Thank you for trying Sticky AMP!!

নতুন বিশ্বব্যবস্থায় নেতৃত্ব দেবে কে

হিরোশিমায় জি–৭ সম্মেলনে নেতারা

আমেরিকার নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার ক্রমশ ভেঙে পড়ার চিত্র কয়েক দশক ধরেই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় ২০০১ সালে চীনের অন্তর্ভুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে।

সামরিক ও কৌশলগত সক্ষমতা বাড়িয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে বেইজিং এখন নিঃসন্দেহে একটি প্রভাবশালী শক্তি। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চীনই একমাত্র দেশ নয়; আরও বেশ কিছু দেশ শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করছে। ভ্লাদিমির পুতিনের সংশোধনবাদী নেতৃত্বে রাশিয়াও বিশ্বশক্তি হিসেবে ফেরার চেষ্টায় আছে।

বহুমেরুকেন্দ্রিক ব্যবস্থাকে বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা উচিত হবে না। প্রতিযোগিতায় লিপ্ত একগুচ্ছ বৈশ্বিক শক্তি দায়িত্বশীল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হয়ে উঠবে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। অংশীদারত্ব ও অভিন্ন বিশ্বাসের বদলে যদি ক্ষমতা ও লোভ হয় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি, তাহলে যে বা যারাই নেতৃত্বে থাকুক, বিশ্বকে ভুগতে হবে।

এই চিন্তা থেকে রুশ প্রেসিডেন্ট এখন রাজনীতিতে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে। পুতিন চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়েছেন। ২০১৩ সালে চীনে সি চিন পিং এর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর এই সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়।

ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বব্যাপী আগ্রাসনের পর বিশ্বনেতৃত্বের এই শক্তি প্রদর্শন আরও বেড়েছে। তবে আদতেই ভূরাজনৈতিক শক্তি, সেনা ও নৌঘাঁটি মোতায়েনে কেউ যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে নেই। বিশ্বব্যাপী কমপক্ষে ৮০টি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সাড়ে ৭০০ ঘাঁটি আছ। চীনের ঘাঁটি আছে একটি—জিবুতিতে। একইভাবে অর্থনৈতিক দক্ষতা, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও বাণিজ্যিক সাফল্য এবং বলাই বাহুল্য, অপ্রতিদ্বন্দ্বী ‘ব্র্যান্ড আমেরিকা’র কোনো তুলনা নেই।

Also Read: চীন–যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্বে আসিয়ানে ঐক্যের পথ কী

নব্বইয়ের দশকের দিকে যখন শীতলযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র জয়লাভ করল এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ল, তখন দেশটিকে শ্রেষ্ঠ বলা যৌক্তিক ছিল। কিন্তু এখন আর সেই সুযোগ নেই। গত দুই দশকে আমেরিকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবনমন বিশ্বে তার প্রভাব ও কর্তৃত্বকে খর্ব করেছে।

কৌশলগতভাবে, ৯/১১–এর পর বৈশ্বিক সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে যুক্তরাষ্ট্র বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক অভিযানে জড়ায়। এই অভিযানে নিজ দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের টিকে থাকার যে সক্ষমতা, তা নিয়ে প্রশ্নের জন্ম দেয়। ইরাকে বিপর্যয়কর যুদ্ধ, আফগানিস্তানে দীর্ঘ যুদ্ধের পর অবমাননাকর পরাজয় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সক্ষমতার সীমাবদ্ধতার প্রমাণ।

Also Read: পরাশক্তির সংঘাতে ভারত–ব্রাজিলের অন্যরকম কূটনীতি

বারাক ওবামা ও ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক ইস্যু থেকে বিচ্ছিন্নতার নীতি নেয়। এতে চলমান বৈশ্বিক ইস্যু ও বিভিন্ন দেশের নেতাদের ওপর তাদের প্রভাব বিস্তার করা কঠিন হয়ে পড়ে। বিশ্বনেতৃত্ব ক্রমেই বিশ্বাস করতে শুরু করে যে অংশীদার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করা যায় না। অর্থনৈতিক বিবেচনায়, ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আর্থিক সংকটের সূত্রপাত। বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থাপনা ধসে পড়ার উপক্রম হয় তখন। অর্থনীতিতে নয়া উদার ব্যবস্থাপনায় এই সংকট এমনভাবে আঘাত করে যে দেশগুলো তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ করার দিকে এগোয়।

এর ফলে জি–২০–এর উত্থান ঘটে। পাশাপাশি মাঝারি শক্তিরও আবির্ভাব হয়। এই শক্তিগুলো এখন এখন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার জি–৭ মিত্রদের এড়িয়ে বিশ্বমঞ্চে ক্রমশ আরও বেশি প্রভাব রাখছে।

এদিকে ব্র্যান্ড আমেরিকাও ব্যাপকভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছে। ২০১৬ সালে ট্রাম্পের উত্থান পশ্চিমা উদারনীতিবাদের পিছু হটা জনতুষ্টিবাদ, দুর্নীতিগ্রস্ত ও কর্তৃত্বপরায়ণ শক্তির পুনর্জাগরণের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। এই ধারা আমেরিকা যে ধরনের উদারনৈতিকতাবাদের প্রচারক, বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় তা বিক্রিকে কঠিন করে ফেলে।

২০২০ সালে ট্রাম্পের পরাজয়ের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ‘আমেরিকা ইজ ব্যাক’ (আমেরিকা ফিরেছে) ঘোষণা আমেরিকাকে আসলে তার আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিতে পারেনি। মার্কিন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় তাঁর তথাকথিত ‘নিয়মতান্ত্রিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা’ হেরে গেছে। এই ব্যবস্থাকে কারসাজি বলে ধরে নেওয়া হয়। বলা হয়, এই পদ্ধতি আন্তর্জাতিক আইনকে পাশ কাটিয়ে পশ্চিমকে বেশি গুরুত্ব দেয়।

Also Read: আইএমএফের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে এশীয় মুদ্রা তহবিল

কিন্তু এরপরও বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা বিকল্প হিসেবে খুব উজ্জ্বল নয়, যেহেতু অন্যান্য শক্তি শূন্যস্থান পূরণে চেষ্টা করছে। বহু দেশই শক্তি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত এবং নিজেদের স্বার্থ রক্ষা এবং কে কার চেয়ে এগিয়ে, তা নিয়ে বিবাদে জড়াতে পারে। তারা একটি উন্নততর পৃথিবী তৈরিতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারবে না। বরং উল্টো। শত্রুতানির্ভর ব্যবস্থা বিশ্বে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।

সে কারণে নতুন বিশ্বনেতৃত্ব নিয়ে বিতর্ক হলেই আরও গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্ন উঠতে পারে, তা হলো এই নেতৃত্ব কীভাবে কাজ করবে। এই নেতৃত্ব শত্রুতানির্ভর কৌশল নিয়ে এগোলে বিশ্বে এর প্রভাব হবে ভয়াবহ। কিংবা এই নেতৃত্ব ব্যাপক পরিসরে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ককে ভিত্তি ধরে এগোতে পারে।

সারকথা হলো, বহুমেরুকেন্দ্রিক ব্যবস্থাকে বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা উচিত হবে না। প্রতিযোগিতায় লিপ্ত একগুচ্ছ বৈশ্বিক শক্তি দায়িত্বশীল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হয়ে উঠবে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। অংশীদারত্ব ও অভিন্ন বিশ্বাসের বদলে যদি ক্ষমতা ও লোভ হয় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি, তাহলে যে বা যারাই নেতৃত্বে থাকুক, বিশ্বকে ভুগতে হবে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত

  • মারওয়ান বিশারা আল–জাজিরার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক