মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার কি কোনো উপায় নেই

সাধারণ মানুষের এখন ত্রিশঙ্কু অবস্থা। ব্যবসায় মন্দার কারণে চাকরি ও আয়ের সুযোগ কমেছে। সঞ্চয়ের সুদের হার কমায় এখন তহবিল ভাঙতে হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির কারণে আপস করতে হচ্ছে পুষ্টিতে—মাছ, মাংস, ডিম উধাও হয়েছে সাধারণ মানুষের খাদ্যতালিকা থেকে।

সরকার অর্থায়িত গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে গত চার বছরে ধনী-গরিব সবার আয় বাড়লেও সে তুলনায় আয় বাড়ার হার সবচেয়ে কম নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির। তবে সব শ্রেণির মানুষেরই খরচ বেড়েছে এবং আয়বৈষম্যও বেড়েছে।

ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ২ হাজার ৪৬টি খানা বা বাড়ির ওপর জরিপ করে গবেষণাটি সম্প্রতি প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। মধ্যবিত্ত, যারা নির্দিষ্ট আয়, বেতনের ওপর নির্ভরশীল, তারা মূল্যস্ফীতির ভয়াবহ চাপে পড়েছে। সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে, কিন্তু তাদের আয় সেভাবে বাড়েনি। খোদ রাজধানী ঢাকায় নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ১১ দশমিক ৩৪ শতাংশ মানুষ।

মূল্যস্ফীতি কেন

সরকারের নীতিনির্ধারকদের ভাষ্য হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি আমদানি করা, এ জন্য দায়ী কোভিড ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। একই সুরে কথা বলছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।

তাঁর মতে, এটা স্থানীয় পর্যায়ে সৃষ্টি হওয়া মূল্যস্ফীতি নয়। সরকারের সাবেক এই অর্থসচিব তাঁর আগের অবস্থান থেকেই কথা বলছেন মনে হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নয়। তাঁদের এ যুক্তির অসারতা প্রমাণের জন্য দুটি প্রমাণই যথেষ্ট। যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক বিদেশনির্ভরতার সূচক হচ্ছে ‘ট্রেড ওপেননেস রেশিও’ বা উন্মুক্ত বৈদেশিক বাণিজ্য অনুপাত।

এটি হিসাব করা সহজ, আমদানি ও রপ্তানি মূল্যের যোগফলকে মোট দেশজ উৎপাদনকে ভাগ করলেই উন্মুক্ত বৈদেশিক বাণিজ্য অনুপাত পাওয়া যায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২০২১ সালে এ অনুপাত ছিল ২৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। তুলনামূলকভাবে, একই সময়ে এ অনুপাতের বৈশ্বিক গড় (১৬০টি দেশের) ছিল ৮৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। প্রতিবেশী দেশ ভারত, মিয়ানমার, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার উন্মুক্ত বৈদেশিক বাণিজ্য অনুপাত ছিল যথাক্রমে ৪৫, ৫৩, ৪৪, ৪১ শতাংশ। অর্থাৎ, বাংলাদেশের অর্থনীতি সবচেয়ে কম উন্মুক্ত। তাই বাংলাদেশে বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রভাব তুলনামূলকভাবে কম হওয়ার কথা।

মূল্যস্ফীতির কারণ অনুসন্ধানের জন্য কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী কলকাতার মূল্য তুলনা করা যায়; সয়াবিন তেল প্রতি লিটার টাকা ২০০ (রুপি ১১৫), চিনি প্রতি কেজি টাকা ১৩৫ (রুপি ৫০), ডিম প্রতি ডজন ১৪০ (রুপি ১০০), আলু প্রতি কেজি টাকা ৪০ (রুপি ২০), পেঁয়াজ টাকা ৮০ (রুপি ২০), কাঁচা পেঁপে টাকা ৮০ (রুপি ২০), বরবটি টাকা ৮০ (রুপি ২৫)। সব পণ্যেরই ঢাকায় মূল্য বেশি। উৎপাদনে ঘাটতির কারণে এটা হতে পারে, কিন্তু বাজারে পণ্যের সরবরাহ দেখে তা মনে হয় না।

আরও পড়ুন

ওপরে দুই ধরনের পণ্যের মূল্য দেখানো হয়েছে—আমদানি করা এবং দেশজ পণ্য। আমদানি করা পণ্যের ক্ষেত্রে টাকা-রুপির বিনিময় হার ও শুল্ক হারের পার্থক্য বিবেচনা করলেও ঢাকায় এসব পণ্যের মূল্য তুলনামূলকভাবে বেশি।

এর কারণ হলো, মাত্র পাঁচ–ছয়টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সয়াবিন ও চিনি আমদানি করে থাকে। তাদের মধ্যে একটা সিন্ডিকেট আছে। যার মাধ্যমে তারা উচ্চমূল্য নির্ধারণ করে থাকে এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও তাদের সঙ্গে সায় দেয়। বিভিন্ন দেশ ও সূত্র থেকে আমদানি করা এসব পণ্য বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামে বাজারজাত হলেও তাদের দাম অভিন্ন, যা সিন্ডিকেটের সুস্পষ্ট লক্ষণ।

