ডেঙ্গু নিয়ে এমন অবহেলা কেন সরকারের?

ডেঙ্গুতে রেকর্ড সংখ্যক মৃত্যু দেখল বাংলাদেশ। এর আগে ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহতা দেখা গিয়েছিল। সেসময় ঢাকা শিশু হাসপাতালের ডেঙ্গু সেলে শিশু মুশনানের এই ছবি প্রথম আলোতে প্রকাশ হওয়ার পর সবার হৃদয় ছুয়ে গিয়েছিল।
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

কয়দিন আগের কথা। হেমন্তের সন্ধ্যায় ঢাকার প্রচণ্ড যানজটের মধ্যে আটকে আছি। নিরুপায় হয়ে গাড়িতে বসে ফেসবুকে সময় কাটাচ্ছি। তখনই দেখলাম একটি পোস্ট, ‘আমাদের ছোট মধু আকাশে উড়াল দিয়েছে।’ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীর পোস্ট ছিল সেটি। ফারওয়াহ মান্নান মোহাম্মদী (মধু) তাঁরই কনিষ্ঠ মেয়ে। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে মধুর জন্য রক্ত চেয়ে জন্য পোস্ট দিয়েছিলেন তিনি। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও মধুকে বাঁচানো যায়নি।

ফুলের মতো শিশু মধুর মৃত্যু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নাড়া দিয়ে গেল। ফারসীম মান্নান ও তাঁর স্ত্রী ফারহানা মান্নানের প্রতি সমবেদনা প্রকাশে মধু যেন সবারই আদরের সন্তান হয়ে ওঠে। আমরা দেখছিলাম, দম্পতিটি হাসপাতালের বিছানায় শেষবারের মতো মেয়েকে স্পর্শ করছেন, মেয়ের হাতে চুমু খাচ্ছেন। লাশের গাড়ির পেছন থেকে তাঁদের তোলা ছবি, মেয়ের লাশ কাঁধে নেওয়ার ছবি ফেসবুকে শেয়ার দিয়ে তাঁদের আবেগ প্রকাশ করেছিলেন। বুঝতে পারছিলাম, প্রিয় সন্তানকে আর কখনো দেখবেন না তাঁরা, তাকে আদর করার সুযোগ মিলবে না। তাই পাগলপ্রায় এ দম্পতি মধুর শেষবিদায়ের স্মৃতি ধরে রাখছেন। এ নিয়ে ফেসবুকে অনেকে নানা কথাও বলেন। কিন্তু সন্তান হারানো মা বা বাবার শোক কতভাবেই না প্রকাশ পায়, সেটি কী করে ভুলি আমরা!

পাঁচ বছর বয়সী মধু মারা গেছে ডেঙ্গুতে। সংবাদমাধ্যমে আমরা দেখতে পাচ্ছি, মধুর মতো আরও অনেক শিশুই মারা যাচ্ছে মশাবাহিত রোগটিতে। অল্প কয়েক মাস বয়সী শিশুও রেহাই পায়নি। চলতি বছর গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ২১৩ জনের মৃত্যু হলো। বরাবরের মতো সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন হাসপাতালে। ২০০০ সালে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যাওয়ার পর এই প্রথম কোনো বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা দুই শ ছাড়াল। আরও উদ্বেগজনক হচ্ছে, ২০ থেকে ২৯ বছর বয়সী মানে তরুণেরাই এবার ডেঙ্গুতে বেশি মারা যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য পর্যালোচনা থেকেই বিষয়টি ওঠে এসেছে।

এর আগে ডেঙ্গু বড় আতঙ্ক হয়ে উঠেছিল ২০১৯ সালে। সে বছর সরকারি হিসাবে মারা গিয়েছিল ১৭৯ জন। মারা গিয়েছিলেন বেশ কজন চিকিৎসকও। ডেঙ্গুর ভয়াবহতার সঙ্গে সেবারই প্রথম পরিচয় ঘটে আমাদের। পত্র–পত্রিকা, টিভি চ্যানেল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সর্বত্র মানুষের মনোযোগ হয়ে উঠেছিল মশাবাহিত এই রোগ। ডেঙ্গু মোকাবিলায় ব্যর্থতা নিয়ে সরকার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশনগুলোকে তুলাধোনা করেছিল মানুষ। ডেঙ্গু মোকাবিলার নামে এফডিসির নায়ক–নায়িকাদের নিয়ে এক মন্ত্রীর মশক নিধন অভিযানও আতঙ্কের মধ্যে ব্যাপক হাস্যরস তৈরি করেছিল। অথচ সে বছর মার্চেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প থেকে জরিপ করে সতর্কবাণী দেওয়া হয়েছিল ঢাকা সিটি করপোরেশনগুলোকে। তারা তো পাত্তাই দেয়নি, এমনকি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি।

পূর্ব পাকিস্তানে হাবীবুল্লাহ বাহার নামে একজন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন। তখনকার ঢাকার অনেক এলাকা ছিল ঘন জঙ্গলে ভরা। সে সময় তিনি ঢাকা শহরে মশা নিধন করে প্রশংসিত হয়েছিলেন। তখন এখনকার মতো এত উন্নত প্রযুক্তি, কায়দাকানুন ও প্রতিষেধকও ছিল না। এত বছর আগে একজন হাবীবুল্লাহ বাহার পারলে এখনকার মেয়র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীরা কেন পারছেন না। জনগণ বা নাগরিকদের কেন বারবার তাঁরা মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছেন?

মাঝখানে করোনা মহামারি এসে মৃত্যু–আতঙ্ক কী ভয়াবহ হতে পারে, তা দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের। ফলে ডেঙ্গুর সেসব আতঙ্কময় দিন আমরা ভুলেই গিয়েছি বলা যায়। সে বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গুজনিত মৃত্যু পর্যালোচনায় একটি কমিটি গঠন করেছিল। কিন্তু সেই কমিটির কোনো রিপোর্ট কখনো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি।

ওই বছর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ঢাকার এক মেয়র বলেছিলেন, তাঁর সততায় কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু অভিজ্ঞতায় কিছুটা ঘাটতি আছে। এখনো তিনি শিখছেন। ঢাকার আরেক মেয়র ছিলেন পাশেই। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, তিন বছর পার হতে চলল। আর কত বছর গেলে ডেঙ্গু মোকাবিলায় তাঁরা অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন?

এখনো ঢাকার মেয়ররা মশকনিধন নিয়ে নানা কথাবার্তা বলে যাচ্ছেন। যুক্ত হয়েছেন ঢাকার বাইরের অন্য মেয়ররাও। তাঁদের সবার ভাবভঙ্গি দেখলে মনে হবে, ডেঙ্গু মোকাবিলায় তাঁরা খুব ‘সিরিয়াস’। অথচ সিটি করপোরেশনগুলো মশা মারতে যে ওষুধ ছিটিয়ে থাকে, তার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্নই দূর করতে পারেননি তাঁরা। মশা মারার ওষুধ কেনাকাটা, সেগুলো ছিটানোসহ গোটা কার্যক্রমে নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার বিষয় তো আছেই।

পূর্ব পাকিস্তানে হাবীবুল্লাহ বাহার নামে একজন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন। তখনকার ঢাকার অনেক এলাকা ছিল ঘন জঙ্গলে ভরা। সে সময় তিনি ঢাকা শহরে মশা নিধন করে প্রশংসিত হয়েছিলেন। তখন এখনকার মতো এত উন্নত প্রযুক্তি, কায়দাকানুন ও প্রতিষেধকও ছিল না। এত বছর আগে একজন হাবীবুল্লাহ বাহার পারলে এখনকার মেয়র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীরা কেন পারছেন না। জনগণ বা নাগরিকদের কেন বারবার তাঁরা মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছেন?

এ বছর ডেঙ্গু মৌসুমের শুরু থেকেই বারবার সতর্কবাণী দিয়ে আসছিলেন জনস্বাস্থ্যবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশারের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘এ বছর মে মাসে যখন ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হলো, তখন ঠিকভাবে এডিস মশা এবং ডেঙ্গুর ব্যবস্থাপনা করতে না পারার কারণে এটি জ্যামিতিক হারে বেড়ে গিয়ে বর্তমানে এই ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।’

২০১৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক কে কৃষ্ণমূর্তি এডিস মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে যে পরিকল্পনা বাংলাদেশ সরকারকে দিয়েছিলেন, সেটি আমলে নেওয়া হয়নি বলে দুই বছর পর বড় একটি ধাক্কা দেখতে হলো আমাদের। সেই পরিকল্পনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ছাড়া স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, সড়ক ও পরিবহন মন্ত্রণালয়, রেল মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করার কথা বলা হয়েছিল। কোন মন্ত্রণালয় কী ভূমিকা ও দায়িত্ব পালন করবে, তাও সংক্ষিপ্ত আকারে বলা হয়েছিল। এখন পর্যন্ত সরকারের তেমন পদক্ষেপ আমরা দেখছি না। এখন ডেঙ্গু আর বড় শহরগুলোয় সীমাবদ্ধ নেই। জেলা–উপজেলার মফস্বল শহরগুলোয় পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। মৃত্যুর রেকর্ডও হয়ে গেছে।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, অতীতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো হয়নি, বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জাতীয় কোনো পরিকল্পনা দেওয়া হয়নি। এই মশা থাকলেই রোগী থাকবে। এখন যে প্রকোপ দেখা যাচ্ছে, তা ছিল অবধারিত। (ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নেই জাতীয় পরিকল্পনা, ২১ অক্টোবর ২০২২, প্রথম আলো)

