Thank you for trying Sticky AMP!!

মূল্যস্ফীতি: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধই শুধু দায়ী নয়

বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে রয়েছে। চলমান অর্থনৈতিক ঘাটতির ফলে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। মূল্যস্ফীতির তুলনামূলক চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এক বছর ধরেই মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য সরকার আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, বেশ কিছুদিন ধরে বিশ্ববাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমলেও এর প্রভাব বাংলাদেশের বাজারে পড়ছে না।

পত্রপত্রিকার খরব অনুযায়ী, দেশে মে মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ, যা ১১ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এ তথ্য জানিয়েছে। এর আগে ২০১২ সালের মার্চে ১০ দশমিক ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। এরপর আর কখনো ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের মূল্য প্রকাশের এ সূচক দুই অঙ্কের ঘরে যায়নি। পরের মাসেই মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশে নেমে আসে।

নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ভোগ্যপণ্য তালিকা বিশ্লেষণের মাধ্যমে অনেকে মূল্যস্ফীতির অঙ্ক ন্যূনতম ১৫ শতাংশের ওপরে বলছেন। গত বছর একই সময়ে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। তিন মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির ধারায় রয়েছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত—উভয় ক্ষেত্রের মূল্যস্ফীতিই এ সামগ্রিক বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে।

মূল্যস্ফীতি এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এর সঙ্গে বেকারত্ব তৈরির ফলে স্ট্যাগফ্লেশন (একদিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, অন্যদিকে ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস) অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, যা অর্থনীতির জন্য আরও বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে

প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সরকার গড়ে ৬ শতাংশে মূল্যস্ফীতি ধরে রাখার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজেটে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেই উল্লেখ করে এটিকে বাজেটের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হিসেবে দেখছে গবেষণা সংস্থাগুলো। চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। সরকার অবশ্যই মূল্যস্ফীতি নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারেনি।

সব মিলিয়ে মূল্যস্ফীতির এ প্রতিবেদন বেশ হতাশাজনক। এভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়ার ক্ষেত্রে অনেক সম্ভাব্য কারণ থাকতে পারে। ডাল, চিনি, তেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভোগ্যপণ্যের মজুত সীমিত পরিমাণে রয়েছে। এর সঙ্গে ডলার–সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে। সম্প্রতি আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর পেঁয়াজের দাম কমে আসে। যা বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার ইঙ্গিত দেয়। মূল্যস্ফীতির কারণ হিসেবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করা প্রকৃত অর্থে যৌক্তিক নয়। অনেকে বিশ্বাসযোগ্যভাবেই দেখিয়েছেন যে মূলত মূল্যস্ফীতির জন্য অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনাই দায়ী। যুদ্ধের অভিঘাতের মধ্যেই বাংলাদেশের সমপর্যায়ের দেশ কিংবা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক দেশই অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সফলভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে।

Also Read: অর্থনীতির মূল্যস্ফীতি বনাম মন্ত্রীদের শব্দস্ফীতি

থাইল্যান্ডে মূল্যস্ফীতি গত বছরের জুনের ৭ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে এ বছর এপ্রিলে ২ দশমিক ৭ শতাংশে নেমেছে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ৯ দশমিক ১ শতাংশ থেকে ৪ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। এমনকি ভিয়েতনামের মূল্যস্ফীতিও ২ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে নেমে এসেছে। এ দেশগুলোর উদাহরণ থেকে আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে করণীয় ঠিক করা যেতে পারে।

এ ক্ষেত্রে সঠিক পথে দেশের অর্থনীতি পরিচালিত হচ্ছে কি না, সেটি নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে প্রস্তাবিত বাজেটের কিছু পদক্ষেপ আগামী দিনে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়িয়ে দিতে পারে—এমন শঙ্কাও তৈরি হয়েছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি, খাদ্যপণ্য ও সারের মূল্য কমার প্রভাব দেশের বাজারে পরিলক্ষিত হচ্ছে না, যা দুঃখজনক।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য জ্বালানির মূল্য সমন্বয় ও খাদ্য সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আগামী দিনে সরকারি উদ্যোগের প্রয়োজন হবে সন্দেহ নেই। বছরের শেষ দিকে কৃষিতে ভালো ফলনের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে এ আশা করা হচ্ছে, কিন্তু কৃষি উৎপাদন ব্যয় যদি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, তাহলে এ ক্ষেত্রে প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠবে।

সব মিলিয়ে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেশের অর্থনীতিতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ওপর এ সংকট ব্যাপক চাপ তৈরি করেছে। মূল্যস্ফীতির প্রভাবে সমাজের এক শ্রেণির মানুষ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি আরেক শ্রেণি লাভ, এমনকি অতিলাভ করতে পারে। তবে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিস্থিতি লাঘবে তৎপর হলে তা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনাও সম্ভব।

মূল্যস্ফীতি এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এর সঙ্গে বেকারত্ব তৈরির ফলে স্ট্যাগফ্লেশন (একদিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, অন্যদিকে ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস) অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, যা অর্থনীতির জন্য আরও বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। কর্মসংস্থানের ঘাটতি দেখা দিলে এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। তাই মূল্যস্ফীতির ধকল থেকে সবকিছু সামলে নিতে এখনই সময়োপযোগী ও ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বাজারব্যবস্থার অনিয়ম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ভারতেও মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমে আসায় দেশটিতে আবারও কমতে শুরু করেছে মূল্যস্ফীতি।

এরই ধারাবাহিকতায় গত মে মাসে মূল্যস্ফীতির হার কমে ২ বছরে সর্বনিম্ন হয়েছে। সেই সঙ্গে গত মাসে ভারতের শিল্পোৎপাদনও বেড়েছে। মে মাসে ভারতে অনেক পণ্যই, যেমন পরিশোধিত তেল, আটা, গম, এলপিজি ও কেরোসিনের দাম কমেছে। যে ১০টি পণ্যের দাম কমেছে, তার মধ্যে ৯টি পণ্যই খাদ্য ও তেলসংক্রান্ত, আরেকটি যোগাযোগ ও যাতায়াতসংশ্লিষ্ট।

সম্প্রতি ঘোষিত ভারতের মুদ্রানীতিতে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার অপরিবর্তিত রেখেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর মূল্যস্ফীতির হার হ্রাসের প্রসঙ্গ উল্লেখ করলেও সতর্কতা হিসেবে মূল্যস্ফীতির দিকে সব সময় নজর রাখতে হবে বলেছিলেন। এ ছাড়া আবহাওয়ার দিকেও নজর রাখতে হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা।

Also Read: মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার কি কোনো উপায় নেই

আবহাওয়ার চক্রে এ বছর এল নিনোর সময়, অর্থাৎ খরা হতে পারে। সে কারণে দক্ষিণ–পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর দিকে বিশেষ নজর রাখাও দরকার বলে তাঁরা মনে করেন। ভারতের অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, সময়মতো শস্য বিতরণ খুবই জরুরি। বিতরণ ঠিকঠাক হচ্ছে কি না, তা দেখেই বোঝা যায়, ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতির গতি কোন দিকে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের কথা বাদই দিলাম। থাইল্যান্ড আর ভারতের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বৃদ্ধির কার্যকারিতায় আমাদেরও সুদহার বৃদ্ধি বিবেচনাসহ কার্যকর বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং অভ্যন্তরীণ সুশাসনের ওপর নজর দিতে হবে। তবে অর্থনীতি পাঠের মূল তত্ত্বানুসারে সামগ্রিক জবাবদিহি নিশ্চিত না করে বাজার নিয়ন্ত্রণও সুকঠিন বৈকি।

  • মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক