Thank you for trying Sticky AMP!!

নদীর লবণাক্ততা চট্টগ্রামের আরেক দুর্যোগ

কয়েক সপ্তাহ ধরে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন স্থানে ওয়াসার পানি–সংকট চরমে। আবার যেটুকু আসছে, লবণাক্ততার কারণে সেটুকুও মুখে তোলার জো নেই। যাঁদের বাড়িতে গভীর নলকূপ রয়েছে, সেসব বাড়িতে পানি নিতে কলসি দিয়ে লাইন ধরেন অনেকেই। চট্টগ্রাম নগরের হালিশহর এলাকা।

বৈশাখের এক উত্তপ্ত দিনে গ্রামের বাড়ির পুকুরের ঘাটে হাঁটু পর্যন্ত নেমে আঁজলা ভরে পানি নিয়ে একটু মুখে দিতেই খটকা লাগল। পানি লবণাক্ত মনে হলো। সাগরপাড়ের বাড়িঘরগুলোতে এমন হয়। চট্টগ্রামের পটিয়া থানার মনসা গ্রামের পুকুরের পানির কেন এমন স্বাদ? একটু পর খেয়াল করলাম, পুকুরটির সঙ্গে খালের সংযোগ আছে। খালের নাম গুরুলুটা। এটি কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে লবণদোষে দূষিত কর্ণফুলীও তো তার দীর্ঘ চলার পথ শেষ করেছে বঙ্গোপসাগরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এবার বুঝলাম, দূর সাগরের লবণ কীভাবে গ্রামের পুকুরের ভেতর অনুপ্রবেশ করেছে।

এবারের গ্রীষ্মের এটাই এখন সবচেয়ে বড় সংকট চট্টগ্রামের মানুষদের জন্য। চারপাশের পরিবেশ-প্রতিবেশকে পাল্টে দিচ্ছে লবণ। লবণের কারণে বোরো চাষ ব্যাহত হয়েছে। গ্রীষ্মের আউশ চাষ নিয়েও চিন্তিত অনেকে। বৃষ্টি না হলে লবণমিশ্রিত পানি ক্রমে নদীর উজান দখল করতে থাকবে। আর চাষাবাদ ব্যাহত হবে। নদীর জলজ প্রাণীর জন্য হুমকি হয়ে উঠবে। উদ্ভিদশ্রেণি বিপন্ন হবে। প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। কর্ণফুলীর লবণ এ জন্যই আমাদের চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে।

চট্টগ্রাম মহানগরের লাখ লাখ অধিবাসীর ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে লবণ। মার্চের শেষ দিক থেকে পানি কর্ণফুলী দখল করতে শুরু করেছে লবণ। দখলদারি দিন দিন বাড়ছে। এ কারণে ওয়াসার পানিও লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। মানুষের অভিযোগ, ওয়াসার পানি মুখে নেওয়া যাচ্ছে না। এমনিতে গরমে অতিষ্ঠ নগরবাসী। তার ওপর পানির এই সংকট মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো।

চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে লবণ বাড়ার প্রবণতা কোনো নতুন সমস্যা নয়। ১০-২০ বছর আগে থেকে এই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। কিন্তু ওয়াসা কখনো সমস্যাটিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। ওয়াসা নতুন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় শুষ্ক মৌসুমে পানি লবণাক্ত হয়ে যাওয়ার বিষয়টি উপেক্ষা করেছে।

গরম যত বাড়ছে, ততই পানিতে লবণ বাড়ছে। বাড়ছে হাহাকার। লবণ বেড়ে যাওয়ার কারণে ওয়াসার পানি উৎপাদনও কমে গেছে। ফলে নগরে পানি সরবরাহও কমে গেছে। অনেক এলাকায় ওয়াসার পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে খতিবের হাট, বহদ্দারহাট, খাজা রোড, বহদ্দারহাট কাঁচাবাজার, কর্নেলহাট, সিডিএ আবাসিক এলাকা, বাদুরতলা, এ কে খান এলাকা, পশ্চিম ফিরোজ শাহ, উত্তর কাট্টলী, সিটি গেট, আগ্রাবাদ, মুহুরি পাড়া ও লালখান বাজারে এই সংকট তীব্র। যেখানে পানি পাওয়া যাচ্ছে, তবে তা লবণাক্ত। এসব পানিতে অসুস্থ হচ্ছেন অনেকেই।

মানুষ টাকা দিয়ে বাজার থেকে সুপেয় পানি কিনছে। কিন্তু গৃহস্থালিসহ দৈনন্দিন কাজে পানির অভাব মেটানো যাচ্ছে না। ভোগান্তির মাত্রা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। এসব চট্টগ্রাম নগরে জরুরিভাবে সুপেয় পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন দেশের ক্রেতা-ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগ ও নগর কমিটি। ক্যাবের নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, চট্টগ্রামে সুপেয় পানির ভয়াবহ সংকটে অতিষ্ঠ জনজীবন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

সমস্যার মূল কারণ, বৃষ্টিহীনতা বলে উল্লেখ করছে ওয়াসা। বৃষ্টির না হওয়ায় কাপ্তাই হ্রদের পানির স্তর নেমে গেছে। এ কারণে হ্রদের পানি ছাড়া হচ্ছে না। ফলে কর্ণফুলী ও হালদা নদীতে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে উজানের দিকে উঠে যাচ্ছে। ওয়াসার পানি উৎপাদনের ক্ষেত্রগুলোতেও পাওয়া গেল লবণাক্ততা। বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত এ সংকটের সমাধান হবে না। পানির এই ভয়াবহ সংকট একধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

আমরা বরাবরই প্রকৃতির খেয়ালের ক্রীড়নক। এখন বৃষ্টি কখন আসবে, তার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের কিছুই করার নেই? পৃথিবীর বহু সমুদ্রবেষ্টিত দেশ লোনাপানির সংকট মোকাবিলা কীভাবে করছে, সমুদ্রের পানিকে সুপেয় পানিতে পরিণত করছে। মরুময় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যেখানে মিঠাপানির উৎস নেই বললে চলে, সেখানে তারা কীভাবে সুপেয় পানির চাহিদা মেটায়?

Also Read: চট্টগ্রামে ওয়াসার পানি লবণাক্ত, গ্রাহকদের ক্ষোভ

চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে লবণ বাড়ার প্রবণতা কোনো নতুন সমস্যা নয়। ১০-২০ বছর আগে থেকে এই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। কিন্তু ওয়াসা কখনো সমস্যাটিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। ওয়াসা নতুন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় শুষ্ক মৌসুমে পানি লবণাক্ত হয়ে যাওয়ার বিষয়টি উপেক্ষা করেছে।

চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্ণফুলী ও হালদা নদীর চারটি পানি শোধনাগারে দিনে ৪৬ কোটি লিটার পানি উত্তোলন করতে পারে। কিন্তু লবণাক্ততা ও কর্ণফুলী নদীর শেওলার কারণে দিনে ৩৫ কোটি লিটার উৎপাদন করতে হচ্ছে। হালদা নদী থেকে চট্টগ্রাম ওয়াসা মোহরা পানি শোধনাগার ও মদুনাঘাটের শেখ রাসেল পানি শোধনাগার প্রকল্পের মাধ্যমে দিনে ১৮ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করে। কিন্তু প্রায় দুই মাস ধরে এ দুটি শোধনাগার থেকে সরবরাহ করা পানিতে অতিরিক্ত লবণ।

ওয়াসার তথ্যে জানা যায়, মোহরা ও মদুনাঘাট পানি শোধনাগারে যে এলাকায় পানি সংগ্রহ করা হয়, সেখানে প্রতি লিটারে ৩ হাজার ৫০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণ পাওয়া গেছে। এসব কারণে দিনের বেশির ভাগ সময় পানি শোধন বন্ধ রাখতে হয়। শেষমেশ যা উৎপাদিত হয়, তাতেও সিস্টেম লস থেকে যায়। ফলে সাড়ে ৭৮ হাজার আবাসিক সংযোগ এবং প্রায় ৮ হাজার বাণিজ্যিক সংযোগে এই উৎপাদিত পানিতে কুলোয় না।

পানির এই সংকট কমবে না, বরং ভবিষ্যতে বাড়বে। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে আমরা ক্রমে এক মরুবিশ্বের দিকে ধাবিত হচ্ছি। ষড়্ঋতুর বদ্বীপ অঞ্চলটি ক্রমে ত্রিঋতুর বৈচিত্র্যহীন মলিন, ধূসর জনপদে পরিণত হচ্ছে। কাপ্তাই হ্রদের পানির স্তর ক্রমে কমতেই থাকবে। কর্ণফুলীর পানিকে সুপেয় বা মিঠা রাখতে কাপ্তাই বাঁধের অন্তত চারটি টারবাইন খোলা রাখা জরুরি। কিন্তু এই খরার সময় সেখানে দুটি টারবাইনও খোলা রাখা যাচ্ছে না। আর তাই ভবিষ্যতের ভয়াবহ সংকট মোকাবিলা করতে ওয়াসাকে বিকল্প পথ খুঁজে নিতে হবে। নতুন পানি শোধনাগার প্রকল্প হাত দেওয়ার আগে নুনমাখা সমুদ্রের আগ্রাসনের কথা মাথায় রাখতে হবে।

শুধু ওয়াসাকে নয়, চট্টগ্রাম বন্দর, পরিবেশ অধিদপ্তর, প্রশাসন, রাজনীতিবিদ—সব মানুষকে এই কথা মাথায় রাখতে হবে। কারণ, শুধু পানিসংকট নয়, কর্ণফুলী, হালদার বিপুল মৎস্য সম্পদ ও অন্যান্য জীববৈচিত্র্যে আঘাত হানবে এই লবণাক্ততা। এতে পুরো জনপদের অস্তিত্বের সংকট তৈরি হতে পারে। আমাদের সব কাজ, প্রকল্প যদি পরিবেশবান্ধব না হয়, তবে বিপদ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ কেউ ঠেকাতে পারবে না। একমাত্র সবার সম্মিলিত সচেতনতাই আমাদের রক্ষা করতে পারে।

  • ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক