Thank you for trying Sticky AMP!!

আমার প্রিয় জাফরুল্লাহ ভাই

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

আশির দশক কিংবা নব্বইয়ের দশকের শুরুতে আমার বাবার সঙ্গে রাস্তায় বের হলে গণস্বাস্থ্যের জিপ বা কাভার্ড ভ্যান দেখলেই বাবা আমাদের দুই বোনকে বলতেন, দেখো দেখো এই গাড়িটা একজন মহিলা চালাচ্ছেন! আমরা দুই বোন ঘাড় ঘুরিয়ে অনেকক্ষণ ধরে এরপর সেই বিশাল গাড়ির চালককে দেখতাম। ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গণস্বাস্থ্যকে আমি চিনেছিলাম এভাবেই।

ওই যে একেবারে শিশু মনে যে সেই থেকে নারী গাড়ি চালাতে পারেন, বড় বিশাল গাড়িও চালাতে পারেন এবং পেশাদার চালক হতে পারেন এই ধারণা একেবারে চোখের দেখায় আমার মনে ঢুকে গেল, এ আর কখনো আমাকে দেশে বা বিদেশে বিস্মিত করতে পারে নাই। অথচ, এই বাংলাদেশে এখনো গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠার প্রায় পাঁচ দশক পরেও প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারী গাড়ি চালক নাই, আমাদের রাস্তা নারী গাড়ি চালক প্রায় শূন্য এবং ভীষণভাবে নারী অবান্ধব। এবং এখনো নারী গাড়ি চালক বিষয়টা এত বিস্ময়কর যে লোকে যত দূর চোখ যায় নারী গাড়ি চালককে দেখতেই থাকে!

পরে বড় হয়ে শুনেছি, জেনেছি শুধু নারী গাড়ি চালক নয়, গণস্বাস্থ্যে নিরাপত্তা রক্ষী, কারখানার কর্মী, সুপারভাইজর, কুক, ক্যানটিন পরিচালনাকারী সবাই ছিলেন নারী, যা সেসময় খুব বিস্ময়কর ছিল। দুঃখের বিষয় এখনো এই পদগুলোতে নারীর কাজটা অপ্রচলিত এবং প্রথাবিরোধীই রয়ে গেছে। তবে, গণস্বাস্থ্য এই জায়গাগুলো নারীর জন্য সহজ স্বাভাবিক বলে প্রতিষ্ঠা এবং প্রমাণ করে পথ সহজ করতে বৈপ্লবিক ভূমিকা রেখেছে।

আসলে, বিপ্লব একটা প্রবণতা। বই পড়ে, বিপ্লবের তত্ত্ব বুঝে কিংবা ওই ঘরানার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যোগ দিলেই সকলে বিপ্লবী হয়ে উঠতে পারেন না। ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজন আগাপাশতলা স্বতঃস্ফূর্ত এবং সহজাত বিপ্লবী মানুষ ছিলেন। তার সকল কাজ তাই তাঁর নিজের ঘরানার বিপ্লবের স্বপ্নে মোড়া, সাহসে ভরা। গরিবের জন্য সুলভ চিকিৎসার ব্যবস্থা করার বিপ্লব থেকে তিনি কখনো সরে আসেন নাই। এই ব্যবস্থা করতে হলে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতির দেশে যে ওষুধ সহজলভ্য করতে হবে এ বিশ্বাস তার ছিল।

জনস্বাস্থ্য নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা বলেন, এক রকম একক প্রচেষ্টায় তিনি বাংলাদেশে ওষুধনীতি প্রণয়নে সরকারকে রাজি করাতে পারেন। এর ফলে জেনেরিক নামে ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো ওষুধ তৈরির অনুমোদন পায়। অর্থাৎ অনেক অনেক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি প্যরাসিটামল তৈরি করতে পারছে, ফলে সারা দেশে এ ধরনের প্রয়োজনীয় অথচ সময়ে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের যেমন কোনো অভাব নেই, তেমনি দামও রয়েছে হাতের নাগালে। এখনো ডাক্তারের সংখ্যা জনসংখ্যার তুলনায় একেবারে নগণ্য হওয়ায় এই ফার্মেসি আর ওষুধের প্রাপ্যতাই মূলত বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থার মেরুদণ্ড হয়ে আছে।

কয়েক দিন আগে আমার এক সহকর্মী পশ্চিম আফ্রিকার কয়েকটি দেশে কাজ সেরে ফিরে লিখছিলেন যে ওই দেশগুলোতে ওষুধ খাত পুরোটাই আমদানিনির্ভর থাকায় এক পাতা প্যারাসিটামলের দামও প্রায় ১ হাজার ৫০০ টাকা, যা কিনে খেয়ে চিকিৎসা সাধারণ মানুষের সব সাধ্যের বাইরে! এখানে বলে রাখি, জাফরুল্লাহ ভাইয়ের গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস কারখানার কর্মী এবং সুপারভাইজার হিসেবেও কাজ করতেন সাভারের স্থানীয় নিরক্ষর নারীরাই।

আমার প্রিয় জাফরুল্লাহ ভাই আমাকে এক অপত্যস্নেহের বাঁধনে বেঁধেছিলেন। রাজনীতির নানা আলাপ নিয়ে টক শোর টেবিলে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হলেও শোর বিরতিতে, ফোনালাপে কিংবা সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে কখনো দেখা হলে তাঁর সঙ্গে আমার কখনো রাজনীতি নিয়ে কোনো কথা হয়নি, আমার তাঁকে সেসব সময় রাজনীতি নিয়ে কখনো বিরাট উদ্বিগ্নও মনে হয়নি। আমি তাঁকে কখনো সামাজিক বা টেলিভিশন অনুষ্ঠানের আগে–পরের কোনো আড্ডাতেও রাজনীতি নিয়ে উচ্চকণ্ঠ বা উৎসুক দেখিনি। তাঁর সব চিন্তাজুড়ে আসলে থাকত গরিব মানুষের চিকিৎসাসেবার প্রসঙ্গটাই।

বছরের পর বছর ধরে সপ্তাহে একাধিক ডায়ালাইসিস নিয়ে বেঁচে থাকা ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলতেন এই দামি চিকিৎসা সপ্তাহে একাধিকবার কয়েক ঘণ্টা করে নিয়ে আসলে কারও পক্ষে স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব নয়। অথচ শুধু রক্তসম্পর্কীয়রাই কিডনি বা অন্য কোনো প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য দিতে পারবেন, এমন আইন যদি বাংলাদেশ বদলে ফেলে, তাহলে অনেকে দেশেই প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করে আবারও সুস্থ কর্মক্ষম জীবন ফিরে পেতে পারবেন।

তিনি বারবার কিডনি ডায়ালাইসিসের সুযোগ বাড়ানোর বিষয়ে কথা বলতে বলতেন আমাদের। বলতেন এ নিয়ে টক শো করতে, বলতেন তাঁর গণস্বাস্থ্যের ডায়ালাইসিস সেন্টারটা দেখতে যেতে, এ নিয়ে কথা বলতে যে কেন সহজলভ্য দামে আর সবার জন্য এই জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যাবে না। তার চেয়েও বেশি করে তিনি বলতে চাইতেন, আমাদের বলাতে চাইতেন, এ দেশে অর্গান বা প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের নিয়ম পরিবর্তন করা যে কতটা দরকার।

বছরের পর বছর ধরে সপ্তাহে একাধিক ডায়ালাইসিস নিয়ে বেঁচে থাকা ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলতেন এই দামি চিকিৎসা সপ্তাহে একাধিকবার কয়েক ঘণ্টা করে নিয়ে আসলে কারও পক্ষে স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব নয়। অথচ শুধু রক্তসম্পর্কীয়রাই কিডনি বা অন্য কোনো প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য দিতে পারবেন, এমন আইন যদি বাংলাদেশ বদলে ফেলে, তাহলে অনেকে দেশেই প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করে আবারও সুস্থ কর্মক্ষম জীবন ফিরে পেতে পারবেন।

Also Read: জাফর ভাইয়ের স্মৃতি: বিচিত্রা, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র

জাফরুল্লাহ ভাই বারবার এ নিয়ে কথা বলতে বলতেন মিডিয়াতে! টক শোতে স্টুডিওতে ঢুকেই আমাকে বলতেন, ‘নবনীতা, আমার কাজটা তো আপনি করলেন না!’ আমি আসলে জাফরুল্লাহ ভাইয়ের ওসব প্রাণের দাবি নিয়ে কিছুই করিনি। আমি এক সাধারণ ছাপোষা মানুষ, আমি এমন মহিরুহসম একরোখা বিপ্লবীর কাছে চিরঋণী থাকব, এ–ই তো স্বাভাবিক।

সর্বজন শ্রদ্ধেয় জাফরুল্লাহ ভাইকে সম্মান জানিয়ে আমাদের আইনপ্রণেতারা যদি বাংলাদেশে ১৯৯৯ সালে প্রণীত মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনটি সংশোধন করতেন, তাহলে সত্যি সত্যি আমি জানি যে জাফরুল্লাহ ভাই খুব খুব শান্তি পেতেন। ২০১৮ সালে উচ্চ আদালতও আত্মীয় না হলেও কোনো ব্যক্তিকে কিডনি দান করার বিধান রেখে আইন সংশোধনের রায় দিয়ে রেখেছে।

কোভিডের পর যে যে সামাজিক অনুষ্ঠানে কয়েক দফা আমার দেখা হয়েছে জাফরুল্লাহ ভাইয়ের সঙ্গে, মনে করে দেখছিলাম, প্রতিটি অনুষ্ঠানেই আমি হুইলচেয়ারে বসা জাফরুল্লাহ ভাই আর শিরীন আপার (শিরীন হক, জাফরুল্লাহ ভাইয়ের স্ত্রী এবং নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য) পাশে গিয়ে বসলেও জাফরুল্লাহ ভাই আসলে শুধু হেসেছেন এবং হাসিমুখে আমাদের আলাপ শুনেছেন। আমার সঙ্গে বা অন্য কারও সঙ্গে তাঁকে বিশেষ কথা বলতে দেখিনি কোভিড–পরবর্তী আর কোনো আয়োজনে। শরীরটা আসলে ভীষণভাবেই ভেঙে গিয়েছিল। কিডনি ডায়ালাইসিস করেও কর্মব্যস্ত থাকবেন, এটা বহু বছর ধরে জাফরুল্লাহ ভাইয়ের ‘চির উন্নত মম শির’ বিপ্লবী জীবনাচরণের একরকমের একরোখা বার্তা ছিল।

আমার মনে হতো, কোভিডের পর কেমন জানি দুমড়েমুচড়ে যাওয়া আমরা যখন সামাজিকতায় ফিরতে সহজ হয়ে উঠতে পারছি না, তখন যেন সভায়, সমাবেশে, দাওয়াতে বহু বছরের কিডনি ডায়ালাইসিসের রোগী আমাদের অশীতিপর জাফরুল্লাহ ভাই প্রকট কোভিড পরাস্ত করে এক রকম আমাদের আপাততরুণ প্রাণদের অভয় দিতেই হুইলচেয়ারে করে উপস্থিতি জানান দিতেন। তিনি উপস্থিত হলেই আমরা আশপাশে ফিসফাস শুরু করে বলতাম, ‘ভাই রে, মনের জোর আছে এই মানুষটার!’ সেই আগুন, সেই মনের জোর তখন ছড়িয়ে পড়ত আমাদের সবার মধ্যে। এ–ই বোধ হয় জাফরুল্লাহ ভাইকে আমাদের সবার ভালোবাসার সবচেয়ে বড় কারণ ছিল। সবার সঙ্গে মিষ্টভাষী, সবার জন্য হৃদয় খোলা, কান খোলা এমন এক সাহসী, নিজ স্বার্থচিন্তাহীন মানুষ তাঁকে ভালো না বাসলেও তাঁর পরার্থবোধকে বোধ হয় অগ্রাহ্য করা যায় না কিছুতেই।

কিছুদিন আগে শিরীন আপা আমার আগ্রহে তাঁর মা জাহেদা খানমের লেখা কয়েকটা কবিতার বই পাঠিয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি বই কবি কালিদাস রচিত মেঘদূতমের অনুবাদ। জাফরুল্লাহ ভাইয়ের শাশুড়ি কবি জাহেদা খানম তিনবছর ধরে সংস্কৃত শিখে কালিদাসের কাব্য অনুবাদ করেছিলেন। বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, সকলের সামনে বিশেষ করে জামাই ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সামনে মাস্টারের কাছে পড়তে বসতে লজ্জা পেতেন তিনি। কিন্তু তাঁর পড়াশোনার ব্যাপারে জামাইয়ের উৎসাহ জাহেদা খানমের ভাষায় ‘সে লজ্জাকে পরাভূত করেছে’। জামাই নাকি পারলে তখন ওই বয়সে শাশুড়িকে সংস্কৃত বিভাগে ভর্তি করিয়ে দেয়! শাশুড়ি জামাই সম্পর্কে লিখছেন, ‘এখন তারও আমি স্নেহের পাত্রী।’

Also Read: আমাদের উন্নয়ন ভাবনা ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

আমার প্রতি জাফরুল্লাহ ভাইয়ের অন্ধ ভালোবাসা এবং তাঁর স্বভাবসুলভ একরোখা পক্ষপাত ছিল। শিরীন আপা সামাজিক অনুষ্ঠানে তাঁকে পাশে বসিয়ে কৌতুকের সুরে বলতেন, বাড়িতে জাফরুল্লাহ ভাই নাকি কোনো কথা গুরুত্ব না দিয়ে শুনলেই তিনি ও তাঁর ছেলে বারীশ বলেন, এই কথা জাফরুল্লাহ ঠিক শুনতেন যদি নবনীতা বলত! শিরীন আপা দেখা হলেই আমাকে বলেন, ‘এই যে জাফরুল্লাহর প্রিয় নবনীতা চলে এসেছে।’ আমার জীবনে কুড়িয়ে পাওয়া এক অমূল্য ধন এই বিশেষ ভালোবাসা।

আসলে সবকিছুর শেষে ভালোবাসাটুকুই থাকে, থেকে যায়। বয়স, অবস্থান, শ্রেণিনির্বিশেষে ভালোবাসা আর গুরুত্ব দেওয়ার অপরিসীম ক্ষমতা ছিল জাফরুল্লাহ ভাইয়ের। আর ছিল নিজেকে সাধারণ ভাবার অপরিসীম ক্ষমতা। বিশেষভাবে এই দুই গুণের কারণেই বিপ্লবী, কর্মযোগী, সতত সমাজকল্যাণকামী আর বহু গুণবান জাফরুল্লাহ ভাইও আমার বড় প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। জাতীয় শোক তাই বোধ হয় আজ ব্যক্তিগত শোকগাথা হয়ে উঠল আমার প্রিয় জাফরুল্লাহ ভাইয়ের জন্য।

  • নবনীতা চৌধুরী ব্র্যাকের জেন্ডার কর্মসূচির পরিচালক।