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আমরা জানতে পারছি, এ বছর প্রায় সব জেলায়ই ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। কীটতত্ত্ববিদেরা বলছেন, দেশের সব শহরেই ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা আছে। কিন্তু সারা দেশের সব শহর ও উপজেলা পর্যায়ে মশা নিয়ন্ত্রণের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না। অনেক জেলায় মশা নিয়ন্ত্রণে জনবল নেই, নেই সরঞ্জাম ও কীটনাশক।

২০১৯ সালে ডেঙ্গু পরিস্থিতির সময় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যের একটি বক্তব্য এখনো মনে পড়ে। গোপালগঞ্জে এক সেমিনারে তিনি বলেছিলেন, ‘যে দেশ যত বেশি উন্নত হচ্ছে, সে দেশে তত বেশি রোগ-বালাইয়ের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডেঙ্গু এলিট শ্রেণির একটি মশা। এ মশা সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, কলকাতা শহরে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ উন্নত দেশ হতে যাচ্ছে। তাই এ দেশে ডেঙ্গু এসেছে।’ (২১ আগস্ট ২০১৯, প্রথম আলো)

আরও পড়ুন

দেশ উন্নত হচ্ছে। তাঁদের ভাষ্য অনুযায়ী ধরে নিলাম, দেশ ‘সিঙ্গাপুরও’ হয়ে যাচ্ছে। অথচ বরিশালের মতো বিভাগের কোনো সরকারি হাসপাতালেই ডেঙ্গু আক্রান্ত গুরুতর রোগীদের প্লাটিলেট সেল সেপারেটর মেশিন বা প্লাটিলেট আলাদা করার যন্ত্র নেই। ফলে এসব রোগীকে ঢাকায় পাঠাতে হচ্ছে। এবারের ডেঙ্গুর ধরনই হচ্ছে, আক্রান্ত হওয়ার অল্প কয়েক দিনের মধ্যে রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। সেখানে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে একজন গুরুতর রোগীকে ঢাকায় আনতে গিয়ে এমন সময়ক্ষেপণ কী করে মানা যায়। নানা দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার মধ্যেও করোনা মহামারি মোকাবিলায় দারুণ সাফল্য দেখিয়েছেন আমাদের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। ডেঙ্গু মোকাবিলায় কোনো জাতীয় কর্ম পরিকল্পনা নেই বলে তাঁদের সেই অভিজ্ঞতাও কাজে লাগানো যাচ্ছে না।  

২০১৯ সালে দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকা এক প্রতিবেদনে লিখেছিল, ঢাকায় মেট্রোরেল প্রকল্পের মতো বড় আকারের অবকাঠামো প্রকল্প ও ব্যাপকভাবে নির্মাণকাজের ফলে জমে থাকা পানি থেকে ডেঙ্গু রোগ বেড়ে গিয়েছিল। এখনো মেট্রোরেল প্রকল্প চলমান। সঙ্গে মহাদুর্ভোগের বিআরটি প্রকল্প তো আছেই। মেয়াদ বাড়ে কিন্তু প্রকল্প শেষ হয় না। আরও মেগাপ্রকল্প পরিকল্পনাধীন। ড. কবিরুল বাশার বলছেন, ‘অপরিকল্পিত নগরায়ন এডিস মশার প্রজননস্থল তৈরির বড় কারণ। এর মধ্যে আছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিও। ঢাকা শহরে এখন ডেঙ্গু সারা বছরই থাকবে। কারণ ঢাকায় এডিস মশার প্রজননের জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা সারা বছরই বিদ্যমান। ফলে এডিস মশার প্রজননের জন্য এখন আর বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন নেই।’

তার মানে সামনের বছরগুলোয় ডেঙ্গুর আরও বেশি প্রকোপ আমাদের দেখতে হবে। এমন কথা বলতেই হচ্ছে, যেহেতু সরকার ঘরে–বাইরের কোনো বিশেষজ্ঞের কথা আমলে নিচ্ছে না, সদিচ্ছাও দেখাচ্ছে না। মেয়ে হারিয়ে ফারহানা মান্নান বলেছিলেন, ‘আজ আমার মেয়ে গেল, কাল আরেকজনের যাবে। নিজের না হারালে আমরা ব্যথাটা বুঝতে পারি না। এভাবে তো চলতে পারে না।’ কিন্তু এভাবেই তো চলছে সব, হয়তো সামনের বছরগুলোয়ও এভাবেই চলবে। স্বজন হারানোর ব্যথা নিয়ে আক্ষেপ করা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না আমাদের।

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সহসম্পাদক। ইমেইল: [email protected]