বঙ্গবাজার বা সিদ্দিকবাজারের ঘটনা আসলে ঘটতই

ড. মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান। নগরব্যবস্থা, পানি, স্যানিটেশন, পরিবেশ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। তিনি হাতিরঝিল প্রকল্প, পোশাক কারখানায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সাম্প্রতিক কালের বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ঘাটতি, দায়দায়িত্ব ও করণীয় সম্পর্কে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাফসান গালিব

ড. মুজিবুর রহমান

প্রশ্ন :

একের পর এক অগ্নিদুর্ঘটনা ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ বঙ্গবাজারের ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনা আমরা দেখলাম। তা-ও ফায়ার সার্ভিসের প্রধান অফিসের সামনে। ফলে দুর্যোগ মোকাবিলা নিয়ে নানা সমালোচনা হচ্ছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

মুজিবুর রহমান: বঙ্গবাজার মার্কেটকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অনেকবার ঘোষণা বা সতর্ক করেছিল। তা সত্ত্বেও সেখানে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ব্যবসায়ী মহল বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কেউ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়নি এবং ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থাতেই মার্কেটটি চালু রেখেছিল। ফলে এ অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলই। অনেক ক্ষয়ক্ষতি হলো। স্বস্তিদায়ক এটাই যে অগ্নিকাণ্ড দিনে বা সন্ধ্যায় ঘটেনি। ফলে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। শুধু ফায়ার সার্ভিস বা অন্যান্য বাহিনীর পক্ষে এত বড় ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। অগ্নিকাণ্ড বা যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জনগণকে সচেতন করা এবং সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনা করা ও সমন্বিত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা তৈরি না করে দুর্যোগ মোকাবিলা করা যায় না।

ঢাকা এত বড় একটা নগর, অথচ এখানে অগ্নিনির্বাপণের জন্য যে প্রয়োজনীয় পানির উৎস থাকা দরকার, সমন্বিত ব্যবস্থাপনা থাকা দরকার, সেগুলোর যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। কোথাও প্রয়োজনীয় পানির উৎস খুঁজে পাওয়া যায় না, ঢাকার পুকুরগুলো হারিয়ে গেছে, খাল দখল হয়ে ভবন নির্মিত হয়েছে। এলাকাগুলোতে ‘ফায়ার হাইড্রেন্ট’ বসানো হয়নি, যেগুলো মূলত পানি সরবরাহ নেটওয়ার্কের আওতায় থাকবে। বঙ্গবাজারের ক্ষেত্রে হাতিরঝিল বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পুকুর ছিল বলে তা-ও পানি আনা গেছে। সে দুইটাও যদি না থাকত, এ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে তো আরও বেগ পেতে হতো।

ঢাকার যেসব পুকুর ও খাল হারিয়ে গেছে, সেগুলোকে উদ্ধার করতে হবে। হাতিরঝিলের মতো করে সেসব পুকুর ও খাল যাতে দখল না হয়ে যায়, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। বঙ্গবাজারের মতো ঢাকায় বা অন্যান্য শহরে আরও ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট আছে। এক ঘটনা থেকে শিক্ষা না নিলে পরবর্তীকালে আরও বড় ঘটনা ঘটতে পারে।

দুর্ঘটনা ঘটলে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার চেয়ে দুর্ঘটনা ‘না’ ঘটার বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিতে হবে। সে অনুযায়ী নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ ঢাকা শহরকে নিরাপদ বসবাসযোগ্য রাখার জন্য উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন।

এখনই বসে সব কটি ভবন যাচাই-বাছাই করে একেবারে ঠিক করে ফেলতে হবে—কতসংখ্যক ভবন অবকাঠামোগত দুর্বল, কতসংখ্যক ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা নেই, কতসংখ্যক ভবনে সেবামূলক লাইনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। পুরান ঢাকায় তো সেটি করতেই হবে। আর অপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই

প্রশ্ন :

এর আগে আমরা সায়েন্স ল্যাব, সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণের ঘটনা দেখলাম। অনেকের প্রশ্ন, ঢাকা শহর এভাবে হঠাৎ মৃত্যুকূপ হয়ে উঠল কেন? বিষয়টা কি আসলে তা-ই?

মুজিবুর রহমান: আসলে এটি হঠাৎ করে হয়নি। বহুদিন ধরে ঢাকা শহর যেভাবে তৈরি হচ্ছে বা বেড়ে উঠছে, এটির প্রক্রিয়াগত দিক থেকেই এ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান তৈরি হয়েছে। এখন বঙ্গবাজারে, সিদ্দিকবাজারে বা তার আগে সায়েন্স ল্যাবে বা এ ধরনের ঘটনাগুলো যে ঘটছে, সেগুলো আসলে ঘটতই।

এখানে অনেকগুলো বিষয় আছে, যেগুলো আমরা দেখতে পাই না। যেমন সিদ্দিকবাজারে কী ঘটেছে, তা এখন তদন্ত করে বের করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের তো দরকার ছিল, যেসব কারণে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, সেগুলো আগেই নিরূপণ করা। এ শহর তো এক দিনে গড়ে ওঠেনি। সেখানে ভবন নির্মাণ ছাড়াও গ্যাসলাইন, সুয়ারেজ লাইন, বিদ্যুতের লাইনের মতো সেবামূলক কার্যক্রমগুলোও যুক্ত হয়েছে। কিন্তু সেগুলো একবার তৈরি করে তো আমরা ভুলে যাই—এ রাস্তার নিচে বা ভবনের নিচে এমন লাইন গেছে। আর বাড়িঘরের নিচে অনেক লাইনের সংযোগ আছে, যেগুলোর কোনো রেকর্ডই নেই, যেগুলোকে আমরা বলি চোরাই সংযোগ। এখন সেগুলোর কে হদিস রাখে? সেগুলোও এ ধরনের দুর্ঘটনার বড় কারণ হতে পারে।

এ ধরনের বেআইনি, ছিদ্র বা ত্রুটিযুক্ত সংযোগ থেকে যে গ্যাস বের হয়, সেগুলো যদি কোথাও একটু জমে থাকে, তাহলে তো বিস্ফোরণ ঘটবেই। এটিই ঘটে থাকতে পারে এবং সেটি অস্বাভাবিকও নয়। ঢাকা শহরে যে আরও এমন ঘটনা ঘটবে না, এমনটাও নিশ্চিত নয়।

প্রশ্ন :

সাধারণত শিল্পকারখানাগুলোতে আগে এ ধরনের দুর্ঘটনা বেশি ঘটত। এখন আমরা দেখছি, যেখানে রাসায়নিক দ্রব্য নেই, এমন ভবনেও অগ্নিকাণ্ড বা বিস্ফোরণ ঘটছে। এর কারণ কী মনে করেন?

মুজিবুর রহমান: আমরা যেসব সেবামূলক কার্যক্রমের অবকাঠামোগুলো তৈরি করেছি, সেগুলোর একটি স্থায়িত্ব বা ডিজাইন লাইফ আছে। এটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ভালোভাবে কাজ করে, যদি সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। এরপর এ পুরো অবকাঠামোকে পরিবর্তন করতে হবে, পরিবর্ধন করতে হবে বা একেবারে প্রতিস্থাপন করতেও হতে পারে, সেটা আমরা দেখতে পাই না।

বহু বছরের পুরোনো অবকাঠামোই এখনো বহাল আছে। সেগুলো জোড়াতালি দিয়ে চলছে। আর যে ধরনের বিস্ফোরণ হচ্ছে, সেটির ধাক্কা নিতে পারার মতো সহনীয় করে আমাদের ভবনগুলো তৈরি হচ্ছে না। ফলে আশপাশের ভবনগুলো পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখন শহরের ভবনগুলো মনিটর করা, সেগুলো টিকে থাকার সক্ষমতা আছে কি না, তা দেখার প্রয়োজন আছে।

একটা সময় যে যাঁর ইচ্ছেমতো ভবন তৈরি করতে পারতেন। এরপর ১৯৯৩ সালে বিল্ডিং কোড করা হয়। ২০২১ সালে এর রিভাইজড সংস্করণও প্রকাশিত হয়। এরপরও মনে হয় না সবাই সেই কোড মেনে ভবন তৈরি করেন। এখন একটি ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে কোনো সেবামূলক লাইন বা সরকারি কোনো প্রকল্প করার সময় সঠিকভাবে মনিটরিং হয় না। সেসব আদৌ ঠিকমতো হচ্ছে কি না, সেটির আইনগত ও গুণগত মান নিশ্চিত করা হয় না। সেটিই পরে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করছে।

প্রশ্ন :

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বিদেশি ক্রেতাদের চাপে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তৈরি পোশাক কারখানাগুলো অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত করা গেছে। এর সঙ্গে আপনিও ভালোভাবে যুক্ত ছিলেন। সেখানকার অভিজ্ঞতাগুলো যদি বলতেন।

মুজিবুর রহমান: রানা প্লাজার ঘটনায় অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, অনেক মানুষ মারা গেছেন, সেটি খুবই দুঃখজনক ছিল। কিন্তু সেই ধাক্কার কারণে এখানে একটা পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে। সেই ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে বিজিএমইএকে সঙ্গে নিয়ে আমরা বুয়েট থেকে একটা বড় দল মাঠে নেমে গিয়েছিলাম কারখানার ভবনগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে। সে সময় আমি পুরকৌশল বিভাগের প্রধান ছিলাম। পরে ক্রয়াদেশ প্রদানকারী বিদেশি গ্রুপগুলো, আইএলও আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। একটা সমন্বিত কার্যক্রম শুরু হয়ে যায় তখন।

পোশাকশিল্পকে রক্ষা করতে এ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। ভবনগুলোর শুধু স্ট্রাকচারাল সেফটি দেখা হয়নি, অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টিও নিশ্চিত করা হয়েছে। দলগতভাবে ভাগ হয়ে এ কাজগুলো করা হয়েছে। বুয়েট থেকে আমি নেতৃত্ব শুরু করেছিলাম। আমার বিভাগের ৪০-৪২ শিক্ষক এ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। বুয়েটের মেকানিক্যাল ও ইলেকট্রিক্যাল বিভাগও এগিয়ে এসেছিল। বিজিএমইএ তাদের প্রতিটি কারখানার মধ্যে বিষয়গুলো নিয়ে সচেতনতা তৈরির কাজটি করেছে। তাদের সদিচ্ছাটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

যদিও পুরো কাজটি শেষ হতে কয়েক বছর সময় লেগেছে। কিন্তু এখন আমাদের পোশাক কারখানাগুলো দেখুন, আমাদের পোশাক খাত শুধু ঘুরেই দাঁড়ায়নি, বিশ্বের এক নম্বরে চলে গেছে। বিশ্বের সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানাগুলো এখন এখানে। এই একই জিনিস আসলে ঢাকা শহরের ভবনগুলোর ক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে।

প্রশ্ন :

ঢাকা শহর যেভাবে অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে উঠেছে, সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে আদৌ এমন পদক্ষেপ নিতে দেখব কি আমরা?

মুজিবুর রহমান: ঢাকায় কয়েক লাখ ভবন আছে, সেগুলো থেকে অবকাঠামোভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো অবশ্যই চিহ্নিত করে বের করতে হবে। হাজার হাজার কারখানার ক্ষেত্রে তো আমরা সেটিই করেছি। সবাই মিলে সমন্বিত প্রচেষ্টার কারণে সেটি সম্ভব হয়েছে। আমার মনে আছে, সে সময় বিজিএমইএর প্রেসিডেন্ট ছিলেন এখনকার ঢাকা সিটি উত্তরের মেয়র। তিনি ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যে বুয়েটে ছুটে গিয়েছিলেন। আমাদের সঙ্গে নিয়ে বসেছেন।

আমাদের পরামর্শমতো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতিটি কারখানার ভবনের নকশা তিনি জমা নিয়েছেন। এরপর সেগুলো ধরে ধরে আমরা কাজ করেছি। একই কাজ করতে হবে রাজউককেও। তবে তারা একা এ কাজ করতে পারবে না। এখানে লাখ লাখ ভবন যাচাই-বাছাই করতে বিল্ডিং ডিজাইন কোম্পানিগুলোকে যুক্ত করতে হবে। এ রকম কোম্পানি এ শহরে পর্যাপ্তসংখ্যক আছে।

বুয়েটসহ সমমানের প্রতিষ্ঠানসমূহ হতে বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করতে হবে। তাঁদের সবাইকেই লাগবে। এ শহরে নিচু ভূমি ও জলাভূমিগুলো নষ্ট করে যত্রতত্র ঝুঁকিপূর্ণ ভবন তৈরি হয়েছে। যেটি কোনোভাবেই আমরা সমর্থন করতে পারি না। আজ একটা ঘটনা ঘটল, এরপর একটু নড়াচড়া হলো, সবাই সোচ্চার হলো, এরপর আবার সবাই চুপ। এরপর আবার একটা ঘটনা ঘটবে, অনেক মানুষ মারা যাবেন, আবার নড়েচড়ে বসবেন, এটা তো হতে পারে না। এটা কোনোভাবেই চলতে পারে না।

এখনই বসে সব কটি ভবন যাচাই-বাছাই করে একেবারে ঠিক করে ফেলতে হবে—কতসংখ্যক ভবন অবকাঠামোগত দুর্বল, কতসংখ্যক ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা নেই, কতসংখ্যক ভবনে সেবামূলক লাইনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। পুরান ঢাকায় তো সেটি করতেই হবে। আর অপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই।

এতগুলো দুর্ঘটনা ঘটেছে, এত মানুষ মারা গেলেন—এটা কি যথেষ্ট নয় সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করে সমাধান করার জন্য? আমি মনে করি, এখানে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রধান ভূমিকা রাখতে হবে। শুধু ঢাকা শহর না, চট্টগ্রামেও তো একই ধরনের ঘটনা ঘটছে, অন্যান্য শহরের পরিস্থিতিও একই রকম।

রাজউক, সিডিএ, কেডিএ—এ রকম সব সংস্থাই এ মন্ত্রণালয়ের অধীন। আরেকটা বিষয় হচ্ছে দীর্ঘ মেয়াদে নগর উন্নয়ন ও সেবামূলক কার্যক্রমের পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও মনিটরিংয়ের সার্বিক দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের ওপর ন্যস্ত থাকা উচিত বলে আমি মনে করি। সে লক্ষ্যে সিটি করপোরেশনসমূহকে আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সিটি করপোরেশন সরাসরি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ।

প্রশ্ন :

এই যে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন গড়ে উঠছে, বেআইনিভাবে সেবামূলক কার্যক্রমের লাইন বা ব্যবস্থাপনাগুলো গড়ে উঠছে, এর জন্য রাজউক বা তিতাসের মতো সংস্থাগুলো কি অনেকাংশে দায়ী নয়?

মুজিবুর রহমান: একটা কথা বলি, এখানে একটি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, তার আগে সেটির প্ল্যান পাস হচ্ছে; কিন্তু সে অনুযায়ী নির্মাণকাজ হচ্ছে কি না, তার কোনো মনিটরিং নেই। তারা বলে, তাদের কোনো সামর্থ্য নেই, জনবল নেই। অন্য সংস্থাগুলোও একই যুক্তি দেখিয়ে যাচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে এ কথাগুলো আমরা শুনে আসছি। এখন এ সমস্যা যদি তাদের থেকেই থাকে, তাহলে এর সমাধানের জন্য তারা এত দিন কী করেছে? সিদ্দিকবাজারের ভবনটি তিনতলা থেকে সাততলা কীভাবে হলো? সেটি সম্পর্কে তো তারা কিছু জানেই না। এটা কী করে হয়?

