমান 

রাজধানীর মুগদা হাসপাতালের কথাই ধরা যাক। সরকারি হাসপাতালটি আকারে-প্রকারে বিরাট। পাঁচ শ শয্যার হাসপাতালে গতকাল শুধু ডেঙ্গু রোগীই ভর্তি ছিলেন ছয় শর ওপর। মুগদা হাসপাতালের এখন ডানে-বাঁয়ে বিছানায়-মেঝেতে সর্বত্র রোগী। চিকিৎসকেরা বিছানায় বিছানায় গিয়ে শিশুদের দেখছেন, মেঝেতে বসে ইনজেকশন দিচ্ছেন সিস্টাররা। আর রিপোর্ট নিতে হয় যে কেন্দ্র থেকে তার সামনে শত শত মানুষের ভিড়, লিফটের সামনে অপেক্ষমাণ মানুষের সংখ্যা কত, মাথা গুনে শেষ করা যায় না।

২৬ জুলাই ভোরে ডেঙ্গুতে ভোগা মেয়েকে ভর্তি করতে গিয়ে এই হাসপাতালেই হাবিবুর রহমান নামের এক বাবা চিকিৎসকের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়ান। শয্যা না থাকায় চিকিৎসক তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। পরে ওই বাবাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। এক দিন পর হাবিবুর ছাড়া পান। অসুস্থ সন্তান আর বন্দী স্বামীকে নিয়ে হাবিবুরের স্ত্রী সাথি আক্তার কিসের মধ্য দিয়ে গেছেন, তা বলাই বাহুল্য। হাবিবুর রহমান নিরুপায়। সন্তানের জন্য তিনি বেপরোয়া বাবা। চিকিৎসকও নিরুপায়।

কোভিডের পর কি অক্সিজেনের সমস্যা মিটে গেছে? মোটেই না। প্রতিবেদন বলছে, উন্নতির জন্য সরকারের ‘জোরালো প্রতিশ্রুতি আছে’। সরকারের শীর্ষ পর্যায় ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজে রোজকার খবর রাখেন। তবে দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা না থাকা এবং স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হুটহাট সিদ্ধান্তের কারণে সরকারি হাসপাতালে অক্সিজেন ব্যবস্থাপনায় জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

এক সাংবাদিক সহকর্মী ৩০ জুলাই রাতে আরেক মায়ের খবর দিয়েছেন। এই মা তাঁর কাছে ইনবক্সে সহযোগিতা চেয়েছেন। মা লিখেছেন, ‘...আপনার কি মনে আছে, ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে আমার ছেলে আনাস মারা গেছে? আপনি রিপোর্ট করতে এসেছিলেন? ২০২০-এ আমার একটা মেয়ে হয়েছে। এ বছর তার তিন বছর হলো। সে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। আমি শিশু হাসপাতালে একটা বেডের জন্য অনেক ট্রাই করছি। বাট পাইনি।’

পরদিন ৩১ জুলাই  তিনি আপডেট জানান, শিশুটিকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে রাখা হয়েছে। চিকিৎসকেরা বলেছেন, তার পিআইসিইউ দরকার হতে পারে (শিশুদের জন্য নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র)। ওই বেসরকারি হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র নেই। এ অবস্থায় এই মায়ের অবস্থা কী, তা কি আমাদের ক্যাপ্টেনরা বুঝতে পারছেন?

Also Read: ডেঙ্গু নিয়ে এমন অবহেলা কেন সরকারের?

এবারের ডেঙ্গু অনেককে করোনাকালের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কথা মনে করিয়ে দেয়। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর দরজা তখনো করোনা রোগীদের জন্য বন্ধ। ‘অ্যাম্বুলেন্সে ১৬ ঘণ্টায় ৬ হাসপাতালে ছোটাছুটি, অতঃপর বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু’ শিরোনামে ২০২০ সালের ২১ এপ্রিল প্রথম আলো অনলাইনে একটি লেখা ছাপা হয়। মৃত আলমাছউদ্দীনের মেয়ে সে সময় প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বাবা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের পর থেকে অসুস্থ। ওই দিন সকাল ৮টায় বাসাবোর বাসা থেকে ছয়টি হাসপাতালে তিনি ঘোরেন। রাত ১২টার দিকে হাসপাতাল তাঁর বাবাকে ভর্তি নিলেও তাঁকে আর বাঁচানো যায়নি।

আবার কাছাকাছি সময়ে আমরা হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তৎকালীন করোনা ফোকাল পারসন চিকিৎসক নিজামউদ্দিন মিজানের ছবিও ভাইরাল হতে দেখি। হাসপাতালের আঙিনায় মৃত রোগীর সামনে পিপিই পরিহিত নিজাম অসহায় ভঙ্গিতে হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছেন। তাঁর আন্তরিক চেষ্টা ব্যর্থ করে শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগী মারা যান। বলাই বাহুল্য আমাদের নিজামউদ্দিন মিজান ‘হিপোক্রেটিক ওথ’ (চিকিৎসক হিসেবে আনুষ্ঠানিক অভিষেকের আগে নেওয়া শপথ) শুধু মেনে নেননি, মনেও নিয়েছিলেন।

হাসপাতালের আঙিনায় মৃত রোগীর সামনে পিপিই পরিহিত নিজাম অসহায় ভঙ্গিতে হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছেন।

আমরা প্রতিদিন দেখছিলাম, হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয়ের সংকট, তাঁদের পিপিই, মাস্কের সংকট; বড় বড় হাসপাতালে অক্সিজেন সংকট। গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো দুর্নীতি তো ছিলই। জরুরি স্বাস্থ্যসরঞ্জাম কিনতে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরু থেকেই অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের প্রকল্পের ব্যয় ছিল ১ হাজার ১১৭ কোটি টাকা এবং এডিবির প্রকল্পের ব্যয় ১ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা।

করোনা থেকে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা কি কিছু শিখল? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সরকারি হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ন্যাশনাল অক্সিজেন ল্যান্ডস্কেপ রিপোর্ট নামে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। ওই প্রতিবেদন বলছে, করোনা মহামারির আগে দেশের ৮৮৯টি হাসপাতালের মধ্যে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল ৯৪টিতে। এখন এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭২টিতে।

Also Read: ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মালয়েশিয়ান মডেল ঢাকার দুই সিটি কি অনুসরণ করবে

কিন্তু করোনার আগে কি মানুষের শ্বাসকষ্ট হতো না? তাতে কি রোগীরা মারা যেত না? এই সংকটের কথাও বেমালুম চেপে গেছেন ক্যাপ্টেনদের সবাই। যদিও সরকারি ওই প্রতিবেদনই বলছে, হাইপোক্সিমার কথা । এ অবস্থায় রক্তে অক্সিজেন কমে এবং রোগীর বাড়তি অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়।

২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আইসিডিডিআরবি, ঢাকা হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় ভোগা শিশুদের প্রায় ৪০ ভাগ, মারাত্মক নিউমোনিয়ায় ভোগা পাঁচ বছর বয়সী শতভাগ শিশুর অক্সিজেন লেগেছিল। বয়স্কদের যাঁরা সিওপিডি বা নিউমোনিয়ায় ভোগেন, তাঁদেরও লাগে। যদিও এর কোনো পরিসংখ্যান রাখার তোয়াক্কাই করেনি সরকার। আর কোভিডের সময় তো  হাসপাতালে ভর্তি রোগীর প্রায় ৭০ ভাগের অক্সিজেন লেগেছে।

কোভিডের পর কি অক্সিজেনের সমস্যা মিটে গেছে? মোটেই না। প্রতিবেদন বলছে, উন্নতির জন্য সরকারের ‘জোরালো প্রতিশ্রুতি আছে’। সরকারের শীর্ষ পর্যায় ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজে রোজকার খবর রাখেন। তবে দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা না থাকা এবং স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হুটহাট সিদ্ধান্তের কারণে সরকারি হাসপাতালে অক্সিজেন ব্যবস্থাপনায় জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

আরও যে সমস্যার কথা বলা হয়েছে তা হলো, হাসপাতালের অক্সিজেন ব্যবস্থাপনা ও যন্ত্রপাতি মেরামতের কাজটা করার কথা যে ন্যাশনাল ইলেকট্রো মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের, সেখানে জনবল ঘাটতি। বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আছেন ১৩ জন। এই প্রতিষ্ঠানের দিকে কখনোই নজর দেওয়া হয় না। কারণ, সরকার হাসপাতালের নাম করে অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় ওস্তাদ। এই যন্ত্রপাতি আবার যাঁরা গছান, তাঁদের সঙ্গে সরকারের বড় বড় লোকের ভাব-ভালোবাসার খবর কারও অজানা নেই।

এই তো গত ফেব্রুয়ারিতে প্রথম আলো জানাল, দেশের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল ও সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৯ ধরনের ২৩৮টি যন্ত্রপাতি নষ্ট। যার দাম প্রায় ১০০ কোটি টাকা। ওই সময় ঢাকা ও সোহরাওয়ার্দীতে এমআরআই মেশিন নষ্ট থাকায় অশেষ ভোগান্তি হয়েছে রোগীদের। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসক ও রোগীর বাইরেও আরও অনেকগুলো পক্ষ আছে। সবগুলো পক্ষ যখন সমানভাবে সক্রিয় না হয়, তখনই ঘটে মারামারি হাতাহাতির ঘটনা।
এবার বুঝলেন তো, কোন নেপো বারবার দই মেরে যাচ্ছে?

  • শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক।
    ই-মেইল-sabiha.alam@prothomalo.com