Thank you for trying Sticky AMP!!

উপাচার্যদের আমলনামার উন্নতি হবে কি

জামালপুরে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে তাঁর অপসারণের দাবিতে টানা কর্মবিরতি পালন করছেন শিক্ষকেরা। তাঁর বিরুদ্ধে নিয়োগে বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি এবং নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তাঁর নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার পর রাজশাহীতে ২৫টি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে। ওই হিসাবগুলোয় প্রচুর টাকা রয়েছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁকে নিয়ে প্রথম আলো পত্রিকাসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। যদি ঘটনা সত্যি হয়, শিক্ষক সমাজ এবং দেশের জন্য খুবই দুঃখজনক। কিছুদিন আগে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ সংবাদপত্রে দেখতে পাই। তিনি যা করেছেন, তা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে পঙ্গু করে দিয়েছেন, যা জাতির জন্য কলঙ্কময়।

এ ছাড়া গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. খন্দকার নাসির উদ্দিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধান করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে ঘুষ, অনিয়ম, নিয়োগ বাণিজ্য, কেনাকাটার দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, উপাচার্যের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক পদে থাকার সময় তিনি নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

Also Read: বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যমহলে আত্মসম্মান ফিরে আসুক

আমার কর্মস্থল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটির উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা ছিল। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ ছিলেন এক ‘ব্যতিক্রমী’ উপাচার্য। তাঁকে নিয়ে সমালোচনার শেষ ছিল না। এসব আমাদের জন্য লজ্জাকর।

তাঁরা সবাই সুশিক্ষিত এবং সমাজের জন্য গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। উপাচার্য থাকাকালে কোনো শিক্ষকমহলের চাপে পড়েও যদি অন্যায়-অনিয়ম করতে বাধ্য হন, তা–ও যুক্তিসংগত নয়। কারণ, তাঁদের জ্ঞানের যে প্রজ্ঞা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের জায়গা থেকে যুক্তি-বুদ্ধি বিবেচনা থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে সক্ষমতা সেই মাহাত্ম্যকে খর্ব করে এ ধরনের দৃষ্টান্ত। অন্যায় যে করে আর অন্যায়ের সঙ্গে যে আপস করে দুইয়ে পার্থক্য খুব অল্প। তা সত্যেও এটা জাতির জন্য বিভ্রান্তিকর।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তাঁর মেয়েজামাইকে শিক্ষক নিয়োগের জন্য শর্ত শিথিল করার অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। নিজ পিএইচডি শিরোনামের ইংরেজিতে বলতে ব্যর্থ হওয়া এক প্রার্থীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিকস ডিজাইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও নিয়োগ বোর্ডের অন্যতম সদস্য হিসেবে বিতর্কিত ওই প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে নিজে সুপারিশ ও বোর্ডের অন্য সদস্যদের সুপারিশ করতে জোর করেন। সিলেকশন বোর্ডের বাকি সদস্যদের তীব্র দ্বিমত থাকা সত্ত্বেও তাঁরা নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেন বলে অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়।

দুর্ভাগ্যবশত আইনের মার-প্যাঁচ দিয়ে লবিংয়ের কারণে এমন কিছু শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পান, যা বিশ্ববিদ্যালয় তথা জাতির জন্য চরম ক্ষতিকর। কারণ, ওই সব শিক্ষক ৪০ থেকে ৪৫ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবেন। আমি যদিও কয়েকজন উপাচার্যদের অপকর্মের কথা তুলে ধরেছি, যা গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় কিন্তু অনেক উপাচার্য রয়েছেন যাঁরা সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব সম্পন্ন করছেন।

Also Read: উপাচার্য নিয়োগ ও জবাবদিহির জন্য কয়েকটি প্রস্তাব

কিন্তু দুর্ভাগ্য, উপাচার্য পদটি অনেক সম্মানের হলেও এই পদটি পাওয়ার পর কেউ কেউ একধরনের স্বেচ্ছাচারিতায় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেন। যার কারণে তৈরি হয় একধরনের বিরোধ। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক সময় অস্তির পরিবেশ বিরাজ করে। আবার অনেক উপাচার্য সুনামের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেন এবং অতীতে করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশে উপাচার্যদের নেতিবাচক ইস্যু নিয়ে গণমাধ্যমে যেসব খবর প্রকাশ পায়, যা বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভাবাও যায় না।

আমাদের দেশে উপাচার্যদের এই আমলনামা কি কর্তৃপক্ষের নিকট পৌঁছায় না? কর্তৃপক্ষ যদি সঠিকভাবে এগুলো সামাল দিত তাহলে দেশের জন্য মঙ্গল হতো। কোনো উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা কোনো অনিয়মের অভিযোগ ওঠামাত্রই যদি তদন্ত করে তাঁকে অপসারণ করা হতো তাহলে উপাচার্যরা অনেক সতর্কতার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতেন। এতে সরকারের ভাবমূর্তি অনেকগুণ বেড়ে যেত। এখন উপাচার্যরা মনে করেন, একবার নিয়োগ পেলে সরকার আর চার বছরে তাঁকে অপসারণ করবে না। অর্থাৎ এই সুযোগে যত অন্যায়, দুর্নীতি বা স্বজনপ্রীতি করে নিতে পারেন কোনো কোনো উপাচার্য।

আমাদের দেশে উপাচার্যদের এই আমলনামা কি কর্তৃপক্ষের নিকট পৌঁছায় না? কর্তৃপক্ষ যদি সঠিকভাবে এগুলো সামাল দিত তাহলে দেশের জন্য মঙ্গল হতো। কোনো উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা কোনো অনিয়মের অভিযোগ ওঠামাত্রই যদি তদন্ত করে তাঁকে অপসারণ করা হতো তাহলে উপাচার্যরা অনেক সতর্কতার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতেন।

২০২২ সালে ইউজিসি ১৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগে তদন্ত হয়। কিন্তু অনেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। এটি বাকি উপাচার্যদেরও বেপরোয়া করে তুলছে। তাই এসব বন্ধে কোনো অভিযোগ উপাচার্যদের বিরুদ্ধে এলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে। আর উপাচার্য নিয়োগে যা গলদ রয়েছে, তা বন্ধ করতে হবে। লবিং ও তদবিরের মাধ্যমে উপাচার্য হওয়ার পন্থা বন্ধ করতে হবে। উপাচার্যদের দুর্নীতি বা অনিয়মের ফিরিস্তি শুধু যে এখন ঘটে, তা নয়। অতীতে অনেক হয়েছে যা লেখক আহমদ ছফা এর ‘গাভী বিত্তান্ত’ উপন্যাসে ভালোভাবে উল্লেখিত আছে।

কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ না করেই ওই উপন্যাসে আহমদ ছফা বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টির ছিল গৌরবময় অতীত। অনেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে গোটা দেশের আত্মার সঙ্গে তুলনা করে গর্ববোধ করতেন।...অতীতের গরিমার ভার বইবার ক্ষমতা বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই।’ যা এখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দৈন্যদশা এবং শিক্ষকরাজনীতির নোংরা বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন আহমদ ছফা তাঁর বইতে অনেক আগে থেকে। অর্থাৎ উপাচার্যদের এসব অপকর্মের ইতিহাস পুরোনো। তাই বলছি উপাচার্যদের আমলনামার কি উন্নতি হবে না? উপাচার্যদের এসব অনিয়মের সঙ্গে রয়েছে শিক্ষকদের নোংরা রাজনীতির গভীর সম্পর্ক।

তাই আহমদ ছফার এই উক্তি দিয়ে লেখা শেষ করতে চাই—

‘সকলের দৃষ্টির অজান্তে [বিশ্ববিদ্যালয়টিতে] একের অধিক হনন কারখানা বসেছে, কারা এন্তেজাম করে বসিয়েছেন সকলে বিশদ জানে। কিন্তু কেউ প্রকাশ করে না। ফুটন্ত গোলাপের মতো তাজা টগবগে তরুণেরা শিক্ষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার পর হনন কারখানার ধারেকাছে বাস করতে করতে নিজেরাই বুঝতে পারেন না কখন যে তারা হনন কারখানার কারিগরদের ইয়ার দোস্তে পরিণত হয়েছেন।’—গাভী বিত্তান্ত (১৯৯৫)

  • মো. শফিকুল ইসলাম সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।