Thank you for trying Sticky AMP!!

ওপেনহেইমারের দুঃস্বপ্ন কি সত্যি হবে

পরমাণু বোমার জনক রবার্ট ওপেনহেইমারকে নিয়ে বানানো সিনেমা ওপেনহেইমার

ক্রিস্টোফার নোলান ওপেনহেইমার নামে যে ছবি বানিয়েছেন, তার শেষে আণবিক বোমার স্রষ্টা ওপেনহেইমার বলেন, চেইন রিঅ্যাকশন বা শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রতিক্রিয়ার বিপদ হচ্ছে—‘এটা পুরো পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেবে’। জাপানের ওপর সত্যিকারের আণবিক বোমা পড়ার পর সত্যি সত্যি এই শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। এখন পৃথিবী ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে গেছে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।

তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে মরিয়া হয়ে ওঠা দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়ার মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল, সেটাই বাঁচোয়া। একেবারে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত দুই দেশের নিউক্লিয়ার রিস্ক রিডাকশন সেন্টারের মধ্যে একটা যোগাযোগ ছিল। প্রতি দুই ঘণ্টায় তারা একে অপরের খোঁজ নিত। ২০২২ সালেও তাদের মধ্যে এ রকম দুই হাজার নোটিফিকেশনের আদান-প্রদান হয়েছে। কিন্তু এ বছর মার্চের পর থেকে এ তথ্যের আদান-প্রদান বন্ধ যায়। প্রতি ছয় মাসে তারা যে তাদের ওয়্যারহেড সম্পর্কে একে অপরকে জানাত, সেটাও এখন আর জানাচ্ছে না। এ ছাড়া তারা একে অপরের দেশে গিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করত। সেই আসা-যাওয়াও বন্ধ।

Also Read: ইলন মাস্ক পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি কমাননি, বাড়িয়েছেন

পৃথিবী এখন নতুন ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় যত সহজে বিপদ এড়ানো গেছে, এখন বিষয়টা আর তত সহজ নেই। কারণ, আগেকার দুটো পরাশক্তির সঙ্গে চীন যুক্ত হয়ে এখন তিনটি পরাশক্তি হয়েছে। আগে ঠান্ডা যুদ্ধ চললেও আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এ ক্ষেত্রে অনেক সংযত আচরণ করেছে। ১৯৮৬ সালে যে ওয়্যারহেডের সংখ্যা ছিল ৭০ হাজার ৪০০, সেই সংখ্যা তারা ১২ হাজার ৫০০-তে নামিয়ে এনেছে।

কিন্তু অন্তত চারটি কারণে এ ধারা আর অব্যাহত থাকবে না। প্রথমত, আমেরিকা এখন আর চুক্তি মানছে না। দ্বিতীয়ত, রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করেছে। তৃতীয়ত, চিনের উত্থান এবং চতুর্থত, প্রযুক্তির অস্বাভাবিক উন্নতি। ২০০২ সালে উত্তর কোরিয়া ও ইরান আক্রমণ করতে পারে এই ভয়ে জর্জ ডব্লিউ বুশ অ্যান্টিব্যালিস্টিক মিসাইল চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসেন। একইভাবে ২০১৯ সালে রাশিয়ার প্রতারণা ও চীনের উত্থানের কথা উল্লেখ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প মধ্যমমাত্রার পারমাণবিক শক্তি চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসেন।

Also Read: পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি পুতিনের, বাইডেন কী করবেন

ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্টরা পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে বেশি আন্তরিক। ২০১১ সালে বারাক ওবামার ‘নবযাত্রা’ নামের নতুন চুক্তির বাস্তবায়ন শুরু হয়, যেটা পরে ২০২১ সালে বাইডেন নবায়ন করেন। এই চুক্তি অনুযায়ী ‘কৌশলগত’ পারমাণবিক অস্ত্রের (উচ্চ মাত্রায় ধ্বংস করার ক্ষমতাসম্পন্ন দূরপাল্লার অস্ত্র) সংখ্যা সীমিত হয়েছে। এই একই চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া ১ হাজার ৫৫০টি ওয়্যারহেড এবং ৭০০টি আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইল এবং সাবমেরিন থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ব্যালিস্টিক মিসাইল রাখতে পারবে।

কিন্তু ‘নবযাত্রা’য় সেই সব ‘নন-স্ট্র্যাটেজিক’ ও ‘ট্যাকটিক্যাল’ সমরাস্ত্রের কথা নেই, যেগুলো সাধারণভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। এ ধরনের সমরাস্ত্র রাশিয়ার আছে ১ হাজার ৮০০টি আর যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র ২০০টি। এ ছাড়া রাশিয়ার পারমাণবিক ক্রুজ মিসাইল ও টর্পেডো এবং ব্রিটেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের অন্য মিত্রদের কাছে যে ২০০ ওয়্যারহেড আছে, সেগুলো এই নবযাত্রায় অন্তর্ভুক্ত নয়। ২০২৬ সালের পর এই নবযাত্রার অস্তিত্বও লুপ্ত হবে, অর্থাৎ তারপর পৃথিবীর পারমাণবিক স্টকপাইল নিয়ন্ত্রণ করার মতো আর কোনো চুক্তি থাকবে না।

সেই সময় যে যুক্তরাষ্ট্রই রাজত্ব করবে, সেটা বোঝানোর জন্য সে এখনই তার দাঁত দেখানো শুরু করেছে। তার যেসব ব্যালিস্টিক মিসাইল সাবমেরিনগুলো পানির নিচে এত দিন চোখের আড়ালে থাকত, সেগুলোকে বিভিন্ন জায়গায় ভেসে উঠতে দেখা যাচ্ছে। যেমন গত জুলাইতে ইউএসএস কেন্টাকিকে দেখা গেছে দক্ষিণ কোরিয়ায়, ইউএসএস টেনেসিকে দেখা গেছে স্কটল্যান্ডে এবং ইউএসএস মেইনকে দেখা গেছে আমেরিকার গুয়ামে। আর গত অক্টোবরে ইরানকে ভয় দেখানোর জন্য ইউএসএস ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া একবার আরব সাগরে মাথা তুলে তার নিজের চেহারা দেখিয়ে দিয়েছিল।

যাহোক, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে চীন। পেন্টাগনের হিসাব অনুযায়ী ২০৩৫ সালের মধ্যে চীনের ওয়্যারহেডের সংখ্যা ১ হাজার ৫০০ ছাড়িয়ে যাবে। এতে যে ভারত শঙ্কিত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তার যে আনুমানিক ১৬০টি ওয়্যারহেড আছে, সে তা বাড়াবার চেষ্টা করবে। তার প্রভাব পড়বে পাকিস্তানের ওপর। সে-ও পাল্লা দিয়ে তার ওয়্যারহেড বাড়াবে। উত্তর কোরিয়াও তার আনুমানিক ৩০টি ওয়্যারহেড নিয়ে বসে থাকবে না। এসব দেখেশুনে ইরান কি আর চুপ থাকবে?

Also Read: বিশ্বমন্দা কি পুতিনের পারমাণবিক হামলার আশঙ্কা কমাচ্ছে?

এটাই হচ্ছে ওপেনহেইমারের সেই শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রতিক্রিয়া। আগামী দুই বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়্যারহেডের সংখ্যা যে ৩ হাজার ৫৭০-এ উন্নীত হবে বলে শোনা যাচ্ছে, তা যদি সত্যি হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই এই শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রতিক্রিয়া আরও ভয়ংকর হয়ে উঠবে।

পারমাণবিক অস্ত্রের রাশ টেনে ধরার জন্য নতুন কোনো চুক্তির সম্ভাবনাও এখন ক্ষীণ। কারণ, আগে চুক্তি হতো কেবল যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে। আর এখন চুক্তি করতে হলে একাধিক দেশকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। উপরন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মতে, এতে চীন ঠিকভাবে সাড়া দেবে না। এ বিষয়ে বাইডেনের নিরাপত্তা পরামর্শক জ্যাক সুলিভান বলেন, ‘আপনি যদি গাড়িতে সিটবেল্ট পরেন, তাহলে আপনি খুব জোরে পাগলের মতো গাড়ি চালাতে প্ররোচিত হবেন এবং একসময় একটা দুর্ঘটনা ঘটবে। ফলে সিটবেল্ট না বাঁধাই শ্রেয়।’

সিনেমায় ওপেনহেইমারকে বলা হয়েছে, তিনি মানুষকে ‘আত্মধ্বংসী হওয়ার ক্ষমতা প্রদান’ করেছেন। সত্যিই তা-ই। এখন কথা হচ্ছে, ওপেনহাইমারের সেই ‘শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রতিক্রিয়া’ ভেদ করে নতুন পারমাণবিক দুঃস্বপ্নগুলো থেকে মুক্ত হওয়ার শক্তি মানুষের এখনো অবশিষ্ট আছে কি না!

  • সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক
    ( তথ্যসূত্র দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকার প্রবন্ধ)