Thank you for trying Sticky AMP!!

জিনেদিন জিদান: প্যান্ট ছিড়ে যাওয়ার আগে ও পরে

বাংলাদেশে আপনার প্যান্ট ছেঁড়ার গল্পটা কি মনে পড়ে, জিদান?

জিনেদিন জিদানের ৫০তম জন্মদিন ছিল গতকাল। সেই জন্মদিনে প্রথম আলোর ক্রীড়া সাংবাদিক রাশেদুল ইসলামের মনে পড়েছে ১৬ বছরের পুরোনো এক স্মৃতি। ২০০৬ সালে দুই দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন জিদান। বাংলাদেশের কিশোরদের সঙ্গে খেলেছিলেন একটি প্রদর্শনী ম্যাচেও। যে ম্যাচে প্রথমে জিদানের সতীর্থ ও পরে প্রতিপক্ষ হয়ে খেলেছেন তখন বিকেএসপির ছাত্র রাশেদুল ইসলাম। পরে বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলা রাশেদুল বলছেন সেই গল্পই। যাতে জিদানের সঙ্গে এক মাঠে নামার রোমাঞ্চ আছে, আছে বিচিত্র একটা অভিজ্ঞতাও।

‘বস, আমি রাইটব্যাকে আছি।’

ইমন মাহমুদের সঙ্গে কিক–অফ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, এমন সময় তাঁর কাছে গিয়ে কথাটি বললাম। ‘রাইট ব্যাক’–এর আগে পরের বাকি শব্দগুলো বোঝার কথা নয় ফরাসি মানুষটির। কিন্তু কী বুঝে ঠিকই বাঁ চোখ টিপ মেরেছিলেন। সেই স্মৃতি আজও জীবন্ত হয়ে আছে মনে।

মানুষটি যে আর কেউ নন, রক্ত–মাংসের সাক্ষাৎ জিনেদিন জিদান। শুধু ফ্রেঞ্চ ফুটবল নয়, বিশ্ব ফুটবলেরই মহানায়ক। মাত্র পাঁচ মাস আগে জার্মানি বিশ্বকাপে ফ্রান্সকে ফাইনালে তোলার মহানায়কও। সেই ফাইনালে মার্কো মাতেরাজ্জিকে ঢুস মারা কাণ্ডের খলনায়কও। যে ঢুস–কাণ্ডে ফ্রান্সের অধিনায়ক তখন সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি। গাজীপুরে গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতা এক মাঝবয়সী নারীর কাছেও জিদানকে শুনতে হয়েছিল, ‘আপনি মাথা দিয়ে গুঁতা মারছিলেন ক্যান?’

Also Read: পিএসজিকে একেবারে না বলে দেননি জিদান

হাতের কাছে জিদান!

গ্রামীণ ব্যাংক ও ফ্রান্সের বিখ্যাত শিশুখাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ডানোনের যৌথ উদ্যোগে বগুড়ায় গ্রামীণ-ডানোন ফুড ফ্যাক্টরি উদ্বোধন করতে ফুটবল কিংবদন্তি ঢাকায় পা রেখেছিলেন ২০০৬ সালে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ৬ নভেম্বর রাত সাড়ে ১০টায়। জিদান তখন লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো–পূর্ব যুগে ডিয়েগো ম্যারাডোনা ও পেলের পর ফুটবলের সবচেয়ে বড় তারকা। এর আগে মোহাম্মদ আলী ছাড়া বাংলাদেশে এমন বিশ্বতারকার পা পড়েনি বাংলাদেশে।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশে তখন রাজনৈতিক উত্তেজনা ছিল। জিদানের আগমনে হরতাল–ধর্মঘটে তিতিবিরক্ত এ দেশের মানুষের মনে লেগেছিল নতুন রং। জিদানের বাংলাদেশে আগমন এমনই আলোড়ন তুলেছিল যে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ইয়াজউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময় জিদানকে তিনি জাতীয় নির্বাচনে পর্যবেক্ষক হিসেবে আবার বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে সেই ম্যাচে জিদান। সবার বাঁয়ে রাশেদুল ইসলাম

মাত্র দুই দিনের ওই সফরকে ঘিরে অনেক আয়োজনও ছিল। সংবাদ সম্মেলন, সংবর্ধনা, প্রদর্শনী ম্যাচ ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার সঙ্গে ছিল নৈশভোজ। ঢাকায় পা রাখার পরদিন সকালে গাজীপুরে বাসন ইউনিয়নে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রকল্প পরিদর্শন করার মধ্য দিয়ে যা শুরু হয়েছিল। সেখানে শিশুদের সঙ্গে একটি প্রদর্শনী ম্যাচেও অংশ নিয়েছিলেন ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপজয়ী। সেদিনই বিকেলে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে দেশের দুই সমর্থকপ্রিয় আবাহনী লিমিটেড ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের অনূর্ধ্ব-১৬ দলের মধ্যকার ম্যাচে দুই দলের জার্সিতেও খেলেছিলেন ছবির দেশ, কবিতার দেশের ফুটবলশিল্পী।

Also Read: ফ্রান্স দলেই চক্র পূরণের ইচ্ছা জিদানের

প্যান্ট ছিড়ে যাওয়ার পর জিদান খেলেছেন ব্রাদার্সের শর্টস পরে

দুই অর্ধে ২০ মিনিট করে মোট ৪০ মিনিটের ম্যাচ। সেই ম্যাচেরই টিকিট বিক্রির স্বত্ব বিক্রি হয়েছিল ৭ লাখ টাকায়। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল দুই লাখ টাকায় পেয়েছিল টিভি স্বত্ব। অবসর নেওয়ার পরও আরেকবার জিদানের পায়ের জাদু দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল এ দেশের মানুষের। কিশোরদের সঙ্গে প্রদর্শনী ম্যাচ, তারপরও জিদান তো জিদানই। বেয়াড়া বলে আদুরে নিয়ন্ত্রণ, হেলেদুলে বাড়ানো প্রতিটি পাস—সবই ছিল আভিজাত্যমাখানো। এখনো ভেবে রোমাঞ্চিত হই, সেই ম্যাচে আমিও খেলেছি!

আমি তখন বিকেএসপির ছাত্র। সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৭ এএফসি কাপ খেলে এর কদিন আগেই দেশে ফিরেছি। এরই মধ্যে ডাক এল আবাহনীর কাছ থেকে, জিদানের আগমন উপলক্ষে তাঁর সম্মানে আয়োজিত প্রদর্শনী ম্যাচে খেলার। আকাশের চাঁদ যেন নিজ থেকে হাতে ধরা দিল। ম্যাচের আগে ও পরে কয়েকটা দিন রীতিমতো ঘোরের মধ্যেই কেটেছে।

তখন বিকেএসপিতে ছুটি। সরাসরি ফরিদপুর থেকে আবাহনী ক্লাবে ওঠা। স্পষ্ট মনে আছে, মশারি টানানোর কিছু না থাকায় আবাহনী ক্লাবে প্রথম রাতটা কাটিয়েছিলাম মশারি গায়ে দিয়ে। আমার অনূর্ধ্ব-১৭ দলের এক টি-শার্ট নজর কাড়ে আবাহনী ও জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আরিফ খান জয়ের। সেই টি-শার্টের আদলেই তৈরি হয়েছিল জিদান–ম্যাচে আবাহনীর জার্সি।

Also Read: ‘জিদানের সঙ্গে কথাই বলিনি’

জিদানের জাদু দেখেছে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম

আবাহনী ক্লাবে এর আগেই অন্য খেলার আরেক তারকার আবির্ভাব হয়েছে। ভারতের জাতীয় হকি অধিনায়ক ধনরাজ পিল্লাই আবাহনীর হয়ে খেলতে ঢাকায় এসেছেন, উঠেছেন পাশের রুমেই। ভরদুপুরে শরীরময় সোনার গয়না নিয়ে পিল্লাইয়ের বাবু হয়ে বসে থাকার দৃশ্যটাও এখনো মনে করতে পারি। জিদানের আগমনে হকি কিংবদন্তিও উচ্ছ্বসিত।

ম্যাচের আগের দিন সকাল থেকে ক্লাবে গণমাধ্যমের ভিড়। দুপুরের খাবারের টেবিলে আমার সামনে বসা প্রয়াত অমলেশ সেনের উদ্দেশে প্রথম আলোর প্রতিবেদক মাসুদ আলম ভাইয়ের একটি প্রশ্ন এখনো মনে আছে—‘জিদানকে আপনি কীভাবে খেলতে বলবেন?’

আমাকেও কী যেন প্রশ্ন করেছিলেন! জিদানের সঙ্গে খেলব—এই রোমাঞ্চের ঘোরে থাকা আমি উত্তর দিতে গিয়ে যথার্থ শব্দ খুঁজে পাইনি। পেশাদার খেলোয়াড়ি জীবনই শুরু হয়নি, তার আগেই জিদানকে মাঠে সতীর্থ খেলোয়াড় হিসেবে পেলে কী করব সেই পরিকল্পনা চলছে, প্রতিপক্ষ হিসেবে পেলে তাঁকে কীভাবে আটকাব—সে ভাবনায় ঘুম কামাই। কাগজে-কলমে অমলেশ সেন কোচ থাকলেও আমাদের অনুশীলন করিয়েছিলেন সাবেক ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়।

Also Read: পিএসজি-গুঞ্জনের মধ্যে কোচিং চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা জিদানের

জিদানকেও ছাড় দিতে রাজি ছিল না বাংলাদেশের কিশোররা

৭ নভেম্বর বিকেলে অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।

ম্যাচের শুরুতে জিদানের সঙ্গে খেলোয়াড়দের পরিচিতি। জিদানের সঙ্গে হাত মেলানোর পর নিজের হাত নাকে নিয়ে শুঁকে দেখেছিলাম। প্রথমার্ধে আবাহনীর জার্সিতে খেলেছিলেন জিদান, দ্বিতীয়ার্ধে মোহামেডানের জার্সিতে। নেমেছিলেন জার্সির সঙ্গে ‘মোবাইল’ ফুলপ্যান্ট পরে। আর ফুটবল বুটের জায়গায় কেডস।

জিদানকে সেদিন খুব বেশি কিছু করতে দিইনি আমরা! ম্যাচ শেষে আমরা নিজেরাই আফসোস করছিলাম—কেন জিদানকে বল না দিয়ে আমরা নিজেরাই বেশি খেলা দেখাতে গেলাম! প্রদর্শনী ম্যাচের মূল উদ্দেশ্যই তো ছিল জিদানের জাদু দেখা।

এর মধ্যেও একটি ছবি চিরন্তন। যে স্মৃতিতে ধুলো পড়বে না কখনো। বাতাসে ভাসছে বল। প্রতিপক্ষ কয়েকজন খেলোয়াড় সেই বলের দখল নিতে দৌড়াচ্ছে। সেই ভিড়ের মধ্যেই জিদান বলটা এমনভাবে বুকে নামালেন, যেন ওটা চঞ্চলমতি কোনো গোলাকার বস্তু নয়, তাঁর অনুগত কিছু। সেই বল দখলের লড়াইয়েই বাধে বিপত্তি। আমার আলতো ট্যাকলে পড়ে গিয়ে ছিঁড়ে গেল জিদানের প্যান্ট। এ জন্য আমাকে একটা ধন্যবাদ জানাতেই পারে ব্রাদার্স ইউনিয়ন। কারণ, ছিঁড়ে যাওয়া সেই প্যান্টের ওপর জিদান পরে নিয়েছিলেন দেশের আরেক সমর্থকপ্রিয় ক্লাব ব্রাদার্সের কমলা হাফ প্যান্ট।

Also Read: জিদানকে পিএসজিতে দেখতে চান ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট

জাদু দেখানো শেষ, মাঠ ছাড়ছেন জিদান

বাংলাদেশের মানুষের জন্য পেলে, ম্যারাডোনা, জিদানরা সহস্র আলোকবর্ষের দূরের ধ্রুবতারা। কিন্তু এই একজন কিংবদন্তি, যাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার অভিজ্ঞতা তো হয়েছেই, খেলার সৌভাগ্যও হয়েছে এ দেশের কিছু কিশোর ফুটবলারের। আমি নিশ্চিত, আমার মতো সবারই মনে সেই স্মৃতি এখনো অমলিন হয়ে আছে। ঢাকা ছাড়ার সময় দোভাষীর মাধ্যমে জিদান বলেছিলেন, সুযোগ হলে আবার বাংলাদেশে আসবেন।

২০১৬ চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে ভলফসবুর্গের বিপক্ষে করিম বেনজেমার সুযোগ নষ্ট করা দেখে হতাশায় লাথি মারতে গিয়ে নিজের প্যান্ট ছিঁড়ে ফেলেছিলেন সেই সময় রিয়াল মাদ্রিদের কোচ জিনেদিন জিদান। কদিন পর ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে আবার। এ নিয়ে বেশ হাস্যরসের জন্ম হয়েছিল, আলোচনা চলেছে বেশ কিছুদিন। কোচ হিসেবে প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার কথা মনে করার সময় প্যান্ট ছেঁড়ার সেই মুহূর্তের কথা ভেবে হয়তো মৃদু হাসি ফুটে ওঠে জিদানের ঠোঁটে।

জিদানের কাছে জানতে ইচ্ছে করে, বাংলাদেশে আবার আসার কথা হয়তো মনে নেই, কিন্তু এক কিশোরের ট্যাকলে প্যান্ট ছেঁড়ার গল্পটা কি মনে পড়ে আপনার?

Also Read: জিদান পিএসজির, জিদান পিএসজির নন