Thank you for trying Sticky AMP!!

বঙ্গবাজারের আগুন ভয়াবহ আগুন

বঙ্গবাজারের আগুন নিয়েও ‘রাজনীতি’ কেন?

বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের কারণ এখনো উদ্‌ঘাটিত হয়নি। এ দুর্ঘটনার দায় নিয়ে যেমন নানা রকম আলোচনা হচ্ছে, তেমনি আগুন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারার কারণগুলো নিয়ে নানা বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা চলছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে বিশেষজ্ঞের মতামত-পরামর্শও ছাপছে সংবাদপত্রগুলো।

অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে সবচেয়ে বড় সান্ত্বনার দিকটি হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের প্রতি সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সহমর্মিতা। আমরা যখন দেখি, দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই থেকে শুরু করে সমাজের ‘অচ্ছুত’ হিসেবে বিবেচিত হিজড়া সম্প্রদায়ের লোকজন পর্যন্ত বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছে, তখন এ ঐক্যচেতনা ও ভ্রাতৃত্ববোধে বিস্মিত হই।

এ আবেগ স্বতঃস্ফূর্ত। অথচ আমাদের রাজনীতিকেরা মানুষের এসব আবেগ-অনুভূতিকে সামান্য মূল্যও না দিয়ে চিরাচরিত নিয়মে বিদ্বেষ ছড়াতে ব্যস্ত। অন্তত দুঃসময়ে সবাইকে সমবেত করার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা উল্টো তৈরি করছেন সন্দেহ-সংশয়-অবিশ্বাস।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নাশকতা কি না, আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে এ ঘটনা ঘটাচ্ছে কি না, তা আমরা খতিয়ে দেখছি এবং তা তদন্ত করা দরকার।’ এ কথা তিনি বলেছেন কোনো দল বা গোষ্ঠীর নাম উল্লেখ না করে। কিন্তু আক্রমণের লক্ষ্য সম্পর্কে সাধারণ মানুষ যেমন বিলকুল অবহিত, তেমনি বিএনপি মহাসচিবেরও দ্বিধা থাকার কথা নয়। সুতরাং পরের দিনই পাল্টা তিরটি ছুড়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তাঁর মতে, ‘নিরপেক্ষ তদন্ত হলে ওই ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের লোকদের সম্পৃক্ততা বেরিয়ে আসবে।’

এই দুজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির পরস্পরবিরোধী মন্তব্যের পেছনে গোপন কোনো সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য আছে কি না, তা আমরা জানি না। কিন্তু এটা জানি, অধিকাংশ মানুষ এ দুই পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের একটাও বিশ্বাস করেনি। সেই নীতিমূলক গল্প তো আমরা জানি, ‘প্রতিদিন বাঘ আসছে বাঘ আসছে’ বলে গ্রামের মানুষকে ভয় দেখাত যে রাখাল বালক, সত্যিকারের বাঘের কবলে পড়েও সে সাহায্য পায়নি গ্রামবাসীর। কারণ, একবার বিশ্বাসযোগ্যতা হারালে সেটা আর ফিরে পাওয়া যায় না।

হাজারো ব্যবসায়ী যখন অগ্নিকাণ্ডে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়লেন, তখন তার কারণ খুঁজে বের করার পাশাপাশি তাঁদের পাশে কীভাবে দাঁড়ানো যায়, কীভাবে এ বিরাট ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার ন্যূনতম উপায় খুঁজে পান ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা, সর্বোপরি ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি কীভাবে রোধ করা যায়—এসব নিয়ে কথা বলা উচিত ছিল রাজনীতিকদের। কিন্তু প্রকৃত কারণ খোঁজার জন্য তদন্ত ও বিশেষজ্ঞ মতামত নেওয়ার আগে প্রথম সুযোগেই বিরোধী দলের দিকে আঙুল তোলা রীতিমতো হৃদয়হীন আচরণ। অন৵দিকে, বিএনপির পক্ষ থেকেও দুর্ঘটনার অব্যবহিত পর সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মূল্যায়ন করে এর ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করে কিছু গঠনমূলক ও কার্যকর উদ্যোগের দাবি বা পরামর্শ দেওয়ার কাজটি করাই ছিল সমীচীন। বলা বাহুল্য, সে পথে তারা যায়নি।

যাহোক, পাঁচ হাজার ব্যবসায়ী, তাঁদের দোকানের কয়েক হাজার কর্মচারীর ভবিষ্যৎ যখন হুমকির মুখে পড়ল, সম্পদহানি হলো প্রায় এক হাজার কোটি টাকার, তখন এর দায় কার—এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ উদ্‌ঘাটিত হবে কি না জানি না, তবে এর অনিবার্যতা নিয়ে সোজাসাপটা কথা বলেছেন ড. মুজিবুর রহমান। নগরব্যবস্থা, পানি, স্যানিটেশন ও পরিবেশ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এই অধ্যাপক বলেছেন, ‘বঙ্গবাজার বা সিদ্দিকবাজারের ঘটনা আসলে ঘটতই।’ প্রথম আলোকে (৯ এপ্রিল ২০২৩) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন তিনি। অর্থাৎ, এ দুর্ঘটনার সব শঙ্কা ও অনুষঙ্গ এখানে মজুত ছিল।

দুর্ঘটনা ছিল অনিবার্য, আজ বা কাল, যেকোনো সময়ে এটা যে ঘটবে, তা অনুমান করা মোটেই দুঃসাধ্য ছিল না। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সটি যে ঝুঁকিপূর্ণ, তা ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছিল চার বছর আগে। এক–দুবার নয়, দশবার নোটিশ দেওয়া হয়েছিল, তারপরও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বা দোকান মালিক সমিতি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ফায়ার সার্ভিসের কোনো গাফিলতি ছিল কি না, তা তদন্ত করা যেতে পারে, কিন্তু তারা অগ্নিনির্বাপণের জন্য কাজ করতে গিয়ে যেসব অসুবিধার মুখে পড়েছে, সেগুলোও বিবেচনায় নিতে হবে।

Also Read: বঙ্গবাজার বা সিদ্দিকবাজারের ঘটনা আসলে ঘটতই

বঙ্গবাজারের ঘটনার পর ঢাকাসহ সারা দেশে অনেক কাঁচাবাজার ও বিপণিকেন্দ্রের কথা উঠে এসেছে, যেগুলো একই পরিণতির শিকার হতে পারে যেকোনো মুহূর্তে। চট্টগ্রামের তামাকুমন্ডি লেনে আছে ১১০টি বিপণিকেন্দ্র। প্রায় টানেলের মতো এই বিপণিকেন্দ্রগুলোয় ঢুকে পড়লে অনেক সময় বেরোনোর পথ চিনে উঠতে পারেন না ক্রেতারা। এর পাশে রিয়াজউদ্দিন বাজার বণিক সমিতির অধীন আছে আরও ১০০টি ছোট–বড় বিপণিকেন্দ্র। দুই সমিতির অধীন আছেন প্রায় ২০ হাজার ব্যবসায়ী, আরও কমপক্ষে ২০ হাজার কর্মচারী যে আছেন, তা তো সহজেই অনুমেয়। রিয়াজউদ্দিন বাজার এলাকায় আগুন লাগলে তার পরিণতি যে কী হবে, তা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। কিন্তু কেউ তা ভাবছেন বলে মনে হয় না। ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রাম বিভাগের উপপরিচালক বলেছেন, এ বাজারে আগুন লাগলে ১০০ গাড়ি দিয়ে নেভানো কঠিন হবে। কারণ, আশপাশে পানির কোনো উৎস নেই। রিয়াজউদ্দিন বাজার ছাড়াও চট্টগ্রামের টেরিবাজার, জহুর হকার মার্কেট ও সিঙ্গাপুর মার্কেটকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ফায়ার সার্ভিস। বারবার নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নোটিশ দিয়েছে। কিন্তু নিজেদের ভাগ্য ‘অদৃষ্টে’র হাতে ছেড়ে দিয়ে নিষ্ক্রিয় রয়েছে বিপণিকেন্দ্রের সমিতিগুলো। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে তাদের কোনো নির্দেশনা ও সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে বলেও জানা নেই।

অনেকেরই ধারণা, দেশের যেসব বিপণিকেন্দ্র এ রকম বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে রয়েছে, এগুলোকে অগ্নিকাণ্ড বা এ ধরনের বড় বিপদ থেকে রক্ষা করা অসম্ভব। ভবিতব্যের ওপর এগুলোকে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ‘রানা প্লাজা’ দুর্ঘটনার পর বিজিএমইএ, বুয়েট ও অন্যান্য সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টার বিষয়টি উদাহরণ হতে পারে। এ প্রসঙ্গে ড. মুজিবুর রহমান সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘তাদের সদিচ্ছাটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।...এখন আমাদের পোশাক কারখানাগুলো দেখুন, আমাদের পোশাক খাত শুধু ঘুরেই দাঁড়ায়নি, বিশ্বের এক নম্বরে চলে গেছে। বিশ্বের সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানাগুলো এখন এখানে।’

‘সদিচ্ছা’ থাকলে সম্ভব। কিন্তু যেকোনো দুর্ঘটনায় বিরোধী দলের ‘ষড়যন্ত্র’ কিংবা সরকারি দলের ‘সম্পৃক্ততা’ খুঁজলে বঙ্গবাজারের পর রিয়াজউদ্দিন বাজার বা অন্য কোনো বাজারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে দুরুদুরু বক্ষে। সমস্যার সমাধান হবে না।

  • বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক