Thank you for trying Sticky AMP!!

এবার গাজাবাসীকে অনাহার ও রোগে ভুগে নিঃশেষ করার চেষ্টা চলছে

ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদের রূপ

গাজায় ইসরায়েলের অব্যাহত হত্যাযজ্ঞের পাঁচ মাস পেরিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক আদালতের অন্তর্বর্তী আদেশ সত্ত্বেও এ আগ্রাসনের নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতার মাত্রায় খুব একটা হেরফের ঘটেনি। অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি, স্কুল, হাসপাতাল, রাস্তাঘাটের বেশির ভাগ ধ্বংস করে দিয়ে এখন তাদের অনাহার ও রোগে ভুগে নিঃশেষ করার চেষ্টা চলছে। মিসরের সঙ্গে রাফা সীমান্তে শত শত খাদ্য ও ওষুধবাহী ট্রাক অপেক্ষমাণ থাকলেও ইসরায়েল তা ঢুকতে দিচ্ছে না।

জরুরি ত্রাণসামগ্রী ঢুকতে দেওয়ার জন্য ইসরায়েলকে সীমান্ত খুলে দিতে বাধ্য করা হলে ফিলিস্তিনিদের মানবিক সংকট হয়তো কিছুটা লাঘব হতো। আন্তর্জাতিক আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী মানবিক ত্রাণকাজে ইসরায়েলের বাধা সৃষ্টি না করার কথা। কিন্তু ইসরায়েলকে স্থলপথে ত্রাণ ঢুকতে দিতে বাধ্য করার বদলে যুক্তরাষ্ট্র গাজায় আকাশপথে ড্রোন দিয়ে খাবার পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।

ইউরোপ চেষ্টা করছে সমুদ্রপথে সাহায্য পাঠাতে, যদিও গাজায় কোনো বন্দর নেই এবং ওই সব ত্রাণসামগ্রী খালাস করার জন্য তাদের নতুন জেটি তৈরি করতে হবে। ইসরায়েলের পশ্চিমা মিত্র ও পৃষ্ঠপোষকদের এমন জটিল নীতির অর্থ হচ্ছে তাদের অভিযানের জন্য আরও সময় দেওয়া। যার দুঃখজনক পরিণতি হচ্ছে আরও প্রাণহানি। তাড়াতাড়ি সাহায্য পৌঁছালে যাদের বাঁচানো সম্ভব হতো, তাদের আর রক্ষা করা যাবে না।

Also Read: ইসরায়েল, গাজা এবং পশ্চিমাদের দ্বিচারিতা

যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে মানবিক যুদ্ধবিরতির কথা বলা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন রোজার শুরুতে বিশ্বের মুসলমানদের রামাদান করিম জানিয়ে যে বার্তা দিয়েছেন, তাতে তিনি গাজায় ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতির জন্য বিরতিহীনভাবে কাজ করে যাওয়ার কথা বলেছেন।

যে অভিযানে ইসরায়েল ইতিমধ্যেই ইরাক ও সিরিয়ায় আইসিসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ব্যবহার করা বোমার চেয়েও বেশি বোমা ফেলেছে, ত্রিশ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে, সেই অভিযানে এখন কেন সাময়িক বিরতির কথা বলা হচ্ছে?

যুদ্ধ বন্ধের কথা বলার জন্য আরও কত ফিলিস্তিনিকে জীবন দিতে হবে? যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো যখন এখনো বিশ্বাস করে যে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের কোনো বিকল্প নেই, তখন ইসরায়েলকে সেই সমাধানের পথে যেতে বাধ্য করার কৌশল গ্রহণে দ্বিধা কেন? যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সামরিক ও আর্থিক সহায়তা ছাড়া ইসরায়েল কি এককভাবে এমন সামরিক অভিযান এতটা দীর্ঘ সময় ধরে চালিয়ে যেতে সক্ষম?

২.

এসব প্রশ্ন এখন পশ্চিমা বিশ্বের রাজনীতি ও সমাজকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে চলেছে। এমনকি হলিউডও বিতর্কমুক্ত থাকছে না। এবারের অস্কার অনুষ্ঠানে শ্রেষ্ঠ ফিচার ফিল্মের পুরস্কার গ্রহণের সময়ে দ্য জোন্স অব ইন্টারেস্ট চলচ্চিত্রের পরিচালক জোনাথন গ্লেজার যা বলেছেন তা ছিল অনেকটা এ রকম; আমাদের ইহুদিত্ব ও ইহুদি নিধনযজ্ঞকে ছিনতাই করে ইসরায়েল তা দখলদারির অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করছে, যে দখলদারি এত বেশি নিরীহ মানুষকে যুদ্ধের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে, আমরা তার প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

তিনি ৭ অক্টোবরের হামাসের আক্রমণের শিকার এবং গাজায় চলমান হামলার শিকার মানুষের প্রতি অমানবিকতার কথা উল্লেখ করে তা কীভাবে ঠেকানো যায় সেই প্রশ্ন রাখেন। গ্লেজার এখন কট্টর জায়নবাদীদের সমালোচনা ও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও নানা রকম বিতর্ক তৈরি হয়েছে, বিদ্বেষ ও বিভাজন মাথাচাড়া দিচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রেও যে বাইডেন প্রশাসনের ফিলিস্তিন নীতির প্রতিবাদ রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে, তার প্রমাণ মিলেছে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাইমারিতে।

নভেম্বরের নির্বাচনের হার-জিতে এসব প্রতিবাদী ভোট কতটা প্রভাব ফেলতে পারবে, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু ইসরায়েলের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থনের নীতি অব্যাহত রাখা বেশি দিন হয়তো চলবে না। 

Also Read: এক হাতে বোমা অন্য হাতে খাবার, আসলে কী চান বাইডেন

সপ্তাহখানেক আগে ব্রিটেনের এক উপনির্বাচনে অন্য সব বিষয়কে ছাপিয়ে গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রশ্নে ব্রিটিশ মূলধারার রাজনীতিকদের নিষ্ক্রিয়তা, ক্ষেত্রবিশেষে ইসরায়েলের প্রতি অন্যায় পক্ষপাতের প্রশ্ন সামনে চলে আসে। ইরাক যুদ্ধের সময় থেকে ব্রিটিশ রাজনীতিতে বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদী হিসেবে আবির্ভূত হওয়া রাজনীতিক জর্জ গ্যালাওয়ে মধ্য ইংল্যান্ডের বার্নলির উপনির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে নির্বাচিত হওয়ায় ওয়েস্টমিনস্টারে রীতিমতো নড়েচড়ে ওঠে।

ঐতিহাসিকভাবে লেবারের নিয়ন্ত্রণে থাকা আসনটিতে দলটি এর আগে তার প্রার্থীর ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে তাঁর কথিত ইহুদিবিদ্বেষী এক মন্তব্যের কারণে।

তবে লেবার পার্টির প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকলেও যে তাদের শেষ রক্ষা হতো, তেমনটা কেউই মনে করে না। এর কারণ হচ্ছে, গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাসের উদ্যোগে সমর্থন না জানানো। এ ছাড়া ইজরায়েলি অভিযানের শুরুর দিকে খাদ্য, ওষুধ, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ বন্ধ করাকে ফিলিস্তিনিদের সম্মিলিতভাবে সাজা দেওয়ার মতো যুদ্ধাপরাধ বলতে লেবার পার্টি প্রধান কিয়ার স্টারমারের অস্বীকৃতিও মুসলিম জনগোষ্ঠীসহ যুদ্ধবিরোধী মানুষজনকে ক্ষুব্ধ করে।

নভেম্বরে পার্লামেন্টে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির (এসএনপি) উত্থাপিত প্রস্তাবে লেবার পার্টির যেসব এমপি ভোট দেয়নি, তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ-প্রতিবাদ সংগঠিত হয়। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপিদের মধ্যেও কেউ কেউ এ ধরনের বিক্ষোভের মুখে পড়েন। সবচেয়ে বেশি রোষের মুখে পড়েন বাংলাদেশি-প্রধান বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো এলাকার এমপি রুশনারা আলী, যাঁর বিরুদ্ধে বিকল্প প্রার্থী নিয়ে ইতিমধ্যেই তোড়জোড় শুরু হয়েছে। 

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপিদের মধ্যে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রকাশ ও যুদ্ধবিরতির জন্য প্রতিবাদ-বিক্ষোভে সবচেয়ে সক্রিয় ও সোচ্চার ভূমিকা রেখে চলেছেন আপসানা বেগম। আপসানা লন্ডনে অনুষ্ঠিত প্রায় ডজনখানেক যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ-সমাবেশে অংশ নিয়েছেন ও বক্তৃতা করেছেন।

যুদ্ধবিরোধীরা এখন অন্তত ডজনখানেক আসনে লেবার পার্টির এমপিদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি শুরু করেছে। এমনকি লেবার নেতা কিয়ার স্টারমারের আসনে বিকল্প প্রার্থী হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠক ইহুদি ধর্মবিশ্বাসী অ্যান্ড্রু ফিনস্টেইন প্রার্থী হচ্ছেন বলে খবর বেরিয়েছে।

৩.

অ্যান্ড্রু ফিনস্টেইনের পক্ষে জনমত গঠনে মাঠে নেমেছেন পাশের এলাকার একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সাবেক কাউন্সিলর ওয়েছ আহমদ।

৬ মার্চ লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে (সোয়াস) ‘রাজনৈতিক প্রতিরোধ: বাংলাদেশের ফিলিস্তিন নীতি’ শীর্ষক এক আলোচনায় তিনি তাঁদের উদ্যোগের কথা জানান। এ আলোচনায় মূল বক্তা ছিলেন বেসরকারি সংগঠন ‘রেস্টলেস বিংস’-এর প্রতিষ্ঠাতা মানবাধিকার সংগঠক মাবরুর আহমেদ।

মাবরুর আহমেদ এবং বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ হজরত আলি খান—দুজনই বললেন যে স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের সব সরকারই ফিলিস্তিন প্রশ্নে একই নীতি অনুসরণ করে এসেছে, যার মূলে আছে ফিলিস্তিনিদের মুক্তিসংগ্রামকে সমর্থন করা, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং ইসরায়েলের অবৈধ দখলদারির অবসান এবং আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের প্রস্তাবসমূহ লঙ্ঘনের বিচার। বাংলাদেশ কখনোই এ অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়নি।

তবে ইসরায়েলের নজরদারি প্রযুক্তি কেনা ও ইসরায়েলে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি কীভাবে সম্ভব হলো, এ প্রশ্নের কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা আলোচনায় পাওয়া গেল না। পাসপোর্ট থেকে ইসরায়েলে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণাটি তুলে নেওয়ার নীতিও আলোচনায় সমালোচিত হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার মামলায় সমর্থন দেওয়া এবং ইসরায়েলের দখলদারি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন কি না, সে বিষয়ে শুনানিতে পক্ষভুক্ত হয়ে বাংলাদেশের বক্তব্য দেওয়াকে আলোচনা সভায় প্রয়োজনীয় এবং প্রশংসনীয় ভূমিকা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। 

ইসরায়েলের নৃশংসতম অভিযানের বিষয়ে বাংলাদেশের জনপ্রতিক্রিয়া অবশ্য একধরনের ধাঁধা বলেই মনে হয়। ইউরোপ-আমেরিকায় এমন শহর বোধ হয় এখন খুব কমই আছে, যেখানে ইজরায়েলি নৃশংসতার বিরুদ্ধে মানুষ রাস্তায় নামেনি, আমরা সবাই ফিলিস্তিনি আওয়াজ তোলেনি। একবার নয়, গত পাঁচ মাসে বারবার তারা রাস্তায় নামছে। কিন্তু বাংলাদেশে হাতে গোনা কয়েকটি মিছিল ছাড়া বড় ধরনের কোনো প্রতিবাদ দেখা যায়নি। এটি কি প্রতিবাদবিমুখতা? নাকি অভ্যন্তরীণ রাজনীতির হতাশার সংক্রমণ?

কামাল আহমেদ সাংবাদিক

Also Read: যাঁরা নৈতিকভাবে দেউলিয়া, তাঁরাই গাজায় নির্বিচার হত্যার পক্ষে