টাইটানের ধনী অভিযাত্রীরা বনাম ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির হতভাগারা

টাইটান আর ভূমধ্যসাগরে ডুবে যাওয়া নাম না জানা সেই মাছ ধরার ট্রলার

‘মৃত্যুরে বন্ধুর মতো ডেকেছি—প্রিয়ার মতন!
চকিত শিশুর মতো তার কোলে লুকায়েছি মুখ’

কবি জীবনানন্দের মতো বলতেই হচ্ছে, মৃত্যুকে বন্ধুর মতো ডেকে নিয়েছেন, প্রিয়ার মতো আলিঙ্গন করে নিয়েছেন টাইটানের আরোহীরা, যাঁদের বলা হচ্ছে অসীম সাহসী অভিযাত্রী।

টাইটান—এই কদিনে গোটা বিশ্বের মানুষের কাছে ছড়িয়ে যাওয়া একটি নাম। একটি ডুবোজাহাজ। ডুবোজাহাজ বলতে আমরা বুঝি সাবমেরিন। টাইটানকে যদিও পুরোপুরি সাবমেরিন বলা যায় না। এটি মূলত সাবমার্সিবল। সাবমেরিনকে তার ভেতর থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা যায় আর সাবমার্সিবলকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় বাইরে থেকে।

যা–ই হোক, টাইটান নামের সেই ডুবোজাহাজে করে পাঁচ আরোহী গিয়েছিলেন সাগরের তলদেশে। উদ্দেশ্য, টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখা। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, টাইটানিকের মতোই একই পরিণতি হয়েছে টাইটানেরও। মানে সলিলসমাধি। সমুদ্রের কোলে মুখ লুকিয়ে আজীবন সেখানেই ঘুমিয়ে গেলেন টাইটানের অভিযাত্রীরা।

টাইটানিক—পৃথিবীর জলযান ইতিহাসের স্মরণীয় এক ট্র্যাজেডির নাম। শত বছর আগে সেই ট্র্যাজেডি এখনো মানুষের মধ্যে কী কৌতূহল তৈরি করে রেখেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

অতিকায় সেই জাহাজের প্রথম ও শেষ অভিযান এখন এক পুরোনো রূপকথা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেই গল্প শুনে যাবে মানুষ। কিন্তু কিছু মানুষ শুধু শুনে যেতে রাজি ছিলেন না, দেখার সংকল্পও করেছিলেন। সাগরের তলদেশে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ নিজ চোখে দেখার কিংবা স্পর্শ করার তীব্র আগ্রহ লালন করেছিলেন ভেতরে।

অনেকের মনে হতে পারে, এ যেন সেই প্রতিধ্বনি—‘পাতাল ফেড়ে নামব নীচে, ওঠব আবার আকাশ ফুঁড়ে’। সেই তুমুল আকাঙ্ক্ষা থেকেই টাইটানে চড়ে বসেছিলেন সমুদ্রের তলদেশে সাড়ে ১২ হাজার ফুট বা ৩ দশমিক ৮১ কিলোমিটার নিচে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের কাছে যেতে।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক সাবমেরিন কোম্পানি ওশানগেটের ডুবোযান এ টাইটান। সে কোম্পানিই মানুষকে টাইটানিকের কাছে নিয়ে যাওয়ার এই বিলাসবহুল ভ্রমণ-প্যাকেজ ছাড়ে। আমাজনের মালিক জেফ বেজোস মহাকাশের ভ্রমণ-বাণিজ্য শুরু করেছেন আর ওশানগেটের মালিক স্টকটন রাশ সেই স্বপ্ন দেখেছিলেন মহাসাগরের তলদেশে। টাইটানের নিরাপত্তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠলেও সেসবকে তোয়াক্কা করেননি তিনি। অ্যাডভেঞ্চারের নেশা তাঁকে পেয়ে বসেছিল।

নিঃসন্দেহে এমন স্বপ্নবাজ মানুষের দুঃসাহসী অভিযানের কারণে মহাকাশ গবেষণা থেকে শুরু করে পৃথিবীর বিজ্ঞান, তথ্য–প্রযুক্তি ও আবিষ্কারের অনেক পথই খুলে যায়।

এ মহাকাশ বা মহাসাগরে ভ্রমণ নিশ্চয়ই শুধু অভিযান নয়, শখপূরণও। তবে এ শখের তোলা আশি টাকা নয়, আড়াই লাখ মার্কিন ডলার, মানে আড়াই কোটি টাকার বেশি। টাইটানের আরোহীদের একেকজনকে এ টাকা খরচ করতে হয়েছে। সেখানে ছিলেন টাইটানের স্বপ্নদ্রষ্টা বা মালিক স্টকটন রাশও। কিন্তু মাত্র চার দিনের ব্যয়বহুল এ ভ্রমণযাত্রা শুরুর পৌনে দুই ঘণ্টার পরপরই পথ হারিয়ে ফেলে। গ্রিক পুরানের টাইটান যোদ্ধাদের মতো পাতালে বন্দী হয়ে যাওয়া যেন। সেটিকে মুক্ত করতে সাগর সেচতে নেমে পড়ে বড় বড় দেশ।

পৃথিবীজুড়ে কোটি কোটি মানুষ অপেক্ষায় থাকে টাইটানের হৃৎস্পন্দন শুনতে। ডুবোজাহাজের বুকভর্তি ছিল চার দিনের বাতাস।  ফলে এই কদিনেও সেটির খোঁজ না পাওয়ায় সবাই একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে যায়, ধনকুবের অভিযাত্রীদের ফেরার আর আশা নেই। অবশেষে খোঁজ পাওয়া গেল টাইটানের। টাইটানিকের মতোই টুকরা হয়ে তার আশপাশে পড়ে আছে টাইটান।  

টাইটানের আরোহীদের সাহসিকতা এবং তাঁদের মৃত্যুকে যেভাবে মাহাত্ম্য আকারে আমাদের সামনে হাজির করা হলো, সেটা আমরা নিখোঁজ অভিবাসীদের বেলায় দেখি না। হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, ‘গরিবেরা সাধারণত সুন্দর হয় না/ গরিবদের কথা মনে হ’লে সৌন্দর্যের কথা মনে পড়ে না কখনো।’ এসব হতভাগা অভিবাসীর মৃত্যুও সুন্দর বলে গণ্য হয় না, তাঁদের অভিযানে কোনো সৌন্দর্য নেই, যা টাইটানের অভিযাত্রীদের বেলায় সত্য হয়ে ওঠে।

২.

জীবনানন্দই বলেছিলেন, ‘কোথায় রয়েছে মৃত্যু? কোনদিকে? খুঁজি আমি তারে।’ টাইটানের ধনকুবের যাত্রীরা যেন কোটি টাকা খরচ করে মৃত্যুকেই খুঁজে নিলেন।

যাত্রা থেকে শুরু করে হারিয়ে যাওয়া, ধ্বংসাবশেষ শনাক্ত করা এবং এরপর পর্যন্ত বিশ্ব মিডিয়ার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এখন টাইটান। এ নিয়ে আরও কিছুদিন হয়তো নানা জল্পনাকল্পনা থাকবে। টাইটানের জন্য পৃথিবীবাসীর প্রার্থনার রেশও হয়তো থেকে যাবে আরও কিছুদিন। টাইটানের আদ্যোপান্ত সবকিছু মুখস্থ হয়ে যাবে কোটি কোটি মানুষের কিন্তু গত সপ্তাহে ভূমধ্যসাগরে ডুবে যাওয়া মাছ ধরার ট্রলারটির নামও কেউ জানবে না। কারণ, সেটির নাম বিশ্বের কোনো মিডিয়া এখন পর্যন্ত জানাতে পারেনি। সেই মাছ ধরার ট্রলারটির সঙ্গে ডুবে যাওয়া নিখোঁজ অভিবাসীদের জন্যও এভাবে আকুল প্রার্থনা আমরা দেখব না, বলতে হয়, দেখিইনি। 

একই সপ্তাহে দুটি নৌযানের সলিলসমাধি ঘটল। একটিতে আরোহী ছিল পাঁচজন। যাঁরা ছিলেন ধনকুবের। আর ধনী-গরিবের বৈষম্যের এ পৃথিবীতে জীবনের মূল্য কাদের বেশি, সেটি নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।

আর মাছ ধরার ট্রলারটিতে আরোহী ছিলেন ৭৫০ জন। যাঁদের অর্ধেকের বেশি পাকিস্তানি। বাকিরা সিরীয়, লিবীয় ও উত্তর আফ্রিকার। হতভাগা এসব মানুষ গরিব ও অসহায়। দেশে সর্বস্বান্ত হয়ে ধারকর্জ করে বা নিজের শেষ অবলম্বনটুকু বিক্রি করে দালালের হাতে নিজেদের তুলে দিয়েছিলেন। যেকোনো মুহূর্তে মৃত্যু হতে পারে জেনেও অকূল সমুদ্র পাড়ি দিতে ঠাসাঠাসি করে ওঠে গিয়েছিলেন চোখ বন্ধ করে। গৃহযুদ্ধ, অর্থনৈতিক সংকট বা রাষ্ট্র ও সরকারের ফাঁপা বুলির কাছে পরাজিত সৈনিক তাঁরা। শুধু একটিই আশা—সাগর পার হতে পারলেই নতুন জীবনের হাতছানি। সেই জীবনের সন্ধান আর মেলে না। অভিবাসীদের এ নিয়তি আমাদের অচেনা বা অজানা নয়।

কাকতালীয় ব্যাপার হচ্ছে, দুই নৌযানে আরোহীদের মধ্যেই ছিলেন পাকিস্তানি নাগরিক। টাইটানের দুই জন আরোহী—শাহজাদা দাউদ ও তাঁর ছেলে ১৯ বছর বয়সী ছেলে সুলেমান দাউদ। তাঁরা পাকিস্তানের প্রভাবশালী দাউদ পরিবারের সদস্য। এ পরিবারের রয়েছে বিশাল শিল্পগোষ্ঠী। শাহজাদা দাউদও বিশাল কোম্পানি চালান। পাকিস্তানে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ সে কোম্পানির। আর ভূমধ্যসাগরে ডুবে যাওয়া নৌযানটির আরোহী পাকিস্তানিদের সম্পর্কে তো একটুই আগেই ধারনা দেওয়া হলো।

সাম্প্রতিক সময়ে ভূমধ্যসাগরে অভিবাসী বোঝাই সবচেয়ে বড় নৌকাডুবির ঘটনা। অথচ এক সপ্তাহ ধরে নিখোঁজ সেসব মানুষের সন্ধানে সর্বশক্তি নিয়োগ হতে আমরা দেখি না। টাইটানকে হন্য হয়ে খুঁজতে অভিযানে নেমে ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার কোস্টগার্ড, ফ্রান্সের একটি উদ্ধার টিম, পেন্টাগন, অনেকগুলো প্রাইভেট অত্যাধুনিক নৌযান। সমুদ্রের তলদেশ ঘেঁটে ফেলেছিল তারা। মাত্র পাঁচজনকে জীবিত ফেরাতে কত আয়োজন।

কিন্তু নাম না জানা সেই মাছ ধরার ট্রলারের বেলায় আমরা তার ন্যূনতম প্রচেষ্টাও দেখি না। সাড়ে সাত শ মানুষের প্রাণ এখানে মূল্যহীন। অথচ সেই ট্রলারের আশপাশে অনেক জাহাজ ছিল, গ্রিস বা ইতালির কোস্টগার্ডের নজরেও ছিল সেটি। অভিযোগ উঠছে, অভিবাসীদের বাঁচাতে সেই প্রচেষ্টাটুকু তখন দেখা যায়নি।

এখন টাইটানের আরোহীরা যেভাবে অভিযাত্রী বলে আখ্যায়িত হচ্ছেন, সেটি এসব অভিবাসীর কপালে জুটছে না, জুটবেও না। টাইটানের জন্য প্রার্থনা—লিখে যেভাবে গোটা পৃথিবীর মানুষ আকুল হয়েছিল, সেই আকুলতাও আমরা দেখি না এই অভিবাসীদের বেলায়। হয়তো অনেকে জানেনই না সেই নৌকাডুবির ঘটনা। কারণ, নিরাপত্তা সুরক্ষিত করে বানানো টাইটানের মতো বিশ্ব মিডিয়ায় মনোযোগ পায়নি ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিরাপদ ট্রলারটি। প্রতি মিনিটে মিনিটে সেটির খবর প্রচারিত হয়নি।

টাইটানের আরোহীদের সাহসিকতা এবং তাঁদের মৃত্যুকে যেভাবে মাহাত্ম্য আকারে আমাদের সামনে হাজির করা হলো, সেটা আমরা নিখোঁজ অভিবাসীদের বেলায় দেখি না। হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, ‘গরিবেরা সাধারণত সুন্দর হয় না/ গরিবদের কথা মনে হ’লে সৌন্দর্যের কথা মনে পড়ে না কখনো।’ এসব হতভাগা অভিবাসীর মৃত্যুও সুন্দর বলে গণ্য হয় না, তাঁদের অভিযানে কোনো সৌন্দর্য নেই। সেসব বরং টাইটানের অভিযাত্রীদের বেলায় সত্য হয়ে ওঠে। তাঁদের জন্য আমাদের অত আবেগ উছলে ওঠে না। গায়েব হয়ে যায় মানবিকতাও।

ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের রঙিন দুনিয়ার প্রবেশ করতে গিয়ে ২০১৪ সাল থেকে ২৫ হাজার অভিবাসী ডুবে গিয়েছেন। শুধু ২০২২ সালেই সে সংখ্যা বারো শর বেশি। টাইটানের আরোহীদের নাম অনেকের মুখস্থ হয়ে গেলেও সেসব অভিবাসী আমাদের কাছে সংখ্যামাত্র।

গত কয়েক বছরে ভূমধ্যসাগরে এটিই সম্ভবত বড় কোনো নৌকাডুবির ঘটনা, যেখানে এখন পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশির মৃত্যু বা নিখোঁজের খবর আসেনি। গত বৃহস্পতিবারও ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে স্পিডবোট ডুবে নিহত এক বাংলাদেশির লাশ উদ্ধারের খবর এসেছে। যার বাড়ি নরসিংদী। এরপর জানা যাচ্ছে, সেই ঘটনায় নরসিংদীর আরও ১৩ তরুণ নিখোঁজ। নরসিংদী ছাড়াও নোয়াখালী, মাদারীপুর, শরিয়তপুরসহ দেশের আরও জেলা–উপজেলার তরুণদের ভীড় বাড়ছে ভূমধ্যসাগরের লিবিয়া উপকূলে।

এক দেশে এত এত উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ঝলকানিতে প্রতিবছর কেন অসংখ্য তরুণ ভূমধ্যসাগরে ঠান্ডায় জমে মারা যান, সেই প্রশ্নই ঘুরেফিরে আসে। লিবিয়ার কারাগার আর মানব পাচারকারীদের আস্তানায় বন্দী শত শত তরুণের আহাজারি আমাদের কানে এসে পৌঁছে না।

এ দেশের সব কটি সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জুড়ে ছিল টাইটান ও এর আরোহীরা। আমাদের তরুণদের ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে বা সমুদ্রে ঠান্ডায় মরার সংবাদও অতটা গুরুত্ব পায় না। রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতো বলতেই হয়—আমাদের অধিকাংশ মানুষ ক্ষুধা, অকালমৃত্যু আর দীর্ঘশ্বাসের সমুদ্রে ডুবে আছে। ভূমধ্যসাগর তো সেই দীর্ঘশ্বাসের সমুদ্র।

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী