Thank you for trying Sticky AMP!!

কমলা–সৌন্দর্য, কমলা–দুঃখ

ফুটবল এমন এক খেলা, যেখানে গোল হওয়া না হওয়ার আনন্দ-বেদনার সঙ্গে জটিলতম সব ফরমেশন ও কৌশলের মজা পাওয়া যায়। যে যার জায়গা থেকে খেলাটাকে উপভোগ করতে পারার এই দুর্দান্ত সর্বজনীনতা খেলাটাকে দুনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ইভেন্টে পরিণত করেছে। আর নিঃসন্দেহে ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর হলো বিশ্বকাপ ফুটবল। চার বছর পরপর হওয়া এই টুর্নামেন্টের সময় গোটা পৃথিবীর নজর থাকে কে জিতল, কে হারল। খেলাটির সব রকম মানবীয় আবেগকে ধারণ করার যে ক্ষমতা, এ কারণে বিশ্বকাপ ফুটবল শুধু হার-জিতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই ইতিহাস তো মানুষেরই ইতিহাস। কাতারে আর কিছুদিন পরই শুরু হবে বিশ্বকাপের ২২তম আসর। তার আগে ফিরে তাকিয়ে ১৯৭৪ বিশ্বকাপের গল্প শোনা যাক।

কখনো এভাবে কল্পনা করেছেন, ফুটবলপাগল বাঙালি এই খেলায় যুগান্তকারী এক আবিষ্কার করে খেলাটার ধারা বদলে দিয়েছে!

দিবাস্বপ্ন বলতে পারেন। পাগলের প্রলাপ? পরিস্থিতি বিচারে সেটাও ঠিক। অথচ নেদারল্যান্ডস বাংলাদেশের মতোই সমুদ্রপৃষ্ঠের একদম প্রায় একই সমান্তরালের দেশ। পুঁজিবাদের সূচনাকারী দেশটিতেই আবিষ্কৃত হয়েছে টোটাল ফুটবল। এরপর তো খেলাটাই বদলে গেল। কিন্তু যাঁরা বদলে দিলেন, তাঁদের মাথায় বিশ্বসেরার মুকুট ওঠেনি। কিছু ট্র্যাজেডি নাকি ইতিহাসের অলংকার। ১৯৭৪ বিশ্বকাপের আভরণে তেমনই এক ‘অলংকার’ শোভা পাচ্ছে। ডাচ দুঃখ।

ব্রাজিল চিরতরে জুলে রিমে ট্রফি জিতে নেওয়ায় ইতালিয়ান ভাস্কর সিলভিও গাজ্জানিগার ডিজাইন করা নতুন ট্রফি নিয়ে বিশ্বকাপের দশম আসর বসে পশ্চিম জার্মানিতে। নতুন এক ফুটবলের আগমনী বাজে ১৯৭৪ সালের সেই আসরে, যা শুরু হয় ১৩ জুন আর শেষ হয় ২৫ জুলাই।

পশ্চিম জার্মানি ও স্পেন নিজেদের মধ্যে ১৯৬৬ সালে একটা চুক্তি করেছিল। ‘৭৪ আর ’৮২ বিশ্বকাপে নিজেদের স্বাগতিক হওয়ার প্রস্তাবে পাল্টাপাল্টি সমর্থন দেবে। তবে ফুটবল মাঠে স্পেন পাল্টাপাল্টি সমর্থনের মাধ্যমে জোগানো সাফল্য ধরে রাখতে পারেনি। সেবার যে বাছাইপর্ব উতরাতে পারেনি দলটি। তার চেয়েও বিস্ময়কর ছিল ইংল্যান্ড, পর্তুগাল, বেলজিয়াম, হাঙ্গেরি, চেকোস্লোভাকিয়া আর রোমানিয়ার বাদ পড়া।

Also Read: ১৯৭৪-৭৮ বিশ্বকাপ: টোটাল ফুটবলের ব্যর্থ উপাখ্যান

সোভিয়েত ইউনিয়নও ছিল বাদ পড়াদের দলেই। পেছনের কাহিনি ভিন্ন। সমাজতান্ত্রিক দেশটি সিআইএর পুতুল অত্যাচারী পিনোশের চিলিতে বাছাইপর্ব খেলতে অস্বীকৃতি জানায়। যে মাঠে খেলাটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, ন্যাশনাল স্টেডিয়াম খেলার কিছুদিন আগেও ব্যবহার করা হয় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ও ফায়ারিং স্কোয়াড হিসেবে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দল না পাঠানোয় ম্যাচের দিন চিলির খেলোয়াড়েরা ফাঁকা পোস্টে গোলের উৎসব করেন।

ইউরোপ থেকে সেবার স্বাগতিক হিসেবে পশ্চিম জার্মানি সরাসরি খেলার সুযোগ পায় আর বাকি আটটি দেশের মধ্যে ছিল বার্লিন ওয়াল দিয়ে ভাগ হওয়া ওপারের দেশ, কমিউনিস্ট–শাসিত পূর্ব জার্মানি। এ ছাড়া লাতিন আমেরিকার চারটি; হাইতি, জায়ারে ও অস্ট্রেলিয়া—এই ১৬টি দেশ মিলে চারটি গ্রুপে ভাগ হয়ে খেলে। অবশ্য ফরম্যাটে একটা পরিবর্তন এনে প্রতি গ্রুপ থেকে উত্তীর্ণ হওয়া দুটি দলকে আবার দ্বিতীয় রাউন্ডে দুই ভাগ করে দুই গ্রুপে খেলানো হয়। সেই দুই গ্রুপের চ্যাম্পিয়নরা খেলে ফাইনালে আর রানার্সআপ দলগুলো তৃতীয়-চতুর্থ স্থান নির্ধারণী ম্যাচে।

সেমিফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে জার্মানির দ্বিতীয় গোল করেন গার্ড মুলার

লটারির মাধ্যমে গ্রুপ নির্ধারিত হওয়ার পর দুই জার্মানিজুড়েই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। কারণ, পূর্ব ও পশ্চিম—দুই জার্মানিই ছিল একই গ্রুপে। ২২ জুনের ম্যাচে ইয়ুর্গেন স্পারভাসারের গোলে কমিউনিস্টরাই জেতে আর স্বাগতিকেরা হারে। অবশ্য অস্ট্রেলিয়া আর ফাঁকতালে সুযোগ পাওয়া চিলির সঙ্গে ভালো ফলের জোরে দুই দলই পরের রাউন্ডে যায়।

গ্রুপ ‘বি’ থেকেও ব্রাজিল আর যুগোস্লাভিয়া সহজেই পরের রাউন্ডে যায়। ধারে-ভারে অনেক দুর্বল হয়ে যাওয়া ব্রাজিল স্কটল্যান্ড আর যুগোস্লাভিয়ার সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করেছিল। আর জায়ারে যেন ছিল সবার শুটিং প্র্যাকটিসের দল। স্কটল্যান্ড দেয় ২টি, ব্রাজিল ৩টি আর স্লাভিকরা বড়ই নির্মমভাবে গুনে গুনে ৯টি গোল! গ্রুপ ‘সি’র চমক ছিল সুইডেন। তারা উরুগুয়েকে ৩ গোলে হারায় আর নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে ড্র করে।

পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি আইডিয়ার জন্মদাতা ডাচদের টোটাল ফুটবল নিয়ে সংক্ষেপে বলা যাক। বাংলাদেশের মতো কেবল নিচু ভূমিই নয়, পানির কারণে দেশটিতে জমির পরিমাণও অপ্রতুল। জায়গার ব্যবহারটা তাই ডাচরা আপনাই শিখেছিল। এই জায়গা ব্যবহার করাটাই টোটাল ফুটবলের অন্যতম দর্শন। এর সঙ্গে যোগ হয় অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরির ‘সমাজতান্ত্রিক’ ফুটবল থেকে পাওয়া ‘দশে মিলে করি কাজে’র ধারণা।

কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ডাচ কিংবদন্তি ইয়োহান ক্রুইফ

‘ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ’ বা ডাচ দলের ভয়ংকর সুন্দর রূপটা প্রথম টের পায় আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয় রাউন্ডের গ্রুপে প্রথম খেলায় লাতিন দলটি ৪ গোল খায়। নাম ক্লকওয়ার্ক হলে কী হবে, খেলাটা ‘যান্ত্রিক’ ছিল না; বরং শিল্প। পুরো দল ছিল যেন এক বহতা নদী। সবাই একযোগে আক্রমণে যাচ্ছে আবার সবাই মিলেই রক্ষণ সামলাচ্ছে। এ দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যেত প্রতিপক্ষ। ইয়োহান ক্রুইফ বলতেন, ‘ফুটবলটা পায়ের খেলা হলেও আসলে খেলাটা হয় মাথায়।’ সেই বিশ্বকাপে টোটাল ফুটবলের এই প্রতিভূর কাছে মাঠের সবুজ গালিচা ছিল যেন দাবার ছক।

সেই ‘কমলা’–সৌন্দর্য দেখে এক ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিক মন্তব্য করেছিলেন, ‘ওরা (ডাচরা) গোছানো উপায়ে অগোছালো।’ ব্রাজিলের সাধ্য ছিল না ওদের ঠেকায়।
নেসকেন্স আর ক্রুইফের ২ গোলে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল হারে। অবশ্য লাতিন সম্মানের লড়াইয়ে বুড়ো জর্জিনিওর ব্রাজিল আর্জেন্টিনাকে হারায় ২-১ গোলে আর রিভেলিনোর গোলে পূর্ব জার্মানিকে হারিয়ে গ্রুপে রানার্সআপ হয়।

জার্মান ডার্বিতে হারলেও ক্রমাগত ভালো খেলছিল পশ্চিম জার্মানি। দ্বিতীয় রাউন্ডের গ্রুপে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা পোল্যান্ডসহ সুইডেন আর যুগোস্লাভিয়াকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে তারা। পোল্যান্ডের সঙ্গে ম্যাচে একমাত্র গোলটি দেন আগের আসরে ১০ গোল দেওয়া গার্ড মুলার।

Also Read: ইয়োহান ক্রুইফ: অনন্য এক ফুটবলশিল্পী

একসময় টেক্সটাইল মিলে দৈনিক ১৪ ঘণ্টা কাজ করা মুলার জানতেন, ফুটবলই তাঁকে এনে দেবে মুক্তি, আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, গোলের সুযোগ হাতছাড়া মানে নিজের এই মুক্তির চেষ্টাকে বিপদে ফেলা, সেই ভুল কখনো না করা এই স্ট্রাইকার তাই আশায় ছিলেন ফাইনাল জয়ের। অবশ্য সেবার সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন পোল্যান্ডের লাটো। তাঁর সপ্তম গোলে ব্রাজিলকে হারিয়ে পূর্ব ইউরোপের দেশটি তৃতীয় হয়, যা এযাবৎকালে পোল্যান্ডের সেরা পারফরম্যান্স।

মিউনিখের ফাইনালে মাত্র দুই মিনিটের মাথায় পেনাল্টি থেকে গোলে এগিয়ে যায় ডাচরা। মাঠে দাপটও ছিল তাদের। টোটাল ফুটবলের ছকে আক্রমণের পর আক্রমণ হচ্ছিল। কিন্তু অটল দেয়ালের মতো সেগুলো ঠেকিয়ে দেন পশ্চিম জার্মানির গোলকিপার সেপ মেয়ার।

উল্টো ম্যাচের ২৫ মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করে স্বাগতিকদের সমতায় ফেরান পল ব্রেইটনার। সুযোগসন্ধানী মুলার দলকে এগিয়ে নেন ৪৩ মিনিটে। এরপর বাকিটা আসলে বেকেনবাওয়ারের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের খেলা।

বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে জার্মানির অধিনায়ক ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার

বেকেনবাওয়ারকে বলা হয় ‘কাইজার’, জার্মান ভাষায় সম্রাট। জন্মেছিলেন মিউনিখের এক শ্রমিক পরিবারে, কিন্তু খেলা ছিল রাজসিক। মাঝমাঠ থেকে আক্রমণে যেতেন আগুনের গোলার মতো। আবার বিপক্ষের আক্রমণও ঠেকাতেন। ১৯৫৪ সালের ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্সদের মতো ‘ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ’রাও পরাভূত হয় রক্ষণে একজন বেকেনবাওয়ার থাকায়, চ্যাম্পিয়ন হয় সেই পশ্চিম জার্মানিই (২-১)।

আরেক সম্রাটের কথা বলতে হয়। নেদারল্যান্ডস তো মাঠের খেলাটা পরিবর্তন করল আর ব্রাজিলিয়ান হাভেলাঞ্জ করলেন বাইরের খেলা। ইউরোপের পুরোনো অভিজাতদের ক্ষমতা থেকে হটিয়ে আফ্রিকা আর এশিয়ার সহায়তা নিয়ে বসলেন ফিফার মসনদে। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদের বিরুদ্ধে খেপে থাকা অন্য আফ্রিকান দেশগুলো আর সারা জীবন বঞ্চিত ভাবা এশীয়রা হাভেলাঞ্জের পক্ষে ভোট দেয়।

তবে ইতিহাসের অন্য অনেক অধ্যায়ের মতো হাভেলাঞ্জের এই রাজনীতি ছিল কেবলই ক্ষমতা দখলের জন্য, বঞ্চিতদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। ‘সম্রাট হাভেলাঞ্জ’ খেলাটাকে পরিণত করেন বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রিতে। পোপের চেয়ে ক্ষমতাশালী হাভেলাঞ্জ আর তাঁর সমর্থকেরা কেবল যে সেই ‘ইন্ডাস্ট্রি’র টাকার বড় অংশ কুক্ষিগত করতেন, তা–ই নয়, বিচারের ঊর্ধ্বেও ছিলেন।

আসলে ১৯৭৪ বিশ্বকাপ ফুটবলকে মাঠ ও মাঠের বাইরে চিরতরে পাল্টে দিয়েছিল।