Thank you for trying Sticky AMP!!

যে কারণে এরদোয়ানকে নিয়ে বাংলাদেশিদের এত আগ্রহ

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান

নির্বাচন হয়েছে তুরস্কে, আর সারা রাত ঘুম হয়নি মালিবাগ চৌধুরী পাড়ার হোমিওপ্যাথি ডাক্তার মজনু মিয়ার। তুরস্কে ভোটের পরদিন ভোরে হাঁটতে বেরিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন, রাত জেগে তিনি খোঁজ রাখছিলেন, রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান জিতছেন নাকি কেমাল কিলিচদারওলু।

মজনু মিয়ার কথা থেকে জানা গেল, আমাদের সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে শুরু করে আমেরিকার বাইডেন-ট্রাম্প লড়াইয়ের সময়ও তিনি এত উত্তেজনা বোধ করেননি। তিনি বললেন, ‘এরদোয়ান ফার্স্ট রাউন্ডে জিততে পারল না। মনে বড় কষ্ট পাইছি। তবে ২৮ তারিখের সেকেন্ড রাউন্ডে পাস করবে হান্ড্রেড পার্সেন্ট নিশ্চিত।’

শুধু মজনু মিয়া নন, পরিচিতজনদের অনেকের মধ্যে তুরস্কের নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ দেখেছি। তাঁদের বেশির ভাগই এরদোয়ানের কট্টর সমর্থক। ফেসবুকেও বাংলাদেশিদের একটি বড় অংশ এরদোয়ানের ভক্ত।

Also Read: এরদোয়ান কেন প্রথম রাউন্ডে জিততে পারলেন না

প্রথম রাউন্ডের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে হলে দরকার ছিল ৫০ শতাংশ ভোট। ৯৯ শতাংশ ভোট গণনায় দেখা গেল, এরদোয়ান পেয়েছেন ৪৯ দশমিক ৫১ ভোট। মানে আর মাত্র শূন্য দশমিক ৪৯ শতাংশ ভোট পেলে তিনি প্রেসিডেন্ট হয়ে যেতেন।

সামান্য একটুর জন্য সেই কোন সুদূরের দেশ তুরস্কের এরদোয়ান প্রথম ধাক্কাতেই জয় পেলেন না, এই নিয়ে বাংলাদেশের কেউ কেউ যেভাবে আক্ষেপ করেছেন, তাকে “লঙ্কায় রাবণ ম’লো, বেহুলা কেঁদে বিধবা হলো” বলে উড়িয়ে দেওয়া ঠিক হবে কি না, তা তর্কসাপেক্ষ।

অনেকে এখনো দ্বিতীয় রাউন্ডের ভোটে এরদোয়ানের জয় কামনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ তাঁর গদিচ্যুতি দেখতে চাচ্ছেন।

ধারণা করি, তুর্কি নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশিদের মধ্যে যাঁদের আগ্রহ বেশি বা ফেসবুকে এ নিয়ে ‘সক্রিয়’, তাঁদের বেশির ভাগই বয়সে তরুণ-যুবা এবং এরদোয়ানের ‘সমর্থক’। অনেকে বলছেন, এরদোয়ান বাংলাদেশের মতো বাইরের অনেক মুসলিমপ্রধান দেশে যতটা জনপ্রিয় নেতা, তাঁর নিজের দেশের লোকের কাছে ততটা নন।

ব্যালট হাতে এরদোয়ান।

কোনো কোনো বাংলাদেশি ‘ফেসবুকীয় বুদ্ধিজীবী’কে তুরস্কের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহী বাংলাদেশি তরুণদের বুদ্ধিবৃত্তিক গভীরতার বিষয়ে ব্যাপক সন্দিহান বলে মনে হচ্ছে।তাঁদের বক্তব্য হলো, নিজের দেশের ভোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে যাঁদের মাথাব্যথা প্রায় নেই, তাঁদের জন্য তুরস্কের নির্বাচন নিয়ে আসর গরম করা আর মাঘ মাসে খোলা মাঠে খালি গায়ে কাঁঠালপাতা চিবানো এক কথা।

তুরস্কের ভোট নিয়ে বাংলাদেশিদের মাথাব্যথা ভালো নাকি খারাপ, সেই তর্কের ঊর্ধে যে সত্যটা দিনের আলোর মতো ফুটে আছে, সেটি হলো বাংলাদেশিদের মধ্যে যাঁরা ইসলামের হৃৎ গৌরব পুনরুদ্ধারের আশা মনের নিভৃতে একান্ত যত্নে লালন করে, এরদোয়ানকে তাঁরা সেই আশার ভরকেন্দ্র মনে করছেন।

এর পেছনে যে মনটি কাজ করছে, তাকে সামাল দিতেই সম্ভবত প্রায় দেড় দশক ধরে বিবিসি, সিএনএন, এএফপি, রয়টার্স, নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়ালস্ট্রিট জার্নালসহ সব পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম এরদোয়ানের নামের আগে একবার এবং পরে একবার ‘স্বৈরাচার’, ‘কর্তৃত্ববাদী’, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী’ ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে যাচ্ছে এবং তাঁকে বৈশ্বিক মানবাধিকারের অগ্রগতির অন্যতম অন্তরায় বলে অভিহিত করে যাচ্ছে। তবু এরদোয়ানের জনপ্রিয়তা কমেনি। তাঁর নিজের দেশেও যেমন নয়, বাইরের অনেক দেশে, বিশেষ করে মুসলিমপ্রধান দেশেও না।

তুর্কিদের আর বাংলাদেশিদের এরদোয়ান-ভাবনা এক নয়

ভোটে পার্লামেন্টে বিপুল সংখ্যক আসনে একেপির জয়ে এরদোয়ান সমর্থকদের উল্লাস।

এটি মাথায় রাখা দরকার, তুরস্কের ভোট ইস্যুতে তুরস্কের নাগরিক আর বাইরের দেশের নাগরিকের ভাবনায় বিস্তর ফারাক আছে। যাঁরা তুরস্কের ভোটার, তাঁদের কাছে এরদোয়ানের অভ্যন্তরীণ নীতি, বিদেশনীতি, ডলারের বিপরীতে লিরার দরপতনসহ সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা, মানবাধিকার পরিস্থিতি—সবকিছুই বিবেচনার বিষয়।

সেখানকার ভোটার যদি কুর্দি বংশোদ্ভূত হন, তাহলে তাঁর ভোটের হিসাব এক রকম; ভোটার যদি উদারপন্থী পশ্চিমা ঘরানার জীবনযাপন পছন্দ করে থাকেন, তাহলে তাঁর বিবেচনা হবে এক রকম; আর ভোটার যদি রক্ষণশীল ইসলামপন্থী হন, তাহলে তাঁর ভোট-ভাবনা হবে আরেক রকম। অর্থাৎ একজন ভোটার এরদোয়ান নাকি কিলিচদারওলুকে ভোট দেবেন, তা ঠিক করতে তাঁকে তুরস্কের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, বিদেশনীতিসহ বহু বিষয় বিবেচনা করতে হয়।

কিন্তু যে লোক তুরস্কের ভোটার নন; যিনি বাংলাদেশের মতো অন্য একটি রাষ্ট্রের নাগরিক, এরদোয়ানকে পছন্দ করা না করার ক্ষেত্রে তিনি এত কিছু বিবেচনায় নেন না। তুরস্কে লিরার দাম ডলারের বিপরীতে আকাশে উঠলে কিংবা পাতালে নামলে তাঁর কিছু যায়-আসে না।

তুরস্কের মানুষের রুটি-কাবাব কিনতে কষ্ট হচ্ছে কি না এবং এরদোয়ানের জায়গায় কিলিচদারওলু প্রেসিডেন্ট হলে সেই রুটি-কাবাব পানির দামে কেনা যাবে কি না, এসব স্থানীয় বিষয় নিয়েও তাঁর মাথা ঘেমে ওঠে না। দূর দেশে থাকা মজনু মিয়ার মতো রাম-শ্যাম-যদু-মধুর মতো অনেকের মাথায় তুরস্কের নির্বাচন ইস্যুতে বড় হয়ে থাকে অন্য কিছু। সেই অন্য কিছু হলো সংস্কৃতি, যার গুরুত্বপূর্ণ ধারক ধর্ম।

Also Read: তুর্কি সুলতান এরদোয়ান কখনো ঘুমান না

সেই নিরিখে বিচার করলে বোঝা যাবে, বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বে এরদোয়ান মূলত ধর্মীয় চেতনাগত কারণেই জনপ্রিয় নেতা হিসেবে বিবেচিত হন। আর এরদোয়ানের পরাজয় যাঁদের কাছে স্বস্তিদায়ক, তাঁরা প্রধানত পশ্চিমা মননের প্রগতিশীল শ্রেণিভুক্ত।

এই দুই শিবিরের কেউই তুরস্কের স্থানীয় অর্থনীতি কিংবা ভূমিকম্পে দুর্গত মানুষের ইস্যু নিয়ে ততটা চিন্তিত নন, যতটা চিন্তিত সরকার পরিবর্তনের ফলে তুরস্কের সমাজ-সংস্কৃতি সংক্রান্ত বিদ্যমান নীতির অদলবদল হবে কি না, তা নিয়ে। তার মানে, তাদের কাছে তুরস্কের নির্বাচনে অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল ইসলামপন্থী এরদোয়ানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) এবং নব্য তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের প্রতিষ্ঠিত সেক্যুলার দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (সিএইচপি) নেতা কেমাল কিলিচদারওলুর নেতৃত্বাধীন জোটের মধ্যে দুনিয়ার আর দশটা সাধারণ ভোটের লড়াইয়ের মতো নয়। এই লড়াই সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বে নিজের মনের সায় পাওয়া।

তুরস্কের সাংস্কৃতিক অদলবদল নিয়ে বাংলাদেশিদের মাথা ব্যথার কী যুক্তি?

তুরস্কে অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতির পাশাপাশি সেখানে যে স্পষ্ট একটি ‘কালচারাল সিভিলওয়ার’ চলছে, তা ওই নির্বাচনে বড় ভূমিকা রেখেছে। আর সেই ‘সাংস্কৃতিক যুদ্ধের’ লু হাওয়ার আঁচ বাংলাদেশের উৎসুক ‘দর্শক-শ্রোতার’ গায়েও পড়েছে। এই মনের কাছে অর্থনীতির চেয়েও ইতিহাস, সংস্কৃতি আর ধর্মীয় মূল্যবোধের আবেদন বড়।

স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের ‘দর্শক-শ্রোতাদের’ একটি বড় অংশ এরদোয়ানের জয়-পরাজয়কে নিজের অনুসৃত ধর্মীয় অবস্থানের জয়-পরাজয় হিসেবে দেখছে। তাঁদের অনেকের কাছে এরদোয়ান একটি জনমানসের ‘সুলতান’ এবং ‘উম্মাহর নেতা’।

একইভাবে উদারপন্থীরা বিরোধী জোটের জয়-পরাজয়ের সঙ্গে নিজেদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দর্শনের জয়-পরাজয় হিসেবে দেখছেন। তাঁদের কাছে এরদোয়ান নব্য তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতাতুর্কের চালু করা পশ্চিমা সংস্কৃতি ও প্রগতির পথে বৈশ্বিক মাত্রার এক বিরাট অন্তরায়।

সেই দৃষ্টিতে তুরস্কে ভোটের লড়াইয়ের পাশাপাশি যে আরেকটি অদৃশ্য লড়াই চলছে, সেটি হলো কামাল পাশার আদর্শ বনাম এরদোয়ানের আদর্শের লড়াই। কামাল পাশার রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তি হলো সেক্যুলারিজম। আর এরদোয়ানের অনুসৃত আদর্শ হলো মধ্য-রক্ষণশীল ইসলাম, যার সঙ্গে মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের আদর্শিক যোগসূত্র রয়েছে।

শত শত বছর ধরে যে তুর্কি ভাষার হরফ ছিল আরবি, কামাল পাশা তা রাতারাতি রোমান হরফে বদলে ফেলেন। হিজরি সাল সরকারি ক্যালেন্ডারে ছিল, সেটিকে তিনি খ্রিষ্টাব্দে নিয়ে আসেন। জুমার দিন সরকারি ছুটি ছিল, সেটিকে তিনি রোববারে নিয়ে আসেন। আরবি কোরআন নিষিদ্ধ করে শুধু কোরআনের তুর্কি অনুবাদ পড়াকে বৈধ রাখলেন।

একটু পেছনে যাই

এই দুই আদর্শের দ্বন্দ্বের গভীরতা বুঝতে আমাদের ১০০ বছর পেছনে যেতে হবে।

১৯২৩ সালে লুজান চুক্তির মধ্য দিয়ে অটোমান সাম্রাজ্যকে টুকরা টুকরা করে যে ছোট একটি ভূখণ্ডকে আধুনিক তুরস্ক বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, তার প্রেসিডেন্ট ছিলেন মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক (কামাল পাশা)। কামাল পাশা রাতারাতি আর্থিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ইত্যাদি খাতে সংস্কারের মাধ্যমে তাঁর যেসব আদেশ তুর্কিদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন, তা ইতিহাসে নজিরবিহীন।

বর্তমানে সৌদি বাদশাহ ‘মক্কা ও মদিনার দুই মসজিদের খাদেম’। কিন্তু তার আগে এই দুই পবিত্র মসজিদের ‘খাদেম’ ছিলেন অটোমান বা উসমানিয়া সাম্রাজ্যের সুলতানরা। সে সময় তুর্কি মুসলমানদের জীবনাচরণ ছিল ইসলামি অনুশাসনসিদ্ধ। তাঁদের ভাষা তুর্কি হলেও বর্ণমালা ছিল আরবি। ফলে শতভাগ মুসলমান কোরআন পড়তে পারত।

শত শত বছর ধরে যে তুর্কি ভাষার হরফ ছিল আরবি, কামাল পাশা তা রাতারাতি রোমান হরফে বদলে ফেলেন। হিজরি সাল সরকারি ক্যালেন্ডারে ছিল, সেটিকে তিনি খ্রিষ্টাব্দে নিয়ে আসেন। জুমার দিন সরকারি ছুটি ছিল, সেটিকে তিনি রোববারে নিয়ে আসেন। আরবি কোরআন নিষিদ্ধ করে শুধু কোরআনের তুর্কি অনুবাদ পড়াকে বৈধ রাখলেন।

মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক (কামাল পাশা) আর্থিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ইত্যাদি খাতে যেসব সংস্কার তুর্কিদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন, তা ইতিহাসে নজিরবিহীন

আরবি আজান নিষিদ্ধ করে তিনি তুর্কি ভাষায় আজান চালু করলেন। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত সেভাবেই আজান দেওয়া হয়েছে। মসজিদগুলোতে সরকারি ইমাম নিয়োগ করেছিলেন যাঁদের, তাঁদের দায়িত্ব নেওয়ার আগে মিনিস্ট্রি অব ন্যাশনাল এডুকেশন থেকে সরকারের দিকনির্দেশনার বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে হতো।

তুর্কিরা যে ঐতিহ্যবাহী ফেজ টুপি পরত, তা পরা নিষিদ্ধ করে সব সরকারি কর্মচারীর জন্য পশ্চিমা হ্যাট পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। পুরুষদের ইসলামি জোব্বা ও নারীদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। অটোমান শাসকদের সময় অ্যালকোহলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কামাল পাশা তুরস্কে অ্যালকোহল উন্মুক্ত করে দেন।

কামাল পাশা এই যে সংস্কারের মধ্য দিয়ে তুর্কিদের ওপর পশ্চিমা জীবন চাপিয়ে দিলেন, সেটিকে পশ্চিমাদের খারাপ চোখে দেখার কোনো কারণ নেই। পশ্চিমসহ বহু স্থানে এই সংস্কারকে স্বাগত জানানো হয়েছিল।

বাংলাদেশের ‘কম শিক্ষিত’ মজনু মিয়ারা যখন এ সময়ে এসে কামাল পাশার সেই সংস্কার কর্মসূচি পড়েন তখন তাঁরা সেই কর্মসূচির মধ্যে ইসলামি জীবনধারাকে কোণঠাসা করার প্রবণতা খুঁজে পান।

যখন তাঁদের মনে হয়, কামাল পাশার ‘ভাবশিষ্য’ কিলিচদারওলু প্রেসিডেন্ট হলে তুরস্কে আবার কামাল পাশার সেক্যুলার ভাবধারা ফিরে আসতে পারে, তখনই তাঁরা এ নির্বাচন নিয়ে বিচলিত হন। অর্থাৎ এ নির্বাচনকে তাঁরা কামাল ও এরদোয়ানের পরস্পর সাংঘর্ষিক দুটি আদর্শের লড়াই হিসেবে বিবেচনা করেন।

ইস্তাম্বুলের রাস্তায় ছোটবেলায় রুটি ও লেবুর শরবত বিক্রি করা এবং পরবর্তীকালে পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে ক্যারিয়ার গড়া এরদোয়ান সেই অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসকে চেতনায় রেখে রাজনীতিতে এসেছিলেন। তিনি ধীরে ধীরে ইসলামি অনুশাসনের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে থাকেন।

এরদোয়ানে ঢাকা পড়েছে কামালের আদর্শ

তুরস্কের বড় বড় শহরের ধনিক শ্রেণি পশ্চিমা জীবনযাপনে অভ্যস্ত থাকায় শহরাঞ্চলে কামাল পাশার সংস্কারমূলক আদর্শ অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় জনপ্রিয় ছিল। এ ছাড়া দেশটির সেনাবাহিনীও কামালের আদর্শে সংহত ছিল। কিন্তু ইসলামপন্থীদের হাত ধরে ধীরে ধীরে সে আদর্শ ম্লান হতে শুরু করে এবং তুর্কিদের মধ্যে অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস ও জাত্যভিমান জেগে উঠতে থাকে।

ইস্তাম্বুলের রাস্তায় ছোটবেলায় রুটি ও লেবুর শরবত বিক্রি করা এবং পরবর্তীকালে পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে ক্যারিয়ার গড়া এরদোয়ান সেই অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসকে চেতনায় রেখে রাজনীতিতে এসেছিলেন। তিনি ধীরে ধীরে ইসলামি অনুশাসনের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে থাকেন।

১৯৯৭ সালে ইস্তাম্বুলের মেয়র থাকাকালে এরদোয়ান একটি রাজনৈতিক জনসভায় তুর্কি জাতীয়তাবাদী কবি মেহমেত জিয়া গোকালপ্ -এর লেখা একটি কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। কবিতাটি ছিল এমন:

‘মসজিদ আমাদের দুর্গ
গম্বুজ আমাদের শিরস্ত্রাণ
মিনার আমাদের বেয়নেট
মুসল্লিরা আমাদের মুজাহিদ।’

এই কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি যে বিপ্লবী বার্তা দিয়েছিলেন, তা সে সময়কার সরকার ধরতে পেরেছিল। এই কবিতার বাণী তুরস্কের সেক্যুলার মূল্যবোধবিরোধী ছিল এবং সেই সময়কার আইন অনুযায়ী, ধর্মীয় অনুভূতিকে রাজনৈতিক বিষয়ে ব্যবহার অপরাধ ছিল। ফলে এই কবিতা আবৃত্তির জন্য এরদোয়ানকে মেয়রের পদ থেকে বরখাস্ত করা হয় এবং এরপর তাঁকে সেই কবিতা পাঠের অপরাধে চার মাসের জন্য জেল খাটতে হয়েছিল।

Also Read: খাপমুক্ত হচ্ছে ‘সুলতান’ এরদোয়ানের তরবারি

এরদোয়ান কি আসলেই ‘সুলতান’ হতে চান

২০২০ সালের ২৪ জুলাই ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক স্থাপনা হায়া সোফিয়াকে এরদোয়ান প্রায় ৮৬ বছর পর মসজিদ হিসেবে যেদিন উন্মুক্ত করেছিলেন, সেদিনই তিনি তাঁর চূড়ান্ত অভিপ্রায় সম্পর্কে একটি বার্তা দিয়েছিলেন। সেদিন তাঁর ধর্মমন্ত্রী ড. আলি এরবাস হায়া সোফিয়ায় উসমানীয় আমলের তরবারি হাতে খুতবা পড়েছিলেন।

এর মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বোঝাচ্ছিলেন, একসময় তাঁদের এক মহাপরাক্রমশালী সালতানাত ছিল এবং সেই হৃত মর্যাদা ফিরিয়ে আনার স্বপ্নই তাঁদের দেখতে হবে।

সবচেয়ে লক্ষণীয় ছিল, হায়া সোফিয়াকে মসজিদ হিসেবে উন্মুক্ত করতে ২৪ জুলাই তারিখটিকে বেছে নেওয়া। ওই দিনকে বেছে নেওয়া হলো, কারণ আজ থেকে ঠিক এক শ বছর আগে ১৯২৩ সালের ২৪ জুলাই তারিখে লুজান চুক্তি নামের একটি দাসখত তুর্কি জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। চলতি বছরের ২৪ জুলাই সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। ওই দিন পশ্চিমাদের সব শর্তের শিকল ছিঁড়ে যাবে।

লুজান চুক্তির মেয়াদ শেষ আগামী জুলাইয়ে

এরদোয়ান সমর্থকেরা মনে করেন, লুজান চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে চুক্তিটির নাগপাশ থেকে তুরস্ক মুক্তি পাবে। এই চুক্তিতে বলা ছিল, তুরস্ক জীবাশ্ম জ্বালানি বা খনিজ তেল উৎপাদন করতে পারবে না। না নিজের দেশে, না অন্য দেশে।

ইজিয়ান সাগর এবং কৃষ্ণ সাগরের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে যে বসফরাস প্রণালি, সেটি তুরস্কের বুকের ওপর দিয়ে গেছে। ওই প্রণালি দিয়ে এশিয়া ও ইউরোপের পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করে।

লুজান চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, এখান দিয়ে চলাচল করা জাহাজ থেকে তুরস্ক একটা কানাকড়িও টোল আদায় করতে পারে না। এই ধরনের আরও শর্ত ছিল। বাংলাদেশসহ মুসলিম অধ্যুষিত দেশের ইসলামপন্থীদের বিশ্বাস, আগামী ২৪ জুলাই সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে তুরস্ক খনিজ সম্পদ তুলতে পারবে এবং বসফরাস প্রণালি দিয়ে যাওয়া আসা করা জাহাজ থেকে কোটি কোটি ডলার টোল আদায় করতে পারবে। তখন তুরস্ক বিশ্বশক্তি হিসেবে আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে যা অটোমান সাম্রাজ্যের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

ইসলামপন্থীরা মনে করেন, পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট কিলিচদারওলু প্রেসিডেন্ট হলে কখনোই তিনি পশ্চিমাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়া এই কাজগুলো করবেন না। এটি এরদোয়ানের পক্ষেই করা সম্ভব।

সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের বাতাস

‘ইমাম হাতিপ স্কুলে’ এরদোয়ান

শুধু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারেই এরদোয়ান থেমে থাকেননি। গত ২০ বছরে তিনি আধুনিক তুরস্কের সাংস্কৃতিক চেহারাও বদলে দিয়েছেন। সরকারি অফিসে এর আগে মেয়েদের মাথায় স্কার্ফ পরে ঢোকা নিষিদ্ধ ছিল। ২০১৩ সালে তিনি আইন পরিবর্তন করে সে নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়েছেন।

তুর্কিদের মধ্য থেকে একটি ‘ধার্মিক প্রজন্ম’ তৈরি করার জন্য তিনি ‘ইমাম হাতিপ স্কুল’ নামে একটি প্রকল্প চালু করেছেন। শুরুতে এ প্রকল্পের আওতায় শুধু ইমামদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। পরে তা মাধ্যমিক স্তরের ভকেশনাল শিক্ষার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

রয়টার্সের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ প্রকল্পে এরদোয়ান কোটি কোটি ডলার বরাদ্দ দিয়েছেন। এরদোয়ান যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন তুরস্কে মসজিদের সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার। তুরস্কের রিলিজিয়াস অ্যাফেয়ার্সের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর সেই সংখ্যা ৮৯ হাজার ২৫৯টিতে এসে পৌঁছেছে।

রাকের (ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের একধরনের মদ) গ্লাস হাতে কামাল আতাতুর্কের একটি আইকনিক ছবি আছে। তার বিপরীতে এরদোয়ান নিজের অ্যালকোহল-বিরোধী ভাবমূর্তি গড়তে তুরস্কে অ্যালকোহল সেবনে কড়াকড়ি আরোপ করেছেন। অ্যালকোহলে উচ্চহারে কর বসিয়েছেন। প্রকাশ্যে অ্যালকোহল সেবন নিষিদ্ধ করেছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মসজিদের দুই শ মিটারের মধ্যে পানশালা খোলা নিষিদ্ধ করেছেন।

‘সুলতান সুলেমান’, ‘দিরিলিস: আরতুগ্রুল’ নির্মানে তিনি কেন আগ্রহী

তুর্কি নাগরিকদের মধ্যে তাঁদের ঐতিহাসিক জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগাতে এরদোয়ান অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস আশ্রিত সিনেমা ও টিভি সিরিজ নির্মাণে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন।

‘হোয়াট আ টিভি সিরিজ টেলস অ্যাবাউট এরদোয়ান’স টার্কি’ শিরোনামে ২০১৭ সালের মে মাসে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘একেপি ২০০২ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ‘রাইজ অব এম্পায়ার্স: অটোমান’, ‘সুলতান সুলেমান’, ‘দিরিলিস: আরতুগ্রুল’সহ বেশ কিছু টিভি সিরিজ তুরস্কের সবচেয়ে আকর্ষণীয় রপ্তানি পণ্য হয়ে দাঁড়ায়।

ওই লেখায় উল্লেখ করা হিসাব অনুযায়ী প্রায় দেড় শ তুর্কি টেলিভিশন সিরিজ মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার শতাধিক দেশে বিক্রি করা হয়েছে। এগুলোতে উসমানীয় খেলাফতের আমলের স্বর্ণালি সময়কে তুলে ধরা হচ্ছে। বাইরের দেশের নাগরিকেরা যখন ইস্তাম্বুলে পর্যটনে আসেন, তখন তাঁদের মধ্যে এসব টিভি সিরিজে দেখানো ঐতিহাসিক স্থানগুলো দেখার ব্যাপারে এখন বিশেষ আগ্রহ দেখা যায়।

‘সুলতান সুলেমান’সহ বেশ কিছু টিভি সিরিজ তুরস্কের সবচেয়ে আকর্ষণীয় রপ্তানি পণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে

বাইরের দুনিয়া নিয়ে এরদোয়ানের ভাবনা

তুরস্কের বিদেশনীতিতেও এরদোয়ান ব্যাপক পরিবর্তন এনেছেন। সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়ায় তাঁর হস্তক্ষেপকে ‘নব্য অটোমান’ নীতি বলে মনে করা হয়।

নাগোরনো-কারাবাখে ২০২০ সালে খ্রিষ্টান অধ্যুষিত আর্মেনিয়া ও মুসলিম অধ্যুষিত আজারবাইজানের যে যুদ্ধ হয়েছিল তাতে তুরস্ক আজারবাইজানকে সরাসরি সামরিক সহায়তা দিয়েছিল। মূলত তুর্কি ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে ওই যুদ্ধে আজারবাইজান আর্মেনিয়াকে পিছু হটিয়ে দিয়েছিল।

মুসলিম বিশ্বের অন্যদের মতো বাংলাদেশের অনেকে মনে করেন, এরদোয়ান মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক পুনরায় জাগিয়ে তুলছেন। বিশ্বের যেখানে মুসলিমরা নির্যাতনের শিকার হন, সেখানে তাদের পক্ষে এরদোয়ান লক্ষণীয়ভাবে কথা বলে থাকেন। সেই জায়গা থেকে অনেকে তাঁকে বিশ্বমানের মুসলিম নেতা বলে মনে করেন।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে এরদোয়ান

তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এমিন এরদোয়ান কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছিলেন।

মিয়ানমার থেকে গণহত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গা মুসলমানেরা পালিয়ে আসার পর সবচেয়ে বেশি সাহায্য নিয়ে তাঁদের পাশে এগিয়ে এসেছিল তুরস্ক।

 রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এমিন এরদোয়ান এবং তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেগলুত কাভাসোগলু বাংলাদেশে এসেছিলেন।

এমিন এরদোয়ান কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে ত্রাণ বিলিয়েছিলেন। এর কিছুদিন পর প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়টি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তুলেছিলেন। এ ছাড়া রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সে সময়কার কার্যত সরকার প্রধান অং সান সুচিকে সরাসরি ফোন করেছিলেন এরদোয়ান।

বলা যায় ধর্মীয় বিবেচনায় বাংলাদেশের অনেকের চোখে এরদোয়ান আর দশজন সাধারণ রাজনীতিক নন; তিনি তার বাইরের কিছু। সেই ‘বাইরের কিছু’ই তাঁকে তাঁদের কাছে ‘সুলতান’ করে তুলেছে। সে কারণেই ২৮ তারিখের দ্বিতীয় দফার ভোট নিয়ে মজনু মিয়ার মতো হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক থেকে শুরু করে, মাদ্রাসা–কলেজ– বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক–ছাত্র, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ীসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষের এত আগ্রহ।

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
    sarfuddin2003@gmail.com