৮০/২০: লক্ষ্য অর্জনে যে সূত্র আপনাকে পথ দেখাতে পারে

পিন্টারেস্ট থেকে সংগৃহীত

বছর কয়েক আগে। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে এক রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিলাম। অন্দরসজ্জা একদমই সাদামাটা। কাঠের চেয়ার-টেবিল। কিন্তু বেশ নামডাক। ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে লেখা মেনু। তালিকায় মাত্র কয়েকটি পদ। কারণ জানতে চাইলাম। ম্যানেজার বললেন, তাঁদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, মেনুর তালিকা দীর্ঘ করলেও অধিকাংশ লোক ঘুরেফিরে মাত্র কয়েকটি খাবারই পছন্দ করে। সে জন্যই তাঁরা মেনুকে ঢেলে ছোট করে সাজিয়েছেন। ভাবছিলাম, জেনে বা না জেনেই ম্যানেজমেন্টের দারুণ এক তত্ত্ব রেস্তোরাঁমালিক ব্যবহার করেছেন।

‘৮০/২০’ রুল। অর্থনীতি, ম্যানেজমেন্ট, চলতি ঘটনা, এমনকি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুই, শতবর্ষ পুরোনো এই ৮০/২০ রুল দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। সূত্রটির মর্মার্থ হলো ৮০ শতাংশ ফলাফল এসে থাকে ২০ শতাংশের চেষ্টায়। সহজ উদাহরণ দিয়ে শুরু করি। আপনি ব্যবসা করেন। আপনার ক্রেতার সংখ্যা অনেক। এই তত্ত্বমতে, কোনো ব্যবসায় মোট বিক্রির মোটামুটি ৮০ শতাংশই আসে ২০ শতাংশ ক্রেতার কাছ থেকে বা মাত্র ২০ শতাংশ পণ্য থেকে। আপনার অফিসেও হয়তো মোট কাজের ৮০ শতাংশ মাত্র ২০ শতাংশ লোক করছেন। অফিসে ৮০ শতাংশ ঝামেলার মূলেও কিন্তু মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ। আপনার ১০টি জামা আছে, কিন্তু দেখবেন, ঘুরেফিরে আপনি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুই বা তিনটি জামা ব্যবহার করেন।

বিশ্বজুড়ে অনেক সিনেমা বানানো হয় প্রতিবছর। কিন্তু হিসাব করলে দেখা যাবে, সিনেমার মোট আয়ের ৮০ শতাংশই আসে মাত্র ২০ শতাংশ পরিচালকের সিনেমা থেকে। ভিলফ্রেডো প্যারিটো নামের ইতালিয়ান এক অর্থনীতিবিদ এই তত্ত্বের প্রবক্তা। কোনো এক গ্রীষ্মে বাড়ির বাগানে মটরশুঁটির উৎপাদন দেখে তিনি বেশ আশ্চর্য হয়ে যান। মোট ফলনের প্রায় ৮০ শতাংশ এসেছে মাত্র ২০ শতাংশ মটরশুঁটিগাছ থেকে। এই অনুপাত অন্য কোনো ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি না, সেটা দেখার জন্য তিনি গবেষণা শুরু করেন। ১৮৯৬ সালে প্যারিটো প্রমাণ করেন, ইতালির মোট জনসংখ্যার মাত্র ২০ শতাংশ দেশটির ৮০ শতাংশ জমির মালিক।

আমেরিকার অর্থনীতিবিদ এডওয়ার্ড উলফ ২০০৭ সালে দেখিয়েছেন, আমেরিকার ২০ শতাংশ মানুষ দেশটির মোট সম্পদের ৮৫ শতাংশের মালিক। এ বছরে প্যারিস থেকে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাত্র ১০ শতাংশ ব্যক্তির হাতে পৃথিবীর ৭৬ শতাংশ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ। বিভিন্ন দেশ ও শহরে দেখা গেছে, ৮০ শতাংশ অপরাধ করে মাত্র ২০ শতাংশ অপরাধী। বেশ কয়েক বছর আগে মাইক্রোসফট জানিয়েছিল, তাদের সফটওয়্যারের ৮০ শতাংশ সমস্যার মূলে আছে ২০ শতাংশ কোড। গত বছরে আমেরিকায় বেসবলের টুর্নামেন্টগুলোয় ৮৫ শতাংশ জয়ের পেছনে অবদান রেখেছেন মাত্র ১৫ শতাংশ খেলোয়াড়। ক্রিকেট বা ফুটবলেও একই চিত্র পাওয়া যাবে।

পেশাগত জীবনের একটা বড় সময় ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট ছিলাম। ইউরোপ, আমেরিকার ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সমাধানে আমাদের ডাক পড়ত। এ রকমই এক প্রজেক্ট। বিশ্বের অন্যতম ওষুধ কোম্পানি। বিভিন্ন দেশে এদের গবেষণাগার রয়েছে। সমস্যা হলো হাতে গোনা কয়েকটা গবেষণাগারে নিয়মিত নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। চাকরি পরিবর্তনের হার অন্য জায়গা থেকে বেশি। একই ধরনের গবেষণার জন্য অন্য জায়গা থেকে এসব গবেষণাগারের খরচটাও বেশি। সঙ্গে গবেষণার যন্ত্রপাতিও নষ্ট হচ্ছে দ্রুত।

১০ বছরের পুরোনো সব ডেটা অ্যানালাইসিস করার পর আমরা অবাক। ওই কোম্পানির গবেষণাসংক্রান্ত সাফল্যের প্রায় ৭৪ শতাংশ এসেছে এই গবেষণাগারগুলো থেকে, যা কিনা মোট গবেষণাগারের ২৮ শতাংশের মতো। এখানকার বিজ্ঞানীরা অন্য গবেষণাগারগুলো থেকে বেশি সক্রিয়। মাথাপিছু প্রজেক্টের সংখ্যাও বেশি। জনবলও অন্য জায়গা থেকে তুলনামূলকভাবে বেশি। প্রজেক্ট বেশি হলে বাজেটও বেশি হওয়া দরকার। আর কাজ বেশি হলে যন্ত্রপাতি দ্রুত নষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও বেশি।

প্যারিটোর এই সূত্র দৈনন্দিন জীবনেও অনেকভাবে কাজে লাগানো যায়। আমাদের সবারই স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে একাধিক লক্ষ্য থাকে। লক্ষ্যগুলো থেকে মাত্র গুটি কয়েক বেছে নিন, যেগুলো আপনি সত্যিকার অর্থে অর্জন করতে চান, যেগুলো না হলে চলবে না। হাতে থাকা সময়ের ৮০ শতাংশ ওই লক্ষ্য অর্জনে দিন। সাফল্যের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে।

আপনার অনেক বন্ধু আছে। কিন্তু আপনি দেখেছেন মাত্র কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গ আপনার ভালো লাগে। বিপদে তারা আপনার পাশে থাকে বা তাদের কাছ থেকে আপনি কিছু শিখতে পারেন। অন্যের সঙ্গে মেশা কমিয়ে এই স্বল্পসংখ্যক বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক আরও গাঢ় করার চেষ্টা করতে পারেন। আরও বেশি সময় কাটাতে পারেন। পেশাগত জীবনে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে নেটওয়ার্ক তৈরি হয়। সময় এবং সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে এই নেটওয়ার্ক বাড়তে থাকে। এই নেটওয়ার্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ২০ শতাংশকে চিহ্নিত করে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য বা সম্পর্ক রক্ষার জন্য বেশি সময় দিতে হবে।

অনেক সময় অফিসে একাধিক কাজের মধ্যে অগ্রাধিকার দেওয়া সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কাজগুলো থেকে গুরুত্ব বিবেচনায় কয়েকটিকে বেছে নিন। এরপর আপনার সময়ের অন্তত ৮০ শতাংশ ব্যয় করুন ওই কাজগুলো ভালোভাবে শেষ করতে। সাম্প্রতিক এক আমেরিকান গবেষণায় দেখা গেছে, দৈনিক গড়ে চার ঘণ্টা একজন মানুষ মুঠোফোনে চোখ রাখছেন। ৮০/২০ রুল ব্যবহার করলে দেখা যাবে, এই চার ঘণ্টার হয়তো মাত্র ২০ শতাংশ সময় অর্থাৎ ৪৮ মিনিটের মতো আমরা প্রয়োজনীয় কাজে ব্যয় করছি। অর্থাৎ অনায়াসে তিন ঘণ্টার বেশি সময় আপনি অন্য প্রয়োজনীয় কাজে ব্যয় করতে পারবেন।

আপনি হয়তো চাকরি খুঁজছেন। একাধিক কোম্পানিতে সিভি পাঠিয়েছেন। কয়েকটা ইন্টারভিউতে শেষ ধাপে গেছেন। অনেকগুলো থেকে কোনো সাড়াই আসেনি। আশাহত না হয়ে যে কোম্পানিগুলো থেকে আপনাকে ইন্টারভিউতে ডেকেছে, সেই ধরনের কোম্পানিগুলো বা একই ধরনের চাকরির জন্য আবেদন করতে থাকুন। ব্যবসার অনেক সমস্যা খুঁজতে এবং সমাধানে ৮০/২০ রুল প্রয়োগ করা যেতে পারে।

যেকোনো কোম্পানির ৮০ শতাংশ সমস্যার মূলে রয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ ইস্যু। এই ২০ শতাংশ ইস্যুর মোকাবিলায় ৮০ শতাংশ সময়ের বরাদ্দ দেওয়া উচিত। যেসব পণ্য থেকে ব্যবসার মোট বিক্রির ৮০ শতাংশ আসে, সেসব পণ্যের বিক্রি কীভাবে বাড়ানো যায়, তা নিয়ে ভাবুন। ক্রেতাদের অসন্তুষ্টির দিকে নজর দিন। দেখবেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্রেতারা একই ধরনের কারণের জন্য অসন্তুষ্ট। মার্কেটিংয়ের বিভিন্ন পন্থা নিয়েছেন। দেখবেন মাত্র গুটিকয়েক মার্কেটিং পন্থা কার্যকর হয়েছে।

বলে রাখা ভালো, এই তত্ত্ব অনেক ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে না। আবার হলেও আক্ষরিক অর্থে হয়তো মিলবে না।

ড. সুব্রত বোস প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট