Thank you for trying Sticky AMP!!

মনোযোগ হরহামেশাই প্রতিভাকে হার মানায়

লন্ডনে আমাদের বাড়ি থেকে হাঁটাপথ। পাড়ার লাইব্রেরি। পৃথিবীর অনেক জায়গায় লাইব্রেরির সংখ্যা কমে গেলেও লন্ডনে এখনো অনেক লাইব্রেরির টিকে আছে। বেড়েছে ব্যবহারের বহুমাত্রিকতা। শনিবার সকালে নিয়ম করে মেয়েকে নিয়ে যেতে হয়। আঁকার ক্লাস। দেড় ঘণ্টা। কয়েকজন শিল্পী নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন বয়সের ছেলেমেয়েদের ছবি আঁকা শেখান। হঠাৎ একদিন উদ্যোক্তাদের একজন বললেন, তোমার মেয়েসহ আরও কয়েকজনকে আমরা বড়দের সঙ্গে শেখাতে চাই। আমার মেয়ের বয়স পাঁচ।

আমি নিশ্চিত, সমবয়সী অনেকে হয়তো ওর চেয়ে ভালো আঁকে। কারণটা শুনে আমি চমকে গেলাম। কে কেমন আঁকে, সেটা একমাত্র বিচার্য নয়। চার থেকে পাঁচ বছরের এই কয়েকজন খুদে নাকি দেড় ঘণ্টা ধরে মনোযোগ দিয়ে ছবি আঁকে। রংতুলি আর ক্যানভাসেই তাদের চোখটা পড়ে থাকে। বলা হলো, ছবি আঁকা শিখতে প্রতিভার থেকেও প্রয়োজন ফোকাস বা অখণ্ড মনোযোগ।

আসলেই তা-ই। শুধু ছবি আঁকা কেন, যেকোনো কিছু ভালোভাবে করতে, শিখতে অখণ্ড মনোযোগের কোনো বিকল্প নেই।

অ্যান্ড্রু ব্লাক আমার একসময়ের সহকর্মী। বহু বছর নামকরা কনসালটিং কোম্পানিতে কাজ করে নিজের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। মাত্র সাত বছরে কোম্পানির বাজারমূল্য হয়েছিল দুই হাজার কোটি টাকার ওপরে। প্রতিবেদন লেখাই হোক বা পড়া, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অ্যান্ড্রু একান্ত মনে তা করে যেতেন। মাঝেমধ্যে শুধু উঠতেন নিজের কফি বানানোর জন্য। শত পাতার প্রতিবেদন অ্যান্ড্রুর হাতে গেলে দাঁড়ি-কমা-সেমিকোলনের ভুলও তাঁর চোখ এড়াত না।

বিশ্বের প্রথম সারির ১০টি ওষুধ কোম্পানির প্রায় সক কটিই তখন আমাদের সেবাগ্রহীতা। গবেষণা থেকে বিতরণ। আমরা তখন তাদের পরামর্শক। ব্যবসা বাড়ছে। লোকবলের প্রয়োজন। ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র আর ভারতের সব নামকরা প্রতিষ্ঠান থেকে আমরা লোক নিয়োগ করছি। ইউরোপ ও আমেরিকাতে অনেক কাজে শিক্ষানবিশ সময় তিন থেকে ছয় মাস। অ্যান্ড্রু আমাকে বলেছিলেন, স্থায়ী নিয়োগের আগে প্রার্থীদের মনঃসংযোগের বিষয়টি আমলে নিয়ো। কাজে ফোকাস থাকলে বাকিটা শিখিয়ে নিতে পারবে।

মনঃসংযোগ বাড়ানোর বিভিন্ন উপায় নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, কাজের সময় মনঃসংযোগ নষ্ট করে—এমন জিনিস, যেমন মুঠোফোন দূরে সরে সরিয়ে রাখা উচিত। একসঙ্গে একাধিক নয়, একটি কাজ করতে হবে। নিয়মিত শরীরচর্চা এবং প্রকৃতির সঙ্গে যোগাযোগও মনঃসংযোগ বাড়াতে সাহায্য করে। একটা কাজ একটানা অনেকক্ষণ না করে নিয়মিত বিরতি নিয়ে করলে কাজের গুণগত মান ও মনোযোগ—দুটিই বাড়ে।

Also Read: জানালাগুলো খুলতেই হবে, অন্তত চোখের আর মনের

বিশ্বের প্রথম সারির বেশ কিছু কোম্পানির সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, ফোকাস প্রতিভাকে হরহামেশা হার মানায়। ভারতের সাবেক ব্যাটসম্যান বিনোদ কাম্বলির কথা মনে আছে? শচীনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু করলেও শুধু ফোকাসের অভাবে হারিয়ে গেলেন।

নিরবচ্ছিন্ন মনঃসংযোগ ছাড়া ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক বা রাষ্ট্রের সমস্যার শ্রেষ্ঠ সমাধান বের করা সম্ভব নয়।

বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি ওয়ারেন বাফেট। একদম সাদামাঠা জীবনধারণের জন্য বিখ্যাত। এক সাক্ষাৎকার বলেছিলেন, একটানা বেশ কয়েক ঘণ্টা তিনি যেকোনো বিষয়ে মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন। প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিবেদন পড়া তাঁর দৈনন্দিন কাজের একটি বড় অংশ। বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে তাঁর বিখ্যাত উক্তি, যে কোম্পানির কোনো ফোকাস নেই, সে কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা উচিত নয়।

ইলন মাস্কের মনঃসংযোগও ঘণ্টার ওপরে। পত্রিকায় প্রকাশ, মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস অনায়াসে অন্তত এক ঘণ্টা যেকোনো বিষয়ে নিরবচ্ছিন্ন মনঃসংযোগ করতে পারেন।

Also Read: আপনি কাদের চেনেন তার থেকে জরুরি, আপনাকে কজন চেনেন

অ্যাটেনশন ইকোনমি বা মনোযোগ অর্থনীতির এই যুগে ফোকাস এক অতি দুর্লভ বস্তু। আপনি, আমি, ছোট-বড়, করপোরেট, আদা থেকে জাহাজের কারবারি। ঘরে-বাইরে। সবাই মনোযোগ পেতে ব্যস্ত।

সাংঘাতিক এক প্রতিযোগিতা। নিরন্তর। প্রতিদিন নিত্যনতুন কৌশল বের হচ্ছে। প্রযুক্তির কল্যাণে। এ বলছে আমায় দেখো, ও বলছে আমাকে। এ বলছে আমারটা শোনো, ও বলছে আমারটা না শুনলে পিছিয়ে গেলে, সমাজে তোমার আর কোনো মানই রইল না। বিজ্ঞান, বাণিজ্য আর বিপণনের কত শাখা গড়ে উঠছে এই মনোযোগকে কেন্দ্র করে। মনোযোগের বাজারমূল্য অনেক। আমি, আপনি অধিকাংশই আমরা এখন বিনা মূল্যের শ্রমিক। আমাদের অতি মূল্যবান মনঃসংযোগ অন্যকে দিচ্ছি। বিনা মূল্যের শ্রমঘণ্টার এই পরিমাণ চক্রাকারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

একটা বইয়ের বা যেকোনো প্রতিবেদনের অনেকগুলো পাতা একনাগাড়ে কবে শেষ করেছেন? লিখতে গিয়েও একই অবস্থা। কয়েক লাইন লেখার পরই থেমে যেতে হচ্ছে। ভাবতে গেলেও তা-ই। ভাবনাগুলো দীর্ঘ আর গভীর হওয়ার আগেই অন্য ভাবনা এসে জায়গা করে নিচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে আগেরটি। হয়তো আপনি পারছেন। কিন্তু অনেকেই পারছেন না।

Also Read: অন্যের কথা শোনার সদিচ্ছা ও চর্চা কেন প্রয়োজন

সামগ্রিকভাবে আমাদের মনঃসংযোগ কমতে শুরু করেছে। মাইক্রোসফটের অর্থায়নে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০০ সালে একজন মানুষ কোনো বিষয়ে একটানা গড়পড়তায় ১২ সেকেন্ড মনঃসংযোগ করতে পারতেন। ২০১৫ সালে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮ সেকেন্ডে।

ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন, কাজের জায়গাতে কোনোভাবেই কর্মীরা একটানা ৭৫ সেকেন্ডের বেশি কম্পিউটারের একই স্ক্রিনে মনঃসংযোগ করতে পারছে না। কোন কিছু টাইপ করতে গিয়ে এক ওয়েবসাইট থেকে কিছুক্ষণ পরেই আরেক ওয়েবসাইটে চলে যাচ্ছেন।

মুঠোফোন আর সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমের অতি ব্যবহার এর প্রধান কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক এক আমেরিকান গবেষণায় দেখা গেছে, দৈনিক গড়ে চার ঘণ্টা একজন মানুষ মুঠোফোনে চোখ রাখছেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে, ঘুমোতে যাওয়ার আগে, এমনকি ঘুম থেকে জেগে, মধ্যরাতে ফোনে চোখ পড়ছে। দৈনিক গড়ে ৮৫ বার একজন মানুষ মুঠোফোনের সংস্পর্শে আসেন।

Also Read: ৮০/২০: লক্ষ্য অর্জনে যে সূত্র আপনাকে পথ দেখাতে পারে

আগামীর জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে জায়গা করে নিতে হলে মনোযোগ ধরে রাখাটা অত্যন্ত জরুরি।

মনঃসংযোগ বাড়ানোর বিভিন্ন উপায় নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, কাজের সময় মনঃসংযোগ নষ্ট করে—এমন জিনিস, যেমন মুঠোফোন দূরে সরে সরিয়ে রাখা উচিত। একসঙ্গে একাধিক নয়, একটি কাজ করতে হবে। নিয়মিত শরীরচর্চা এবং প্রকৃতির সঙ্গে যোগাযোগও মনঃসংযোগ বাড়াতে সাহায্য করে। একটা কাজ একটানা অনেকক্ষণ না করে নিয়মিত বিরতি নিয়ে করলে কাজের গুণগত মান ও মনোযোগ—দুটিই বাড়ে। মনোবিজ্ঞানীদের একটা অংশ বলছেন, মাঝেমধ্যে দিবাস্বপ্ন দেখা মনঃসংযোগ বাড়াতে সাহায্য করে। সঙ্গে প্রাণখুলে হাসা। কারও দরকার নিঃশব্দ পরিবেশ, কারও-বা কোলাহল। ‘হ্যারি পটার’-এর বিখ্যাত লেখক জে কে রাউলিং এডিনবরার ক্যাফে এলিফ্যান্ট হাউসে বসে লিখতেন।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, একটু একটু করে মনোযোগ বাড়াতে হয়। একবার প্রক্রিয়াটা শুরু হলেই হলো। বেড়েই চলবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে যত দ্রুত আমাদের মনোযোগ সমাজের দিকে ফিরে আসে ততই মঙ্গল।

  • ড. সুব্রত বোস প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট
    Subratabose01@yahoo.com