ব্রহ্মপুত্রের চরাঞ্চল: ‘সরকারের দাবিই সঠিক, না খেয়ে কেউ মরে না’

ব্রহ্মপুত্রের চরের মানুষ কাজ পাচ্ছেন না। অর্ধাহারে থাকতে হচ্ছে সেখানকার অনেককেই। শাকপাতা তুলে বাজারে বিক্রি করেও চলতে হয় অনেককে।
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

দেশ স্বাধীনের পরপরই রফিক আজাদ লিখেছিলেন, ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতা। আশির দশকে সিনেমার নাম ছিল ‘ভাত দে’।

১০ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনের শিরোনাম, ‘দরিদ্রদের আয়ের ৪৮% ব্যয় হয় খাদ্যে’। এমনটা জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা স্টার্ট ফান্ড নেটওয়ার্ক।

বাংলাদেশের দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোর বাসিন্দাদের অর্থনৈতিক অবস্থা, দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও প্রয়োজনের তুলনায় কী পরিমাণ সহায়তা তাঁরা পান, এ তিন ক্ষেত্রে গবেষণা করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের চর এলাকার দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবারগুলোর মোট আয়ের ৩৯ থেকে ৪৮ শতাংশ ব্যয় হয় খাবার কেনায়। ঋণ পরিশোধে যায় ১৩ থেকে ২০ শতাংশ। কৃষিকাজের উপকরণ বাবদ ব্যয় হয় ১১ শতাংশ এবং শিক্ষা, যাতায়াত ও পোশাক—এ তিন খাতে তারা ব্যয় করে আয়ের মাত্র ৪ থেকে ৬ শতাংশ।

আরও পড়ুন

পরিবারগুলোর আয় কত? গবেষণাটি বলছে, নদীতীরবর্তী এলাকার হতদরিদ্র পরিবারগুলোর বার্ষিক আয় ১ লাখ ১০ হাজার টাকা আর দরিদ্র পরিবারগুলোর সারা বছরের আয় ১ লাখ ৩২ হাজার ৪৫০ টাকা। হতদরিদ্রদের টাকাগুলোর মধ্যে শ্রম থেকে আসে যথাক্রমে ৫৩ দশমিক ৫ শতাংশ আর দরিদ্রদের ৪২ শতাংশ। ২০২০ সালে আঘাত হানা বন্যার ক্ষয়ক্ষতি চরের হতদরিদ্র ও দরিদ্র ব্যক্তিরা কাটিয়ে উঠেছেন যথাক্রমে ৩৮ ও ২৭ শতাংশ। নদীর পাড়ের হতদরিদ্র ও দরিদ্র ব্যক্তিরা যথাক্রমে ৫০ ও ৩১ শতাংশ। অর্থাৎ তাঁদের আর্থিক অবস্থা দিন দিন অবনতি হচ্ছে।

২০২০ সালে প্রকাশিত বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক সারণিতে দেখা যায়, বাংলাদেশের ৬ দশমিক ৫ শতাংশ অতি তীব্র বহুমাত্রিক দারিদ্র্যে আর ১৮ দশমিক ২ শতাংশ ঝুঁকিতে আছে। মোট ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। আর কুড়িগ্রামে এটি ৭০ শতাংশের কাছাকাছি।

উন্নয়ন মডেলে ব্যক্তির নিজ জন্মস্থানে বেড়ে ওঠা, শিক্ষা নেওয়া, শ্রম বিনিয়োগ করার, উৎপাদন করার, সেবা ও বিনোদন পাওয়ার সুযোগ রাখতে হবে। ঢাকায় না গিয়েও যেন তা পেতে পারেন। গণপরিবহনে চড়ে কর্মস্থল থেকে দিন শেষে ফিরে আসতে পারেন নিজ আবাসে, তার উপযোগী নৌ-রেল-সড়ক নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে। যেমন শুধু ঘাট খাজনার জন্য নৌব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেল। ঘাট খাজনার কারণেই চরের প্রতিটি পরিবারের (পাঁচ সদস্যের) বার্ষিক খরচ হয় গড়ে ১৫ হাজার টাকা। ১ লাখ ১০ হাজার টাকা বার্ষিক আয় থেকে ঘাট খাজনাই যায় ১৫ হাজার টাকা।

আরও পড়ুন

২.

বেলা দুইটা। ২৩ অক্টোবর, ২০২২। এই পাড়ার সবারই একটি ঘরেই চার থেকে পাঁচ সদস্যের পরিবারের থাকা। সবারই হাড়জিরজিরে শরীর। সবারই পেট হাড়ের খাঁচার ভেতর। মাথা নিচু করেই পাড়ায় ঢুকতে হয়। দেখা হলো সবিতা রানী (৮০) ও সব্যে রানীর (৬৫) সঙ্গে। মা ও মেয়ে। হেলে পড়া একটি ঘরের সামনে থুতনিতে হাত দিয়ে বসে আছেন। পাশে বেশ কিছু মাটির হাঁড়ি ও কলস।

: গত এক সপ্তাহ কেমন করে চলল আপনার সংসার?
: চইলবে আর কেমন করি? এই টুকটাক করি চইলবের নাইগছে। কাজকামাই নাই, মাটি নাই। খড়িখেড় নাই, খড়িখেড়ের দাম হয়া গেইছে। চাউল-ডাউলের দাম হয়া গেইছে, আনাজের দাম বেশি হয়া গেইছে। গরিব মানুষ বাঁচি কেমন করি?
: কয়বেলা করি খান?
: খাই তো দুইবেলা কোনোমতে...
: এর মধ্যে কোনো চেয়ারম্যান-মেম্বার আসে নাই?
: আগে কোকিল মেম্বর আছিল, তখন এক সার, দুই সার পাছিলেম। এলা কোকিল মেম্বর বাদ হইছে। এলা এক সার ক্যা, আধা সেরও পাই না। এক পোয়াও পাই না। এই যে প্রতিবন্ধীর টাকা দেয়, ওইগলে হামরা কিছু পাইনে। বয়স্ক ভাতারও টাকা পাই না। মাইনষক টেকাটুকে দিবের লাইগছে, হামরা কিছু পাইনে। ভোটের তালিকা আছে, খাবারের তালিকা নাই।

‘আসলে পরিস্থিতি হয়ে উঠেছিল খুব খারাপ। দুর্ভিক্ষ, আকাল, মঙ্গা, বন্যাপরবর্তী দুর্গতি, যা-ই বলুন মানুষ মরেছে। মরেছে দীর্ঘদিনের অনাহার-অর্ধাহারজনিত অপুষ্টিতে। না খেয়ে তো আর কেউ মরে না। খায়। শূন্য জঠরে গুরুপাক কিছু খায়, প্রধান খাদ্য হিসেবে কলাগাছ, কচুরমুড়ো, মাছালু, শাকপাতা সেদ্ধ খায়, মৃত্যুর আগে ঈশ্বরের নাম জপার সময় পানি খায় অন্তত একটুখানি। সে ক্ষেত্রে, সরকারের দাবিই সঠিক। না খেয়ে কেউ মরে না।’

৩.

সময়টা ১৯৮১ সাল। চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন চিলমারীতে এসেছেন। সরেজমিন দেখবেন চরের মানুষেরা কীভাবে জীবন যাপন করে। থানা সদর থেকে মাইল পনেরো দূরের একটি চর বেছে নিলেন। এদের মধ্যে একটি পরিবারের হাতে মোটা পরিমাণ এবং তিনটি পরিবারের মালিকানায় সামান্য জমি আছে। বাকি সবাই ভূমিহীন। মাত্র একটি করে কুঁড়েঘর। বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য একটি বাড়িতে থাকা টিউবওয়েলই সম্বল। তা থেকে কাউকে পানি নিতে দেওয়া হয় না। বর্ষা মৌসুমে ব্রহ্মপুত্রের পানি পান করে তারা, শুকনো মৌসুমে প্রায় কারবালার দশায় থাকে। মলমূত্র ত্যাগ করে ওরা খোলা জায়গায়। ঘরে ঘরে কৃমি, অপুষ্টি, রাতকানা ও চর্মরোগ। শুনলেন, মজুর পরিবারগুলোর অনেকেই মঙ্গার সময় মধুয়ার গোড়া চিবিয়ে রস খায়, খায় বালুতে জন্মানো একধরনের ঘাসের গোড়ার ক্ষুদ্রকার মূল, যাকে বলে ‘কেশুর’।

‘আসলে পরিস্থিতি হয়ে উঠেছিল খুব খারাপ। দুর্ভিক্ষ, আকাল, মঙ্গা, বন্যাপরবর্তী দুর্গতি, যা-ই বলুন মানুষ মরেছে। মরেছে দীর্ঘদিনের অনাহার-অর্ধাহারজনিত অপুষ্টিতে। না খেয়ে তো আর কেউ মরে না। খায়। শূন্য জঠরে গুরুপাক কিছু খায়, প্রধান খাদ্য হিসেবে কলাগাছ, কচুরমুড়ো, মাছালু, শাকপাতা সেদ্ধ খায়, মৃত্যুর আগে ঈশ্বরের নাম জপার সময় পানি খায় অন্তত একটুখানি। সে ক্ষেত্রে, সরকারের দাবিই সঠিক। না খেয়ে কেউ মরে না।’ —কথাগুলো মোনাজাতউদ্দিনের।

তারপর ১৯৯১ সালে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার নোহালী ও আলমবিদিতরে এল মার্কিন সিনেট-পত্নী ও ডা. জনসনের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের স্বাস্থ্যকর্মীর দল। অভিজ্ঞ ডা. জনসন নোহালীতে নেমেই রোগী পরীক্ষায় নামলেন। পরীক্ষার পর তাঁর টাস্কি খাওয়ার দশা। বারবার বলতে লাগলেন, এরা তো সব ম্যালনিউট্রেশনের রোগী! স্যালাইন বা ওষুধ এদের দরকার নেই, এদের খাবার দিতে হবে, পুষ্টিকর খাবার।