এবার দেশে উৎপাদিত মূল্যের ক্ষেত্রে আসা যাক। যেখানেই যাই, কাঁচাবাজারে যাওয়া আমার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। এই সেদিন, শৈলান প্রবীণ নিবাসে গেলে স্থানীয় বান্নাখোলা বাজার থেকে প্রবীণ নিবাস ও আমার বাসার জন্য সবজি কিনি, কাঁচা পেঁপে প্রতি কেজি ৩০ টাকা, বরবটি প্রতি কেজি ২০ টাকা, জালি কুমড়া প্রতিটি ১০ টাকা, লাউ প্রতিটি ৩০ টাকা। প্রতিটি সবজির দাম ঢাকার এক-তৃতীয়াংশ বা অর্ধেকের কম।

শুধু পরিবহন ব্যয় দিয়ে এ দামের পার্থক্য ব্যাখ্যা করা যাবে না। সবজির উচ্চমূল্যের প্রধান কারণ হলো, এখানে আসার পথে ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও পরিবহনশ্রমিকদের চাঁদাবাজি ও পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত জ্বালানির উচ্চমূল্য।

সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা

যে দলই ক্ষমতায় থেকেছে, বাংলাদেশ এর আগে সব সময়ই সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় সাফল্য দেখিয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় চিড় ধরে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের আমলে, আর্থিক খাতের অব্যবস্থা, খেলাপি ঋণের উল্লম্ফন, বৈদেশিক মুদ্রা পাচার, রাজস্ব আহরণে ঘাটতি, চড়া সুদের বিদেশি ঋণনির্ভরতা বাড়তে থাকে।

বর্তমানে ‘অনুপস্থিত’ অর্থমন্ত্রীর আমলে তা পল্লবিত হয়। যার চূড়ান্ত পরিণতিতে ‘মুডি’স রেটিংয়ে বাংলাদেশের ‘বিএ৩’ থেকে ‘বি১’–এ অবনমন ঘটে। এর ফলে এক. ভবিষ্যৎ ঋণের খরচ বাড়বে; দুই. আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে প্রবেশাধিকার সীমিত হবে; তিন. বিনিয়োগকারীদের আস্থা হ্রাস পাবে; চার. বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের ওপর চাপ বাড়বে; পাঁচ. বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

মূল্যস্ফীতির অর্থনীতি

মূল্যস্ফীতি মূলত তিনটি কারণে ঘটে থাকে। এগুলো হলো ডিমান্ড পুল (অত্যধিক চাহিদা), কস্ট পুশ (খরচের ঊর্ধ্বমুখিতা) এবং সরকার নির্ধারিত মূল্যবৃদ্ধিজনিত। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির পেছনে এ তিন ধরনের উপাদানই রয়েছে—রাজস্ব আয় কম হওয়ায় সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা ঋণ নেওয়া (অত্যধিক চাহিদা) এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য হ্রাস (খরচের ঊর্ধ্বমুখিতা) ও পরিবহন জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি (সরকার নির্ধারিত মূল্যবৃদ্ধি)।

মূল্যস্ফীতির লাগাম ধরতে করণীয়

এক. সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। ক্রেডিট রেটিং অবনমনের প্রভাব প্রশমিত করার জন্য বাংলাদেশকে সুশাসন, নিয়মতান্ত্রিক আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং স্বচ্ছতা আনার জন্য কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়নে মনোযোগ দিতে হবে—মুদ্রার মান, সুদের হার নির্ধারণ পর্যায়ক্রমে বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প ছাঁটাই করতে হবে। প্রকল্প ব্যয় সীমিত করা ও সময়মতো বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে হবে।

দুই. নীতিনির্ধারকদের মাথা থেকে ‘মূল্যস্ফীতি আমদানি করা’—এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে মূল্যস্ফীতির কারণ প্রধানত দেশীয়, এটা স্বীকার করতে হবে। তাই রাজস্ব আয় বাড়িয়ে সরকারের ঋণ কমাতে হবে। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভ্যাটের ন্যায় মূল্যস্ফীতি ঘটায়, এমন করের পরিবর্তে আয়করের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হবে। কৃষিতে ভর্তুকি প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। মেগা প্রকল্প ও উচ্চ মূল্যের বিদেশি ঋণের আসক্তি কমাতে হবে।

আরও পড়ুন

তিন. আমদানি করা পণ্যের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে রি–অ্যাক্টিভের (প্রতিক্রিয়াশীল) পরিবর্তে প্রো–অ্যাক্টিভ (সক্রিয়) ভূমিকা নিতে হবে। পণ্য বাজারে সংকট শুরুর আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে।

চার. সড়ক, নৌপথ ও হাটবাজারে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। অর্থ পাচারকারী, চাঁদাবাজ, শুল্ক ও কর ফাঁকিতে নিয়োজিত ব্যবসায়ী ও তাঁদের সঙ্গে যোগসাজশকারী সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

গত বছরগুলোর অর্থনৈতিক অনাচারের কারণে আমরা এই সর্বগ্রাসী সংকটে পড়েছি। এ থেকে পরিত্রাণের উদ্যোগ নিতে হবে এখনই। আমাদের হাতে সময় খুব কম।

  • মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান অর্থনীতিবিদ ও সাবেক সচিব