Thank you for trying Sticky AMP!!

সরকারের চোখ অভিবাসীদের জানের দিকে নয়, মালের দিকে

‘যদি সরকার আন্তরিকই হতো তাহলে তো দালালদের দৌরাত্ম্য দেখতে হতো না। এত এত মানুষের সলিলসমাধিও হতো না।’

মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম ও মোহাম্মদ কাইয়ূমের কথা মনে আছে তো? ওই যে সাগরপথে অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছাতে চেয়েছিলেন, অস্ট্রেলিয়ার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ধরে নাউরুতে ফেলে এসেছে। অস্ট্রেলিয়া থেকে ওখানে পৌঁছাতে প্লেনেই সময় লাগে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। ১০ বছর আটকা থেকে শফিকুল ও কাইয়ূম মুখ সেলাই করে প্রতিবাদ করেছেন।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোয় খবর প্রকাশের আগে কি বাংলাদেশ সরকার জানত শফিকুল ও কাইয়ূম কোথায় আছেন? শতভাগ নিশ্চিত থাকতে পারেন, জানত না। তারা শুধু জানে বিশ্বের ১৬৫টি দেশে বাংলাদেশের লোকজন আছে। তারা কীভাবে গেল আর কীভাবে এই দেশগুলোয় আছে, সে খবর জেনে সরকারের কী লাভ? তার দরকার ‘ডলার’। রিজার্ভ খুশ তো সরকারও খুশ। কেস ডিসমিস।

ধারণা করি, খোঁজ করলে এমন আরও শফিকুল ও কাইয়ূমকে পাওয়া যাবে বিশ্বের নানা প্রান্তে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো এখন অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নিজেদের উপকূলে বা মাটিতে ঢুকতে দিচ্ছে না। তৃতীয় ও অপেক্ষাকৃত গরিব দেশগুলোকে সাবকন্ট্র্যাক্ট (উপঠিকাদারি) দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র উপঠিকাদারির এই চল শুরু করেছিল সেই রোনাল্ড রিগ্যানের আমলে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এই নিয়ে (https://www.hrw.org/sites/default/files/supporting_resources/jmhs.pdf) বিস্তারিত প্রতিবেদন আছে একটি।

Also Read: ভূমধ্যসাগরে ডুবছে ইউরোপীয় মানবাধিকার

ওই প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ১৯৮১ সালে মার্কিন কোস্টগার্ড হাইতি থেকে ছেড়ে আসা জলযানগুলোকে মাঝসাগর থেকে তাড়াতে শুরু করে। ঠিক আট বছর পর তারা স্থল সীমান্তে মনোযোগ দেয়। মেক্সিকোকে বলে মধ্য আমেরিকা থেকে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ঢল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

মেক্সিকোর ভেতরে ৫০০ মাইল দক্ষিণে গুয়াতেমালার সঙ্গে তাদের যে সীমান্ত, অভিবাসনপ্রত্যাশীরা সেখানে থাকবে। কবে তারা ঢুকতে পারবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ২০১১ সালে এ জন্য তারা মেক্সিকোকে আড়াই বিলিয়ন ডলারও দেয়। এই প্রক্রিয়ায় মধ্য আমেরিকার অন্য দেশগুলোকে যুক্ত করতে বারাক ওবামা ৩.৭ বিলিয়ন ডলার চান।

মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, মেক্সিকো, হাইতিতে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের আটকে দিলে বাংলাদেশের কী? অবশ্যই বাংলাদেশের চিন্তার কারণ আছে। কোভিড-১৯ এর পর থেকে মেক্সিকো অভিবাসনপ্রত্যাশীদের কাছে প্রিয় রুট হয়ে ওঠে। তাদের অনেকেরই পরে ঠিকানা হয়েছে মেক্সিকোর টাপাচুলা কারাগারে।

১০ বছর আটকে রাখার প্রতিবাদে নিজেদের মুখ সেলাই করে প্রতিবাদ মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম ও মোহাম্মদ কাইয়ুমের

এই তো বছর দুয়েক আগে ২৩০ জনকে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের চেষ্টার দায়ে আটক করা হয়। বাংলাদেশি এই তরুণেরা বৈধ কাগজপত্র নিয়ে দেশের সীমানা পার হয়েছিলেন।

এরপর কলকাতা বা দিল্লি থেকে ব্রাজিলের সাও পাওলো, সেখান থেকে পায়ে হেঁটে, নৌকায় করে বা বাসে ইকুয়েডর, কলম্বিয়া, পানামা, কোস্টারিকা, নিকারাগুয়া, এল সালভাদর, হন্ডুরাস, গুয়াতেমালা হয়ে মেক্সিকো সীমান্তে এসে ধরা পড়ে গেছেন।

বাংলাদেশিদের পাচারে যুক্ত থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের আদালত বাংলাদেশের মো. মিলন হোসেনকে ৪৬ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন।

অভিবাসীদের ঠেকানোর কায়দাকানুনে যুক্তরাষ্ট্র ওস্তাদ। অস্ট্রেলিয়াও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। নরওয়ের জাহাজ টাম্পা অস্ট্রেলীয় জলরাশির কাছে ডুবতে বসা একটা জাহাজকে উদ্ধার করে ক্রিসমাস আইল্যান্ডের কাছে নিয়ে গিয়েছিল।

অস্ট্রেলিয়ার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের সাত দিন সাগরে আটকে রাখে। পরে দেশটির সরকার ঘোষণা দেয় ক্রিসমাস আইল্যান্ডসহ অস্ট্রেলীয় জলরাশির মধ্যে কাগজপত্র ছাড়া কেউ ঢুকে পড়লেও তারা অভিবাসন চাইতে পারবে না।

Also Read: টাইটানের ধনী অভিযাত্রীরা বনাম ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির হতভাগারা

এরপর অস্ট্রেলিয়া পাপুয়া নিউগিনি, নাউরুর সঙ্গে চুক্তি করে। অবৈধভাবে অস্ট্রেলিয়ায় ঢুকলেই এখন সোজা নাউরুতে পাঠিয়ে দিচ্ছে দেশটি। সেখানকার জেলখানায় তাদের বছরের পর বছর আটকে থাকতে হচ্ছে। কমপক্ষে চারজনকে অস্ট্রেলিয়া কম্বোডিয়াতেও পাঠায়। মালয়েশিয়াতেও পাঠানোর চেষ্টা করেছিল। সেখানে অনুকূল পরিবেশ নেই, এই যুক্তিতে পরে অস্ট্রেলিয়ার আদালত অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মালয়েশিয়া পাঠানোয় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন।  

যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়ার তুলনায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটুও পিছিয়ে নেই। ডিঙি নৌকায় সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে মানুষ মরছে বলে তাঁরা মায়া কান্না কাঁদেন প্রায়ই। আদতে তাঁদের উদ্দেশ্য যুদ্ধবিধ্বস্ত বা অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশের মানুষকে ঠেকানো।

ছোট্ট একটা উদাহরণ আছে। ২০০৯ সালে সোমালিয়ার নাগরিক হিরসি জামাসহ ২৩০ জন নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালির দিকে যাচ্ছিলেন। সেখানকার জলরাশিতে পৌঁছানোর পর ইতালির কোস্টগার্ড তাঁদের লিবিয়ায় ঠেলে দেয়। পরে হিরশি জামা ও অন্যদের পক্ষে আদালতে মামলা ঠুকে দেন মানবাধিকারকর্মীরা।

২০১২ সালে ইউরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটস রায়ে বলেন, ইতালির জলসীমায় যেহেতু তারা ঢুকেই পড়েছে, কাজেই তাদের অভিবাসন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হওয়ার কথা ইতালিতে। তাদের লিবিয়ার প্রতিকূল পরিবেশে ঠেলে দেওয়াটা আইনসংগত হয়নি।

এখন তাঁদের চেষ্টা ইতালির জলরাশিতে ঢুকে পড়ার আগে নৌকা আটকে দেওয়া। এই কাজে তারা দোস্তি পাতিয়েছে লিবিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়া এসব দেশের সঙ্গে। নৌকা যাত্রী বোঝাই করছে এমন খবর পেলেই সে খবর পাচার হয়ে যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর কানে।  

যুক্তরাজ্যেও শান্তি নেই। তাদের আন্তরিক ইচ্ছা ছিল যুক্তরাজ্যে কেউ অবৈধভাবে পৌঁছালে তাঁদের রুয়ান্ডা পাঠাবে। আদালত তাতে রাজি হননি। তাই তারা এখন কঠোর অভিবাসন নীতিমালা নিয়ে হাজির হয়েছে। প্রচুর টাকার চাকরির অফার না থাকলে সপরিবার আর যুক্তরাজ্য যাওয়া যাবে না। যাঁরা শিক্ষার্থী ভিসায় যাবেন, তাঁদেরও পরিবারকে সঙ্গে নেওয়ার অনুমতি নেই।

এ কথা সত্য, বৈধ কাগজপত্র ছাড়া অভিবাসন বেআইনি। কিন্তু এ-ও সত্য, প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ অভিবাসনপ্রত্যাশী। তারা এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাবেই। সমস্যা হলো সাদা চামড়ার উন্নত দেশগুলো কিছুতেই বৈশ্বিক দক্ষিণের মানুষকে আর তাদের দেশে ঢুকতে দিতে চায় না। অভিবাসন ঠেকাতে উন্নত দেশগুলোর সরকার এখন এককাট্টা। সেই তুলনায় শক্তিশালী, নিরাপদ অভিবাসনের পক্ষে জোরালো উদ্যোগ কম।

Also Read: এত উন্নয়নের পরও কেন ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরছে আমাদের তরুণেরা

বিদেশে কোনো রকমে পৌঁছাতে পারলেই হলো, সেই দিন যে আর নেই, সে খবর কি আমাদের প্রান্তিক মানুষগুলো জানে? তারা কি জানে বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্বপরায়ণ নেতাদের দৌরাত্ম্য যত বাড়ছে, ততই অভিবাসনের সম্ভাবনা কমে আসছে?

এই তো গত জানুয়ারিতে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ ল্যাম্পেদুসায় যাওয়ার পথে হাইপারথার্মিয়া বা অতিরিক্ত ঠান্ডায় জমে ৭ বাংলাদেশির মৃত্যু হলো। ইতালির কোস্টগার্ড মরদেহ নিয়ে ভাসতে থাকা নৌকা থেকে মরদেহগুলো উদ্ধার করেছিল। তাতে কার কী এসে গেল!  

যদি সরকার আন্তরিকই হতো তাহলে তো দালালদের দৌরাত্ম্য দেখতে হতো না। এত এত মানুষের সলিলসমাধির পর মাত্র গতকাল রোববার আমরা প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীনকে বলতে শুনলাম, অনিয়মিত উপায়ে অভিবাসনের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। সমস্যা সমাধানে সমন্বিত কাজ করা হবে।

তা এত দিন ধরে সরকার কী করছিল? সেই জবাব কবে পাওয়া যাবে? আর আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন আরও এক কাঠি সরেস। তিনি বলেছিলেন, গুম হওয়া লোকজন ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা গিয়ে থাকতে পারে।

বাংলাদেশের ফিরতি টিকিট কিনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও মেক্সিকোয় আটক তরুণেরা বলেছিলেন, তাঁরা প্রয়োজনে মরে যাবেন, তবু দেশে ফিরবেন না। দেশ ছাড়ার এমন মরিয়া চেষ্টা কেন? কেন এই দেশটা তরুণদের দেশের ভেতরে ভালো কাজের সুযোগ করে দিতে পারে না? আসলেই কি বাংলাদেশ আমাদের তরুণদের জানের প্রতি যত্নশীল? না তাদের মালটুকুই আরাধ্য?

  • শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক। ই–মেইল: sabiha.alam@prothomalo.com