চট্টগ্রামে ওয়াসার পানি লবণাক্ত, গ্রাহকদের ক্ষোভ

বেশ কয়েক দিন ধরে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন স্থানে ওয়াসার পানি–সংকট চরমে। পানি না পেয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে নগরবাসীকে। যাঁদের বাড়িতে গভীর নলকূপ রয়েছে, সেসব বাড়িতে পানি নিতে কলসি দিয়ে লাইন ধরেন অনেকেই। চট্টগ্রাম নগরের হালিশহর নয়াবারের হিন্দুপাড়া এলাকা, ১৬ এপ্রিল, বিকেল সাড়ে ৪টা
ছবি: সৌরভ দাশ

চট্টগ্রাম ওয়াসার সরবরাহ করা পানি নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছেন নগরবাসী। বিভিন্ন এলাকায় দিনের পর দিন পানি আসছে না। আবার যেটুকু আসছে, লবণাক্ততার কারণে সেটুকুও মুখে তোলার জো নেই। ঠিকভাবে গোসলও করা যাচ্ছে না। অনেকেই পানি কিনে এনে ব্যবহার করছেন।

চট্টগ্রাম নগরের খতিবের হাট এলাকায় ভাড়া থাকেন বিপুল দে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বেশ কয়েক দিন ধরে তাঁদের বাসায় ওয়াসার যে পানি আসছে, তা লবণাক্ত। ঈদের দিন (গত শনিবার) তাঁর মা এই পানি পান করে অসুস্থ হয়ে পড়েন, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন। পরে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়।

অবশ্য শুধু বিপুল নন, নগরের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে ভোগান্তির একই চিত্র পাওয়া গেছে। তাঁরা কেউ পানি কিনে পান করছেন। আবার কেউ দূরদূরান্তের পুকুর ও গভীর নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহ করে আনছেন।

মোহাম্মদ রবিউল হাসান থাকেন নগরের বহদ্দারহাটের খাজা রোড এলাকায়। চার দিন ধরে তাঁর বাসায় লবণাক্ত পানি আসছে। এ কারণে প্রতিদিন প্রায় দু শ টাকার পানি কিনে তাঁরা রান্না, খাওয়ার কাজ সারছেন। রবিউল প্রথম আলোকে বলেন, বাসায় তাঁর পাঁচ সদস্য। কেনা পানি দিয়ে রান্না ও খাওয়ার কাজ করছেন। পানি কম ব্যবহার করছেন। ঠিকমতো গোসলও করতে পারছেন না।  

সমুদ্রের পানি নদীতে ঢুকে পড়ছে। এ ছাড়া কাপ্তাই রাবার ড্যাম থেকে কর্ণফুলী নদীতে শেওলা ঢুকে পড়ছে। রাসায়নিকের মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে মুষলধারে বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত এটি পুরোপুরি সমাধান করা যাবে না।
মাকসুদ আলম, ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী

ওয়াসার পানি–সংকট নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও সংস্থাটির সমালোচনা করছেন গ্রাহকেরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ফুয়াদ হাসান তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, ‘গরমে মানুষের শরীরে লবণ ও পানিশূন্যতা তৈরি হওয়ার কথা ভেবে তারা (ওয়াসা) বেশ কিছুদিন ধরে পানির বদলে লবণাক্ত স্যালাইন সরবরাহ করে যাচ্ছে।’ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নগরের বহদ্দারহাট কাঁচাবাজার এলাকায় তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ওয়াসার লবণাক্ত পানি নিয়ে ভোগান্তিতে আছেন। পানি পরিশোধন করলেও লবণ যাচ্ছে না। এমনকি এই পানি দিয়ে গোসল ও রান্নার কাজ করতে হচ্ছে।

ফেসবুকে ‘ডেসপারেটলি সিকিং–চিটাগং’ নামের একটি পেজে ওয়াসার পানি নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। তুরান খন্দকার নামের এক আইডি থেকে ওই পেজে ওয়াসার পানি নিয়ে একটি পোস্ট দেওয়া হয়। ওই পোস্টে বলা হয়, ‘চট্টগ্রাম ওয়াসা কী পানি দিচ্ছে এখন? এত লবণাক্ত যে মুখে নেওয়া যাচ্ছে না। আমাদের এদিকে মোটামুটি সবার পেট খারাপ।’ তুরান খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, নগরের কর্ণেলহাট সিডিএ আবাসিক এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন তাঁরা। পুরো এলাকাতেই পানির এ সমস্যা রয়েছে।

তুরানের ওই পোস্টের নিচে ৬৯টি মন্তব্য জমা পড়েছে। এসব মন্তব্যে বেশির ভাগ ফেসবুক ব্যবহারকারীই নিজেদের এলাকায় একই সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। এনামুল হক নামের এক ব্যক্তি মন্তব্যের ঘরে বলেন, ‘ভাই আপনারা তো লবণ পানি পাচ্ছেন। আর আমরা নালার দুর্গন্ধযুক্ত, ময়লা এবং কালো পানি পাচ্ছি। এ ছাড়া ১৭ রোজা থেকে ২৮ রোজা পর্যন্ত কোনো পানিই পাই নাই।’

এদিকে পানি–সংকট নিরসন ও পানিকে লবণমুক্ত করার দাবিতে আগামীকাল বুধবার মানববন্ধনের ডাক দিয়েছে চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরাম নামের একটি সংগঠন। সংগঠনটি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে মানববন্ধনের ডাক দেয়। সংগঠনের চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসাইন নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টেও এ নিয়ে লেখালেখি করেছেন। মনোয়ার হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে ওয়াসার পানির সংকট চলছে। পানিতে লবণ। অনেক এলাকায় পানি যাচ্ছে না। কিন্তু এসব নিয়ে ওয়াসা কর্তৃপক্ষের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। এ কারণে আগামীকাল ওয়াসার কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন হবে।

বর্তমানে ওয়াসার আবাসিক গ্রাহক সংযোগ ৭৮ হাজার ৫৪২টি ও বাণিজ্যিক সংযোগ ৭ হাজার ৭৬৭টি। ৭৭০ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে সংস্থাটি পানি সরবরাহ করে। বেশির ভাগ লাইন পুরোনো হওয়ার কারণে এমনিতেই সংকটে থাকতে হয় গ্রাহকদের। লাইনে লিকেজ বা ছিদ্রের কারণে পানি নষ্ট হয়। এখন সংকট আরও প্রকট হয়েছে।

সংকটের বিষয়ে ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, সমুদ্রের পানি নদীতে ঢুকে পড়ছে। এ কারণে ছয় ঘণ্টা পানি উত্তোলন করা হচ্ছে না। পানির উৎপাদন অর্ধেকে নেমে গেছে। এ ছাড়া কাপ্তাই রাবার ড্যাম থেকে কর্ণফুলী নদীতে শেওলা ঢুকে পড়ছে। রাসায়নিকের মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে মুষলধারে বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত এটি পুরোপুরি সমাধান করা যাবে না। তাঁর দাবি, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রযুক্তির মাধ্যমে পানি পুরোপুরি পরিশোধন করলে খরচ বেশি পড়বে। পানির দামও বেড়ে যাবে। বছরে আগে তিন থেকে চার দিন লবণের সমস্যা হতো। কিন্তু এ বছর পর্যাপ্ত বৃষ্টির অভাবে একটু সমস্যা হয়েছে।

পানির কল দিয়ে আসা ওয়াসার পানি। ময়লা ও কালো রঙের এই পানিতে দুর্গন্ধ বলে দাবি করেন এক গ্রাহক
ছবি: সংগৃহীত

নদীতে শেওলা, হ্রদে পানি কম
জানা গেছে, কর্ণফুলী নদীতে শেওলা জমার কারণে শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার থেকে এখন আসছে ২০ কোটি লিটারের কম পানি। পাশাপাশি লোডশেডিংয়ের কারণেও পানি সরবরাহে সমস্যা তৈরি হয়েছে। এর আগে ১৩ এপ্রিল সংস্থাটির ওয়েবসাইটে একটি জরুরি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের হ্রদে পানির স্তর ৩৩ ফুট পর্যন্ত কমে গেছে। স্বাভাবিক অবস্থায় পানির স্তর ১০৯ ফুট পর্যন্ত থাকে। বর্তমানে স্তর ৭৬ ফুট। এ কারণে হ্রদ থেকে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে না। মোহরা ও শেখ রাসেল পানি শোধনাগারে হালদা নদী থেকে উত্তোলিত পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।

বর্তমানে ওয়াসার আবাসিক গ্রাহক সংযোগ ৭৮ হাজার ৫৪২টি ও বাণিজ্যিক সংযোগ ৭ হাজার ৭৬৭টি। ৭৭০ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে সংস্থাটি পানি সরবরাহ করে। বেশির ভাগ লাইন পুরোনো হওয়ার কারণে এমনিতেই সংকটে থাকতে হয় গ্রাহকদের। লাইনে লিকেজ বা ছিদ্রের কারণে পানি নষ্ট হয়। এখন সংকট আরও প্রকট হয়েছে।

পানি–সংকটের জন্য ওয়াসার গাফিলতিকেই দায়ী করেছেন ক্রেতা-ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী জাতীয় প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হ্রদে পানি কমে যাওয়া কিংবা নদীতে শেওলা আসার ঘটনা পুরোনো। কিন্তু এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান অথবা এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার বিষয়ে ওয়াসা কর্তৃপক্ষের গাফিলতি আছে। তারা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না।