এখানে একটার পর একটা ঘটনা ঘটে, এত মানুষ মারা যায়, কিন্তু দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোকে কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। তাদের কাউকে শাস্তির মুখেও পড়তে হয় না। একটি দুর্ঘটনা ঘটল, এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যাঁরা জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এমনটি আমরা দেখি না। সেই সংস্কৃতিই এখানে নেই। অনেক দেশে এমন ঘটনায় দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেওয়া, এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন আনা হয় এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এখানে সেটি হয় না বলেই এমন ঘটনা বারবার ঘটছে।

প্রশ্ন :

সম্প্রতি গুলশানের মতো উন্নত এলাকায়ও তো অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটল। কয়েকজন মানুষও মারা গেলেন। বলা হচ্ছে, ভবনটিতে সব ধরনের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ছিল। অন্যান্য এলাকার তুলনায় সেখানে ফায়ার ব্রিগেডের জন্য কাজ করাও সহজ। এ ব্যাপারে কী বলবেন?

মুজিবুর রহমান: ভবনটি দেখার সুযোগ আমার হয়নি। শুনেছি, ভবনটি অপেক্ষাকৃত নতুন, সেখানে সব ধরনের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ছিল ঠিকই, কিন্তু সেগুলো যথাযথভাবে কার্যকর ছিল কি না, তা নিশ্চিত করা দরকার। এমন হতে পারে, ফায়ার এক্সিটগুলো পুরোপুরি ব্যবহারযোগ্য ছিল না। সেখানে প্রতিবন্ধকতা ছিল, নামার মতো সুযোগ ছিল না। আবার এমন ঘটনায় মানুষও সচেতন থাকে না, কী করবে। অ্যালার্ম সিস্টেম ঠিকমতো বেজেছে কি না বা বাজলেও সবাইকে যে দৌড়ে নেমে যেতে হবে, সেই ধারণা সবার মধ্যে ছিল কি না, সেটিও দেখতে হবে।

আর ফায়ার সার্ভিস বলছে, ৪০ তলায় ওঠার মতো তাদের কাছে সিঁড়ি আছে, কিন্তু তাদের জন্য রাস্তার যে প্রশস্ততা দরকার, সেটি নেই। এটিও বড় একটি চিন্তার কারণ। বুঝলাম, রাস্তা অতটা প্রশস্ত ছিল না। এখন আমাদের শহরগুলো তো এভাবেই গড়ে উঠেছে। কিন্তু যেটুকু প্রশস্ততা আছে, সেখানেও এমন উদ্ধার কার্যক্রম চালানোর সামর্থ্য অর্জন করতে হবে। তবে আমি বারবার বলছি, এখানে ভবনের কাঠামোর সক্ষমতা ও নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ।

এখনো অনেক বহুতল ভবন নির্মিত হচ্ছে, স্থাপত্য ফার্মগুলো কি বলতে পারবে, এসব বিষয় তারা শতভাগ নিশ্চিত করছে? ফায়ার এক্সিট যেভাবে ডিজাইন করা দরকার, সেটি হচ্ছে কি, নাকি দুইটা সিঁড়ি দিতে হবে, যেমন-তেমনভাবে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে? জায়গা ও অর্থ বাঁচানোর চিন্তা থেকে অনেকে যে অনেক কিছুই করে না, সেটি আমি ধারণা করি। যেমন-তেমনভাবে ফায়ার এক্সিটগুলো থাকলেও সেগুলো কি সব সময় সচল থাকে? সেটি তো নিশ্চিত করতে হবে।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে, বিদেশে পড়াশোনা করতে গিয়ে দেখেছি, পাঁচতলা ভবনেও কয়েক মাস পরপর ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে আচমকা ফায়ার অ্যালার্ম বেজে উঠত, আমরা সবাই ফায়ার এক্সিট দিয়ে বেরিয়ে যেতাম। এখানে তো সেই ফায়ার ড্রিলটা হয় না, যার কারণে ঘটনা ঘটলে মানুষ কিছু বুঝে উঠতে পারে না। ফলে হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যায়।

প্রশ্ন :

গত ফেব্রুয়ারিতে তুরস্ক-সিরিয়ায় যে ভয়াবহ ভূমিকম্প ঘটে গেল, এ দেশেও যদি ওই মাত্রার ভূমিকম্প ঘটে, তাহলে কী পরিস্থিতি তৈরি হবে?

মুজিবুর রহমান: আমার বলতে খুব খারাপ লাগছে, দ্বিধাও লাগছে, তুরস্ক-সিরিয়ার মতো ভূমিকম্প যদি এখানে ঘটে, কয়েক গুণ মানুষ মারা যেতে পারে। এ আশঙ্কাটা সবাই করছেন। কারণ হচ্ছে, আমাদের ভূমিকম্প-সহনীয় ভবন হাতে গোনা। অথচ এখানে হাজার হাজার বহুতল ভবন আছে। সেগুলোর কাঠামোগত সামর্থ্য বাড়ানো এখনই সময়। অনেকভাবেই সেটি করা যায়। শুধু ইচ্ছা আর পদক্ষেপটা জরুরি। এখন যে অপরিকল্পিতভাবে নগরগুলো গড়ে উঠছে, সেখানে বড় কোনো ভূমিকম্প ঘটে গেলে, উদ্ধার কার্যক্রম চালানোও তো খুব কঠিন হয়ে যাবে। অনেক সুযোগ-সুবিধাও তো আমাদের নেই। ফলে ভবনের কাঠামোগত সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

তুরস্কে আমরা কী দেখলাম, অনেক ভবন পুরোপুরি ধসে পড়েছে, পাশেই আবার অনেক ভবন দাঁড়িয়ে আছে বা কম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তার মানে সেগুলো ওই মাত্রার ভূমিকম্প-সহনীয় ছিল। এখন খরচ বাঁচানোর জন্য বা আর্থিক লাভের জন্য ভবনগুলো এভাবে নির্মাণ করা সমীচীন হবে না। এর মাধ্যমে মানুষকে বড় ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়া হবে। আমরা তো শিল্পোন্নত দেশের দিকে যাচ্ছি, কিন্তু আমাদের শিল্পকারখানাগুলো কী করে? শুধু টাকা বাঁচানোর জন্য বা মুনাফা বেশি করার জন্য ইটিপি চালু রাখা হয় না। এতে মানুষ ও পরিবেশের বিপর্যয় আমরা ডেকে আনছি।

প্রশ্ন :

এই যে সবকিছু অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে, এখানে রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি ও নিয়ম না মানার সংস্কৃতিকে বড় সমস্যা মনে করেন কি না।

মুজিবুর রহমান: অবশ্যই। সবকিছুর পেছনে আছে একটাই শব্দ—দুর্নীতি। নিয়ম না মেনে চলা, সময়ের কাজ সময়ে না করা—সবকিছুই দুর্নীতির অংশ। শুধু টাকাপয়সা লেনদেন করে দুর্নীতি হয় না। দুর্নীতির রকমের শেষ নেই। আমরা সেসবে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে গেছি। আমরা সেখান থেকে বের হতে পারছি না। আমি মনে করি, এভাবে অপরিকল্পিতভাবে নগর গড়ে ওঠা বন্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এখানে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ঘাটতি আছে। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, সমন্বিত প্রচেষ্টা ও সংশ্লিষ্ট সবার অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশ্ন :

আপনাকে ধন্যবাদ।

মুজিবুর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।