বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যমহলে আত্মসম্মান ফিরে আসুক

উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আঁকা গ্রাফিতি
ছবি : প্রথম আলো

আশির দশকের শেষ ভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ছাত্রত্বকালের ডাকসাইটে ছাত্রনেতা (জাসদ-ছাত্রলীগ) শফি আহমেদ কয়েক দিন আগে ফেসবুকে লিখেছিলেন—১৯৯২ সালের ঘটনা। ড. মনিরুজ্জামান মিঞা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। ছাত্রদের হৈহুল্লোড়-স্লোগানের মধ্যে শফি আহমেদসহ ছাত্রনেতারা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমি পদত্যাগ করলে কি তোমাদের আন্দোলন সফল হবে?’ ছাত্রনেতারা বললেন, ‘আমরা সে রকমই মনে করি।’ উপাচার্য পদত্যাগ করলেন।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) এবারের ঘটনার মতো পুলিশের লাঠিপেটা, ছররা গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড—এ রকম বীভৎস কিছুই ঘটেনি সে সময়। সেই আন্দোলনের ফিরিস্তি দেওয়ার পরিসর এটা নয়। শুধু বলা যায় কারণ বিচারে শাবিপ্রবির তুলনায় সেটি ছিল একেবারেই নস্যি। তদুপরি রাজনৈতিক। তাঁকে নিয়োগকারী সরকারের দলের ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে অপরাপর সংগঠনগুলোর বিরোধের জেরে আন্দোলন। বলা চলে ছাত্রদলবিরোধী আন্দোলন। তাঁর প্রশাসনকে এবং তাঁকে রাজনৈতিক ভাবাদর্শনির্ভর বা পক্ষপাতমূলক মনে হয়নি কখনোই।


ক্ষমতাপ্রাপ্তি মানুষকে চূড়ান্ত ক্ষমতাহীন অসহায়ও করে তুলতে পারে। হয়তো শাবিপ্রবির উপাচার্য মহোদয় পদত্যাগ করতেই চেয়েছেন, কিন্তু সেই স্বাধীনতা, ইচ্ছা প্রকাশের ক্ষমতাটুকুও হয়তো তাঁর এখতিয়ারেই নেই। যতটুকু বুঝেছি, উপাচার্যের বিরুদ্ধে বড় কোনো অভিযোগ নেই। মানুষ হিসেবেও হয়তো তিনি মন্দ নন। ব্যক্তিমানুষ এখানে আলোচ্য নয়। পুলিশ-কাণ্ডের পর বুদ্ধ, গান্ধী বা মাদার তেরেসাতুল্য হলেও তাঁর পদে থাকার নৈতিক ভিত্তি শূন্য ধরে নেওয়াই যথার্থ। তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়নি। ছাত্রদেরও বড় কোনো বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়নি। কিন্তু পুলিশি আক্রমণের দগদগে ঘা যাঁদের শরীরে, অনশনের দুঃসহ স্মৃতি যাঁদের মগজে, এবং অপমান ও হীনমানতার মর্ম পীড়ন যে অসংখ্য তাজা-তরুণের মনে ও মননে অভিভাবকতুল্য শিক্ষকদের প্রতি ঘৃণা জাগিয়ে রাখবে, সেটা অনেকটাই নিশ্চিত। এবারের আগুন ছাই দিয়ে চাপা দেওয়া গেলেও নিচে তার জ্বলুনি কখনোই থামবে না।


আমাদের ইতিহাসই বলে পরিস্থিতি এ রকমটা ছিল না। ১৯৬২ সাল। সরকারের সামান্য অন্যায্য চাপের মুখেও আত্মসম্মানবোধ বিকিয়ে দেননি উপাচার্য মাহমুদ হুসেইন। ঢাকা কলেজে এসে প্রাদেশিক গভর্নর মোনায়েম খান ছাত্রবিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন। মোনায়েম খান উপাচার্যকে চাপ দেন ছাত্রদের বিরুদ্ধে যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়। উপাচার্য পদত্যাগ করেন।

১৯৭১ সাল। ২৬ মার্চ। উপাচার্য আবু সাঈদ চৌধুরী তখন জেনেভায়। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়েছেন। ২৫ মার্চের রাতে গণহত্যা যে হয়েছে, সেটিও তখনো ভালোমতো জানেন না। শুধু শুনলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। শোনামাত্রই জেনেভায় বসেই পদত্যাগ করলেন। তাঁকে দেশেও ফিরতে না দেওয়া হতে পারে জেনেও পদত্যাগ করতে পারার নৈতিক শক্তিটি খোয়াননি। অথচ তিনি ছিলেন সামরিক সরকারের সরাসরি নিয়োজিত উপাচার্য।

১৯৭১ সাল। ২৬ মার্চ। উপাচার্য আবু সাঈদ চৌধুরী তখন জেনেভায়। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়েছেন। ২৫ মার্চের রাতে গণহত্যা যে হয়েছে, সেটিও তখনো ভালোমতো জানেন না। শুধু শুনলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। শোনামাত্রই জেনেভায় বসেই পদত্যাগ করলেন। তাঁকে দেশেও ফিরতে না দেওয়া হতে পারে জেনেও পদত্যাগ করতে পারার নৈতিক শক্তিটি খোয়াননি। অথচ তিনি ছিলেন সামরিক সরকারের সরাসরি নিয়োজিত উপাচার্য।

১৯৮২ সালে সামরিক শাসক এরশাদের ক্ষমতা দখলের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে শাসকদের প্রধান লক্ষ্য। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন নানা রূপে ডাল-পালা ছড়াচ্ছিল। পাশাপাশি ক্যাম্পাসে বাড়ছিল গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের আনাগোনা। সে সময় উপাচার্য ছিলেন ফজলুল হালিম চৌধুরী। তাঁর ওপরও সেনা ছাউনি থেকে পাঠানো নির্দেশ-নির্দেশনা বাড়ছিল। একটি সদ্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত সামরিক সরকারের মতিগতি বোঝা সহজ বিষয় নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নজর রাখতে হয় শিক্ষাকল্যাণ ও ছাত্রকল্যাণের দিকে। রাজনীতির সূতিকাগারে ছাত্ররাই রাজনীতির পাঠ নেবে, অনেকের হাতেখড়ি হবে, অনেকে ভবিষ্যতের কান্ডারি হবে। সুতরাং ছাত্ররাজনীতি বন্ধের সরকারি অপচেষ্টাকে কোনোভাবেই বেড়ে উঠতে দেওয়া যায় না। ১৯৮৩ সালে তিনি পদত্যাগ করলেন। কারণ দেখালেন স্বাস্থ্যগত। তা ছাড়া উপায়ই-বা কী? জলে নেমে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ সেই সময়টিতে মোটেই বুদ্ধিদীপ্ত কাজ হতো না।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের প্রথম বছরে ১৯৮৬ সালে উপাচার্য ছিলেন মোহাম্মদ শামসুল হক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। সামরিক সরকারের নানা রকম চাপ থাকলেও তিনি কখনো ছাত্রদের বিপক্ষে যাবেন—এমনটি কেউই ভাবেননি। বহু দল, বহু মতের ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রতিষ্ঠা প্রাপ্তি ও শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ওঠার কাল ছিল সময়টি। ১৯৮৬ সালে সামরিক শাসকের বহুমুখী চাপের প্রভাব বাড়তে থাকলে ১৯৮৬ সালেই তিনি পদত্যাগ করেন। ১৯৮৬-এর জানুয়ারি থেকে ১৯৯০-এর মার্চ পর্যন্ত উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক আব্দুল মান্নান। এরশাদবিরোধী আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতৃত্বের অনুপ্রেরণায় দেশব্যাপী বিস্তৃত হয়ে পড়ে তাঁর সময়েই। সরকারি চাপ তাঁর ওপরও ছিল। কিন্তু আগের দুজন উপাচার্যের দৃঢ়তা থেকে তিনি শিক্ষা নিয়েছিলেন। সামরিক শাসকও শিক্ষা নিয়েছিল। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়-প্রশাসন ও ছাত্রদের অম্লমধুর বিরোধ-বিরোধিতা ও মত-প্রতিমতের চর্চা থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের অখণ্ডতায় সামান্যও ছেদ পড়েনি। মনিরুজ্জামান মিঞাকেও দলীয় রাজনীতি গ্রাস করতে পারেনি।

১৯৯২-৯৬-এর উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদের সময়েই প্রথমবারের মতো দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দেখা মেলে। কিন্তু তিনিও আত্মমর্যাদা বিকিয়ে দেননি। ১৯৯৬ সালে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মরহুম এ এস এইচ কে সাদেকের একজন প্রভোস্ট নিয়োগের বিষয়ে তাঁর ওপর চাপ প্রয়োগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি পদত্যাগ করেন। পরে একাধিক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহত্তর স্বার্থে তিনি পদত্যাগে দ্বিধা করেননি। সাংবাদিক শরিফুজ্জামান তাঁর এক উপসম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন যে ১৯৯৪ সালে ছাত্রলীগ তাঁর কার্যালয় ভাঙচুর করে।

১৯৯৫ সালে এক ছাত্রলীগ ক্যাডার তাঁর কার্যালয়ে অস্ত্রসহ প্রবেশ করেছিল। দুবারই পুলিশি সহায়তা নেওয়ার মতো অবস্থা ঘটেছিল। কিন্তু, তিনি শরিফুজ্জামানের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘ওরা যে আমাদেরই ছাত্র’। ২০০৯ সালে উপাচার্য এস এম এ ফায়েজও উপাচার্যের পদ থেকে অব্যাহতির আবেদন করেন। ‘সৌজন্যবোধ এবং পদের মর্যাদা রক্ষায়’ অব্যাহতির আবেদন—জানিয়েছিলেন সাংবাদিকদের।

উপাচার্য আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী শক্তি প্রয়োগ করতে গিয়ে অসম্মানিত অবস্থায় পদ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। সব উপাচার্যেরই এসব দৃশ্য ও ঘটনা চাক্ষুষ করা আছে। সেগুলো থেকে শিক্ষাও নিয়েছেন নিশ্চয়ই। কিন্তু শিক্ষা প্রয়োগ করতে পারছেন না কেন? বাধা কোথায়? তাঁরা রাজনৈতিকভাবে নিয়োজিত বলে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের শক্তিকেও জলাঞ্জলি দিয়ে বসেছেন কি না, সে প্রশ্নটি অনেকের। সম্মান একটি দ্বিপক্ষীয় বিষয়, জোর করে আদায়ের বিষয় নয়। যাঁরা সম্মান পাওয়ার যোগ্য, শিক্ষার্থীরা তাঁদের ঠিকই সম্মান করেন, তাঁদের যেচে সম্মান চেয়ে বেড়াতে হয় না।

শাবিপ্রবির ঘটনার একটি ভীতিকর দিক চূড়ান্ত অবিশ্ববিদ্যালয়সুলভ।আন্দোলনকারীদের প্রতি মানবিক সহানুভূতিসুলভ সহায়তা দিতে গিয়ে পাঁচজন প্রাক্তন ছাত্র মামলা ও গ্রেপ্তারের কবলে পড়েছেন, গোয়েন্দা সংস্থার তলবাধীন হয়েছেন। আরও অনেকের বিপক্ষে মামলা হয়ে রয়েছে শোনা যাচ্ছে। ছাত্রছাত্রীরা ভবিষ্যতে শিক্ষকদের প্রতিশোধের শিকার হওয়ার ভয় পাচ্ছেন। এসব কেমন কথা? শিক্ষকেরা ছাত্রছাত্রীদের প্রতিপক্ষ—এ রকম অসুস্থতা যেন বিশ্ববিদ্যালয়কে গ্রাস না করে। সব উপাচার্যের মধ্যে এ রকম আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হোক, যাতে আমজনতা না ভাবে যে তাঁরা তাঁদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকেও রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের পাকে খুইয়ে বসেছেন বা বিকিয়ে দিয়েছেন। আর কিছু থাকুক না-থাকুক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভিভাবকত্বধারী প্রতিষ্ঠানটির চালকদের মর্যাদাবোধ ফিরে আসুক।

হেলাল মহিউদ্দীন, অধ্যাপক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সদস্য, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