আকাশ থেকে গাজাবাসীকে লক্ষ্য করে যুক্তরাষ্ট্র একাধারে দুটি জিনিস ফেলছে, এক. বোমা ও দুই. খাবারের ঝাঁকা। অন্যভাবে বলতে গেলে, একাধারে মৃত্যু ও জীবনদায়ী বস্তুর জোগান দিয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ভারসাম্যহীন মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে গোঁজামিল দিয়ে ভারসাম্য খুঁজছেন।
আকাশ থেকে খাবার ফেলা ও অস্থায়ী বন্দর চালু করে গাজার ভুখা মানুষকে মানবিক সাহায্য পাঠানোর এই সিদ্ধান্ত বুঝিয়ে দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্য কৌশল নিয়ে বাইডেন এখন উদ্বিগ্ন। কারণ, তিনি এখন পর্যন্ত হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইসরায়েলকে শর্তহীনভাবে অস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছেন।
যুদ্ধের দুই পক্ষেই এখন যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। তারা অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলের পাশে থাকছে আর এসব অস্ত্রশস্ত্রের হামলায় যারা আহত হচ্ছে তাদের জন্যও মায়া দেখাচ্ছে। বাইডেন ক্রমশ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর আচরণে হতাশ হয়ে উঠেছেন। কারণ, গাজার বেসামরিক জনগণকে সুরক্ষা দিতে বাইডেনের কোনো অনুরোধেই নেতানিয়াহু কর্ণপাত করেননি।
স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন বক্তৃতার আগে-পরে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কিন্তু তাই বলে তিনি ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ থেকে পিছিয়ে আসেননি। বা অস্ত্রের জোগানদাতা হিসেবে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতিতে কোনো প্রভাব রাখার চেষ্টা করেননি।
ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্র্যাট নেতা ও রিপ্রেজেন্টেটিভ রো খান্না বলেন, ‘একই সঙ্গে গাজাবাসীকে ত্রাণসহায়তা ও ত্রাণসহায়তাবাহী ট্রাকে হামলার জন্য আপনি ইসরায়েলকে বোমা দিতে পারেন না।’ বাইডেনের ভাষণের ঠিক এক দিন পর এক সাক্ষাৎকারে এই রিপ্রেজেন্টেটিভ আরও বলেন, ‘এই বক্তব্যে একটা অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব আছে। আমি মনে করি বাইডেন প্রশাসনের উচিত গতকাল রাতের ভাষণের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয় এমন আচরণ করা। ফিলিস্তিনের বেসামরিক জনগণের প্রতি গত রাতে সমানুভূতি ও উদ্বেগের কথা উচ্চারিত হয়েছে। এটা সত্য প্রমাণ করতে নেতানিয়াহু ও তাঁর অতি ডানপন্থী সরকারকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তাহলেই বোঝা যাবে বাইডেন যা বলেছেন, তা কথার কথা নয়।’
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আকাশ ও সমুদ্রপথে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর এই উদ্যোগের পেছনে মূল কারণ হলো স্থলপথে গাজায় ত্রাণসহায়তা সরবরাহের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এখন পর্যন্ত মার্কিন কর্মকর্তারা ত্রাণ সরবরাহের এই পদ্ধতিকে অবাস্তব বলছেন। কারণ, স্থলপথে যে পরিমাণ ত্রাণ সরবরাহ সম্ভব, আকাশ ও জলপথে তা সম্ভব না এবং নানা দিক থেকে জটিলও।
আকাশ থেকে ফেলা খাবারের ঝাঁকা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, তা আমরা দেখেছি। শুক্রবার এই ঝাঁকা পড়ে পাঁচ ফিলিস্তিনি নিহত হন। তা ছাড়া মাঠে যদি একটা সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে ত্রাণ সরবরাহের পুরো প্রক্রিয়াটি বিশৃঙ্খল ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। একটি অস্থায়ী ও ভাসমান ঘাট তৈরি করতে কমপক্ষে ৩০ থেকে ৬০ দিন সময় লাগবে। এই কাজে ঝুঁকিও আছে। যদিও বাইডেন বলেছেন, এই ঘাট তীরের কাছাকাছি নির্মাণ করা হবে না এবং কোনো মার্কিন সেনা গাজার ভূমি স্পর্শ করবেন না।
বাইডেন প্রশাসন তাদের কর্মপরিকল্পনায় পরিবর্তন আনে গত মাসে ত্রাণবাহী ট্রাকের কাছে অবস্থানরত গাজাবাসীর ওপর ইসরায়েলিদের গুলি ছোড়ার পর। একজন শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানিয়েছেন, বাইডেন প্রশাসনের ভেতরের খবর হলো, ওই বিপর্যয়কর ঘটনাই বাইডেন প্রশাসনের পরিকল্পনায় পরিবর্তন এনেছে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ওপর থেকে ধারণকৃত ভিডিওতে গাজার বেপরোয়া বেসামরিক মানুষকে দেখা গেছে। যদিও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা ভেবেছিলেন এই ভিডিও প্রকাশ করে তারা তাঁদের বাহিনীকে নির্দোষ প্রমাণ করতে সক্ষম হবে, কিন্তু ঘটেছে উল্টোটা। তারা গাজাবাসীকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া এক দঙ্গল মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিল। তবে বাইডেন প্রশাসনের উপলব্ধি হলো, পরিস্থিতি এতই শোচনীয় যে ভোর সাড়ে চারটার সময় মানুষ খাবারের গাড়ির দিকে এভাবে ছুটেছে।
সমালোচকেরা বলছেন, প্যারাসুটে করে ফেলা খাবারের ঝাঁকা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। একই সঙ্গে বাইডেনের দ্বিচারিতার প্রকাশ। প্রেসিডেন্টের এই দ্বিমুখী অবস্থানের সূত্রপাত গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ঢুকে ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি এবং এর জবাবে গাজায় ৩০ হাজার মানুষকে হত্যা।
ওয়াশিংটনের আরব সেন্টারে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল প্রোগ্রামের প্রধান ইউসেফ মুনায়ের বলেন, ‘এর কোনো অর্থ নেই। এটা অনেকটা দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুন এক কাপ পানি দিয়ে নেভানো ও যে আগুন জ্বালিয়েছে তাকে আরও জ্বালানি সরবরাহের নামান্তর। প্রশাসন একটি রাজনৈতিক সংকটের সমাধানের চেষ্টা করছে। যুদ্ধে সমর্থনের কারণে কিছু ভোটারের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, তাকে প্রশমন করতেই এই বক্তব্য।’
যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বোমা যাদের নিশানা করে ছোড়া হচ্ছে, তাদের খাদ্যসহায়তা দেওয়া বিপরীতধর্মী কাজ কি না, এমন আলোচনায় হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা জড়াতে চান না। প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা যোগাযোগবিষয়ক উপদেষ্টা দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘আমরা গাজার জনজীবন পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের গভীর উদ্বেগের কথা পরিষ্কারভাবে জানিয়েছি। আমরা বলেছি, এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতি কতটা অগ্রহণযোগ্য।’
ইসরায়েলি এবং তাদের সমর্থকেরা এই যুক্তি প্রত্যাখ্যান করছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এয়াল হুলাটা বলেন, ‘তারা কেন উদ্দেশ্য খুঁজে বেড়াচ্ছে? বার্তাটা হলো, এবং আমি বাইডেনকে জোরালো সমর্থন করছি যে তিনি হামাসকে নিশ্চিহ্ন করার যুদ্ধে সমর্থন দিয়েছে। তারাই সব নষ্টের গোড়া। সেই সঙ্গে বাইডেন গাজার বেসামরিক জনগোষ্ঠীর কথাও ভাবছেন।’
এয়াল হুলাটা আরও বলেন, ‘যারা বাইডেন সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করছে, তারা আসলে গাজাবাসী ও হামাসের মধ্যে পার্থক্য করতে জানে না। কিন্তু আমরা করি।’
যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বোমা যাদের নিশানা করে ছোড়া হচ্ছে, তাদের খাদ্যসহায়তা দেওয়া বিপরীতধর্মী কাজ কি না, এমন আলোচনায় হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা জড়াতে চান না। প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা যোগাযোগবিষয়ক উপদেষ্টা দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘আমরা গাজার জনজীবন পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের গভীর উদ্বেগের কথা পরিষ্কারভাবে জানিয়েছি। আমরা বলেছি, এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতি কতটা অগ্রহণযোগ্য।’
ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার এবং সন্ত্রাসী হামলার পাল্টা জবাবের পক্ষে বাইডেন জোরালো সমর্থন দিয়েছেন। তাঁর নিজের দল থেকেই ফিলিস্তিনি বেসামরিক জনগণের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতি প্রকাশ না করা নিয়ে সমালোচনা আছে।
যদিও স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন বক্তৃতায় এবার বাইডেন আগের চেয়েও জোরালো ভাষায় গাজার মানুষের দুর্গতির কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি তাঁর নীতির কোনো পরিবর্তন ঘটাননি, শুধু জনগণের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তাঁর কথার যে সুর, তাতে কিছুটা পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
বাইডেন বলেন, ‘এই যুদ্ধে গাজার যত মানুষ মারা গেছেন, এর আগের সব যুদ্ধে সম্মিলিত প্রাণহানির চেয়েও এই সংখ্যা বেশি। গাজার ৩০ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন, যাঁদের সিংহভাগ হামাস নয়। হাজার হাজার নির্দোষ মানুষ, নারী ও শিশু মারা গেছে। শিশুরা এতিম হয়ে গেছে। ২০ লাখের বেশি ফিলিস্তিনি বোমা হামলা ও বাস্তুচ্যুতির শিকার। বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে, পুরো অঞ্চল গুঁড়িয়ে গেছে, শহরগুলো শেষ। খাবার, পানি, ওষুধের তীব্র সংকট। এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।’
হাউস ফ্লোরে কলোরাডোর ডেমোক্র্যাট সিনেটর মাইকেল বেনেট প্রেসিডেন্টকে বলেন নেতানিয়াহু ওরফে বিবির ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে।
বাইডেন জবাবে বলেন, ‘আমি তাঁকে বলেছি বিবি, আমি বারবার এক কথা বলতে চাই না। কিন্তু আপনার ও আমার একটটা উপলব্ধিতে পৌঁছানোর সময় এসেছে।’ যদিও এই কথোপকথন ছিল দুজনের মধ্যে, তবে মাইক্রোফোন চালু থাকায় বাইডেনের এই বক্তব্য সবাই শোনেন।
বাইডেনের একজন সহকারী এ ব্যাপারে তাঁকে সতর্ক করলেও, তাঁকে বিচলিত দেখায়নি। তিনি তাঁর বিরক্তিও লুকাতেও চাননি।
গাজায় ত্রাণসহায়তা পৌঁছানো নিয়েই মূলত দেশ দুটির মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। জাতিসংঘের কর্মকর্তারা সতর্ক করে বলেছেন, ৫ লাখ ৭০ হাজার অনাহারী গাজাবাসী বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে আছে। যদি এ পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন না হয়, তাহলে উত্তর গাজায় দুর্ভিক্ষ হবে শিগগিরই। যুদ্ধ শুরুর আগে গাজা প্রতিদিন ৫০০ ট্রাক ত্রাণসহায়তার ওপর নির্ভর করত। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানিয়েছে এখন ঢুকছে ১৫০ ট্রাক। মৌলিক প্রয়োজনটুকু মেটাতে ত্রাণসহায়তা এখনই দ্বিগুণ করা প্রয়োজন।
ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির প্রেসিডেন্ট ডেভিড মিলিব্যান্ড শুক্রবার বলেছেন, আকাশ থেকে খাবারের ঝাঁকা ফেলা কিংবা ঘাট তৈরি করা হলো সবশেষ ব্যবস্থা। মূল সমস্যা সমাধান না করে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেমন খরচের, তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ। এসব করে যুদ্ধবিরতির যে মূল দাবি, তা থেকে দৃষ্টি সরানো উচিত হবে না। কারণ, যুদ্ধবিরতি হলে এ অঞ্চলে বেসামরিক নাগরিকেরা সুরক্ষা পাবেন, ত্রাণ সরবরাহ বাড়বে, অবকাঠামো এবং হাসপাতালগুলো কার্যকর করা যাবে। অগ্রাধিকারের তালিকায় যেটা ৪ কিংবা ৫ নম্বর সেটিকে স্বাভাবিক ও বিকল্প হিসেবে নেওয়া কখনোই ঠিক হবে না।
পিটার বেকার দ্য টাইমসের হোয়াইট হাউস প্রতিনিধি। মাইকেল ক্রাউলি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ও নীতিসংক্রান্ত প্রতিবেদক। তিনি বিশ্বের তিন ডজন দেশ ভ্রমণ করেছেন, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর সঙ্গীও হয়েছেন।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত। ইংরেজি থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ। অনুবাদ করেছেন শেখ সাবিহা আলম