Thank you for trying Sticky AMP!!

চর ভাঙে, ভবন ভাঙে, ভাঙে না কেবল নির্মাণের নিয়ম

ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে বিলীন হয়েছে নয়ারহাট স্কুল অ্যান্ড কলেজ

সর্বহারা হইলাম তবু/ শেষ হইল না আশা/ আবার আমি ঘর বান্ধিলাম/ সে ছিল দর আশা।/ আবার যখন ভাঙা দিল আমার সব ভাসাইয়া নিল রে/ কেউ কোনো দিন ঘর বাইন্ধ না, বরমপুত্রের পাড়ে।—লোককবির এই গানের কথাগুলো ব্রহ্মপুত্রপারের মানুষের জন্য চিরকালীন এক সত্য।

বছর তিনেক আগে নদীতে বিলীন হলো চিলমারীর পাঁচ কোটি টাকার নটারকান্দি হাইস্কুল ভবন। কদিন আগে বিলীন হলো নয়ারহাট স্কুল অ্যান্ড কলেজ। প্রতিবছরই কয়েকটি করে ভবন এভাবে নদীগর্ভে চলে যায়। আর ভবনগুলোতে ঠিকাদারদের কাজের মানও হয় সেই রকম।

শতবর্ষী স্থায়িত্ব হওয়ার কথা থাকলেও ১০–১২ বছর টিকলেই হয়। কোনো কোনোটির নিলাম ডাকার সুযোগ হয়, তখন আবার একই ঠিকাদার কিনে নেন কোনো কোনো ক্ষেত্রে। এমন কম অনুপাতে সিমেন্ট দেওয়া হয়, যাতে সহজেই ইট ও লোহা খুলে নেওয়া যায়।

বর্ষার পরপরই ব্রহ্মপুত্রের চিলমারী ইউনিয়ন, অষ্টমীরচর ও নয়ারহাটে প্রায় ১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হবে। পরিণতি কী হবে, সবাই জানি। কুড়িগ্রামের পাঁচ ভাগের এক ভাগ এই চরাঞ্চলে নদ–নদীর গর্ভে যে স্কুলগুলো নিশ্চিহ্ন হবে, সেগুলো নতুন করে চার–পাঁচ মাস ধরে নির্মিত হবে প্রথমে টিন ও কংক্রিটের খুঁটি দিয়ে। তত দিনে লেখাপড়া? স্কুলঘর ভাঙার সঙ্গে আওতাধীন এলাকার শিক্ষার্থীদের বাড়িও আরেক চরে চলে যাবে। যে কটি শিক্ষার্থী থাকবে, তাদের নিয়ে কারও বাড়ির আঙিনায় ক্লাস চলবে।

কোথাও গাছের তলে। আর স্কুল কোথায় হবে—এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে নানা ষড়যন্ত্র হবে। উল্লেখ্য, নটারকান্দি হাইস্কুলটি ভাঙার পর দুই চরে দুটি ভবন হয়েছে। বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা একটি চরের ভবনে আর মানবিক ও বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা একই স্কুলের আরেকটি চরের ভবনে ক্লাস করে। দুই চরের বিশাল দুটি ভবনও এবার ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

বর্ষাকাল। এ সময় কয়েক দিনের জন্য বন্যা আসে। প্রতিটি বাড়িতেই নৌকা আছে। এই কদিন নৌকাই বাহন হয়ে ওঠে। গ্রাম ভাঙে, বিদ্যালয়সহ স্থায়ী অবকাঠামো ভেঙে যায়। বন্যা যত বড় হয়, চরগুলো তত উঁচু হয়। হিমালয় থেকে নতুন মাটি আসে। নতুন চর জেগে ওঠে। বর্ষাকালের বন্যার কয়টা দিন ছাড়া চরগুলো হলো জীবনের উৎসব।

চরে ১২ মাসে ১৩ ফসল হয়। চরের জীবন এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ। চাইলে নুন ছাড়া আর কিছুই কিনে খেতে হয় না। আবাদ ছাড়া পতিত জমিও একেকটা ফসলের মাঠ। নানা জাতের শাকে ভরপুর। চরবাসীরা চরের প্রেমে বন্দী থাকে। প্রত্যেকেই কৃষক, প্রত্যেকেই জেলে, প্রত্যেকেই মাঝি, আবার প্রত্যেকেই কারিগর, যেন কার্ল মার্ক্সের স্বয়ংসম্পূর্ণ মানব।

বছর বছর চর ভাঙে। চরের মানুষ সেভাবেই বাড়ি নির্মাণ করেন। স্থায়ী ভিটা চরবাসী শহরাঞ্চলেই বানান। এ জন্য নদীতীরবর্তী উপজেলা শহরের জনঘনত্ব কোথাও কোথাও বড় শহরের সমান। এমনকি তাঁরা সেসব গাছই রোপণ করেন, যেগুলো চর ভেঙে পড়ার আগেই ভোগ করতে পারবেন। কথিত নীতিনির্ধারক প্রকৌশল বিদ্যার্থীরা যঁাদের মূর্খ ও অশিক্ষিত বলে চিহ্নিত করেন, তাঁরা কিন্তু জীবন দিয়ে বুঝেছেন।

২.

বিজ্ঞাপনে অ্যালোভেরা আর ভিটিভারের কথা শুনি। বাংলায় যার নাম যথাক্রমে ঘৃতকুমারী আর বিন্না। ইউরোপ-আমেরিকায় বিন্না দিয়ে সুগন্ধি ক্রিম বানায়। আমাদের এখানে পাড় বাঁধা, পুকুরের পানি দূষণমুক্ত করতে ও ঝাড়ু বানাতে ব্যবহৃত হয় বিন্না। গবেষকেরা দেখিয়েছেন, বুড়িগঙ্গার দুই ধার দিয়ে বিন্না লাগালেই বুড়িগঙ্গা স্বচ্ছ হয়ে যাবে।

বিন্না প্রধানত দুই জাতের। উভয় জাতের বিন্নারই শিকড় খুব শক্ত। একটি জাত শিকড় ছড়িয়ে বৃষ্টির পানি ও বন্যা থেকে মাটি আটকায়। এগুলো ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় পাওয়া যায়। আরেকটি জাতের শিকড় সরাসরি মাটির গভীরে ২০ ফুট পর্যন্ত যায়। এগুলো শিলিগুড়ির, তিস্তার উজানে পাহাড়ি এলাকায় পাওয়া যায়। পাহাড়ের ধস ঠেকায়।

এই পাহাড়ধস ঠেকানো শিলিগুড়ি এলাকার বিন্না যদি ব্রহ্মপুত্রসহ অন্য নদ–নদীর তীর ধরে লাগানো যায়, তাহলে ভাঙনের হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমার সম্ভাবনা আছে। গবেষকেরা এ রকম দেখিয়েছেন, একটি সড়কে একটি গাছ মূলসহ ঝড়ে উপড়ে গেলে সেখানে গভীর গর্ত সৃষ্টি করে ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। সেখানে বিন্না ঘাসে এমনটা ঘটে না।

Also Read: ব্রহ্মপুত্রের চরাঞ্চল: ‘সরকারের দাবিই সঠিক, না খেয়ে কেউ মরে না’

৩.

বছর বছর চর ভাঙে। চরের মানুষ সেভাবেই বাড়ি নির্মাণ করেন। স্থায়ী ভিটা চরবাসী শহরাঞ্চলেই বানান। এ জন্য নদীতীরবর্তী উপজেলা শহরের জনঘনত্ব কোথাও কোথাও বড় শহরের সমান। এমনকি তাঁরা সেসব গাছই রোপণ করেন, যেগুলো চর ভেঙে পড়ার আগেই ভোগ করতে পারবেন। কথিত নীতিনির্ধারক প্রকৌশল বিদ্যার্থীরা যঁাদের মূর্খ ও অশিক্ষিত বলে চিহ্নিত করেন, তাঁরা কিন্তু জীবন দিয়ে বুঝেছেন। বাংলার নিজস্ব সেচব্যবস্থা বইয়ের লেখক স্যার উইলিয়াম উইলকক্সও লিখেছেন, ব্যাবিলনের জন্য যেখানে স্থায়ী সেচব্যবস্থা, সেখানে বাংলার জন্য উপযুক্ত হলো প্লাবন সেচব্যবস্থা, যা কয়েক হাজার বছর ধরে বাংলার জন্য অব্যাহত রাখা হয়েছে।

আর সেই প্লাবনভূমি বাংলাজুড়ে চলছে ইটপাথরের কাঠামো তৈরি। চলতে চলতে তা এখন ব্রহ্মপুত্র-পদ্মার চরাঞ্চলেও চলছে। ভোগবাদ আর জিডিপি বাড়ার প্রক্রিয়ায় সব সমাধান দেখতে চান যাঁরা, তাঁরা তো মুনাফা প্ররোচিত কৃত্রিম চাহিদাতেই বেহুঁশ থাকবেন।

আমাদের সবাইকে এই বিদ্যমান ব্যবস্থা একটা ফাঁদে আটকে ফেলেছে। কর্মকর্তা বদলান, চরের শিক্ষকেরা কাইমে (ডাঙায়) যান; চর ভাঙে, চরের ভবন ভাঙে, ভাঙে না কেবল ভবন নির্মাণের নিয়ম। জনগণের মাল দরিয়ামে ঢাল।

  • নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক

    nahidknowledge1@gmail.com