চীন–যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্বে আসিয়ানে ঐক্যের পথ কী

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসিয়ানকে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ঐক্যকে জোরালো করতে হবে

সম্প্রতি হিরোশিমায় অনুষ্ঠিত জি-৭ সম্মেলন এবং কাশ্মীরে অনুষ্ঠিত জি-২০ পর্যটন বৈঠকে এই দুই গ্রুপের বক্তব্যে পারস্পরিক বৈসাদৃশ্য উঠে এসেছে। জি-২০ সম্মেলনে যে লক্ষ্যের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, তা হলো, ‘এক ধরিত্রী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’। অন্যদিকে জি-৭ এর সামগ্রিক যুদ্ধংদেহী মনোভাবকে এককথায় আনলে যা দাঁড়ায় তা হলো, ‘চীনকে তালাক দিতেই হবে’।

তবে কথা হলো, অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ এশিয়ান নেশনসের (আসিয়ান) সদস্যদের জন্য বিচ্ছিন্নতা একটি বিকল্প উপায় হতে পারে না। চীন থেকে উৎপাদন ও বিনিয়োগ আসিয়ান দেশগুলোতে সরিয়ে নিলে যদিও এই অঞ্চল লাভবান হতে পারে, কিন্তু চীনের অর্থনীতি ও পশ্চিমের অর্থনীতি পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে সেটি দীর্ঘ মেয়াদে বাণিজ্যবিমুখতা সৃষ্টি করতে পারে, উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দিতে পারে এবং কল্যাণ খাতকে দুর্বল করে দিতে পারে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, চীন থেকে আমেরিকান ও ইউরোপিয়ান অর্থনীতিকে বিযুক্ত করার জন্য যে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে, তা মূলত জ্বালানি, সেমিকন্ডাক্টর, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি এবং খনিজ সম্পদের মতো খাতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে।

আসিয়ান দেশগুলো তাদের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে শান্তিপূর্ণ অবস্থাকে এগিয়ে নিতে পারে, সহযোগিতা ত্বরান্বিত করতে পারে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংযুক্তি বাড়াতে পারে।

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্রতর হওয়ার এই সময়টাতে আসিয়ান দেশগুলোকে অবশ্যই আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ঐক্যকে জোরালো করতে হবে। দুই দশক ধরে আসিয়ান দেশগুলোর নিজেদের মধ্যকার বাণিজ্য ২২-২৩ শতাংশে আটকে আছে। নিশ্চিতভাবে, এই সময়ের মধ্যে বিশ্বের অন্যান্য স্থানে আসিয়ান সদস্যদের রপ্তানি বেড়েছে। কিন্তু ২০০০ ও ২০২০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে বিশ্ব বাণিজ্যে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর শেয়ার বা অংশ মাত্র ৬.৪ শতাংশ থেকে ৭.৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

আরও পড়ুন

নতুন শতাব্দীর শুরু থেকে আন্ত–আসিয়ান বাণিজ্যে স্থবিরতা চলার পেছনে সম্ভাব্য তিনটি ব্যাখ্যা রয়েছে।

প্রথমটি হলো, এ অঞ্চলের দেশগুলোর ভাসা–ভাসা বা অগভীর পারস্পরিক যুক্ত থাকার (ইন্টেগ্রিটি) মডেল। কারণ, আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোতে উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে পরিপূরক পণ্যের (কোনো নির্দিষ্ট অভাব পূরণে একটি পণ্যের সঙ্গে অপর একটি পণ্য একই সঙ্গে ব্যবহার করতে হলে পণ্য দুটিকে একে অপরের পরিপূরক পণ্য বলে) তুলনায় বিকল্প পণ্যের (কোনো নির্দিষ্ট অভাব পূরণে দুটি পণ্যের মধ্যে একটির পরিবর্তে অপরটি ব্যবহার করা গেলে একটিকে অপরটির বিকল্প পণ্য বলে) পরিমাণ বেশি। এ কারণে আসিয়ান সদস্যদের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধির সুযোগ সহজাতভাবে সীমিত।

দ্বিতীয়ত, পণ্য উৎপাদনের কঠোর নিয়ম এবং অশুল্ক ব্যবস্থা বাণিজ্য বাধা হিসেবে কাজ করতে পারে। যদিও এই প্রবিধান এবং পদ্ধতিগুলো স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা এবং পরিবেশগত সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তৈরি করা হয়েছে, তথাপি এগুলোর প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন বাণিজ্য ও বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

সবশেষে, এটি স্বীকার করা গুরুত্বপূর্ণ যে আসিয়ান একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ অঞ্চল নয়। আসিয়ান সদস্যরাষ্ট্রগুলো জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং চীনের মতো দেশগুলোর বিনিয়োগ ও প্রযুক্তির ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল। এই ব্লকটি একটি যূথবদ্ধ গ্রুপ হিসেবে কাজ করলেও এটি কোনো শুল্ক ইউনিয়ন নয়। এর মানে হলো, আসিয়ানের সদস্যরাষ্ট্রগুলো তাদের নিজেদের মতো করে অন্যান্য দেশ বা ব্লকের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে।

এই নমনীয়তা সদস্যদের নিজস্ব স্বার্থ অনুসরণ করতে এবং আসিয়ান সংহতি বজায় রেখে বিভিন্ন অংশীদারি ও চুক্তির সন্ধান করতে সক্ষম করে।

আরও পড়ুন

গত বছরের মে মাসে জো বাইডেনের প্রশাসন ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক ফর প্রসপারিটি (আইপিইএফ) নামে নতুন একটি আঞ্চলিক গ্রুপের উদ্বোধন করেছে। কিন্তু সেটিতে বিভক্তি দেখা যাচ্ছে। কারণ, তাতে সাতটি আসিয়ান দেশকে রাখা হলেও কম্বোডিয়া, লাওস ও মিয়ানমারকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এটি আসিয়ান সদস্যদের মধ্যে বিভক্তি বাড়াবে। এটিকে কেউ কেউ চীনের সঙ্গে আসিয়ান দেশগুলোর দ্বন্দ্ব বাধানোর পরিকল্পনার অংশ বলেও মনে করছেন।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত

  • লিলি ইয়ান ইং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব