ইয়োহান ক্রুইফ: অনন্য এক ফুটবলশিল্পী

ইয়োহান ক্রুইফ
ইয়োহান ক্রুইফ

ওটা যেন ছিল এক অন্তহীন ঘুম। ১৯৩৪ সালে প্রথম বিশ্বকাপ খেলে হল্যান্ড। খেলে ১৯৩৮ বিশ্বকাপও। এরপর ডাচ ফুটবলে নেমে আসে এক অস্বস্তিকর নীরবতা। মাঝখান দিয়ে পেরিয়ে যায় ৩৬টি বছর। উদীয়মান তারকা ইয়োহান ক্রুইফের চোখের সামনে দিয়ে চলে যায় ১৯৬৬ ও ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপ। ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা গেম মেকার কিছুতেই যেন পাচ্ছিলেন না বিশ্বকাপের মঞ্চ। ১৯৭৪ সালে ক্রুইফ যখন বিশ্বকাপ পেলেন, তার আগেই তিনি স্বাদ পেয়েছেন তিনবার ইউরোপের বর্ষসেরা খেলোয়াড় হওয়ার। হাতে তাঁর ব্যালন ডি’অরের তিনটি ট্রফি। ক্রুইফ বিশ্বকাপ পেলেন কথাটা বোধ হয় ঠিক হলো না। ক্রুইফকে পেয়েই যেন ধন্য হলো বিশ্ব ফুটবলের এই মহাযজ্ঞ—গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ।

চুয়াত্তরের বিশ্বকাপে আসতে পেরে যেন নিজেকে উজাড়ই করে দেন ক্রুইফ। তাঁর দেশ হল্যান্ডও স্মরণীয় করে রাখে দীর্ঘ বিরতির পর তাঁদের প্রত্যাবর্তনকে। নিজের সব অভিজ্ঞতাকে এক জায়গায় করে ক্রুইফ এই বিশ্বকাপেই ওলটপালট করে দেন ফুটবলের প্রথাগত ধ্যান-ধারণাকে। কোচ অব দ্য সেঞ্চুরিখ্যাত হল্যান্ড জাতীয় দলের তত্কালীন কোচ রাইনাস মিশেলের মস্তিষ্কপ্রসূত ‘টোটাল ফুটবল’কে মাঠে বাস্তবায়ন করে দেখান ক্রুইফরা। একটি মাত্র বিশ্বকাপে অংশ নিয়েই ক্রুইফ হয়ে যান বিশ্বকাপ ফুটবলের এক অন্যতম চরিত্র।

১৯৫৪ সালে ফ্রাঙ্ক পুসকাসের হাঙ্গেরির সঙ্গে অনেক দিক দিয়েই মিল ছিল ১৯৭৪ সালে ক্রুইফের হল্যান্ডের। আগাগোড়াই দাপুটে ফুটবল খেলে দুরন্ত গতিতে শিরোপার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তারা। ফাইনালের পথে ক্রুইফরা একে একে হারান উরুগুয়ে (২-০), বুলগেরিয়া (৪-১), আর্জেন্টিনা (৪-০), পূর্ব জার্মানি (২-০) এবং ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের (২-০) মতো দলকে। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে দুটি আর ব্রাজিলের বিপক্ষে একটি গোল আসে ওই ক্রুইফের পা থেকে। পুসকাসদের মতো ক্রুইফরাও ফাইনাল পর্যন্ত ছিলেন অপরাজিত। চুয়ান্নর ফাইনালের হাঙ্গেরির মতো চুয়াত্তরের ফাইনালেও হল্যান্ড হারে আগে গোল করে। প্রতিপক্ষও কাকতালভাবে ছিল তদানীন্তন পশ্চিম জার্মানি। ক্রুইফের কল্যাণে পাওয়া পেনাল্টি থেকে ম্যাচের দ্বিতীয় মিনিটেই হল্যান্ডকে এগিয়ে দিয়েছিলেন ইয়োহান নেসকেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ২-১ গোলে পরাজিত হন ক্রুইফরা। ১৯৫৪-এর পুসকাসের মতো চুয়াত্তরে সেরা খেলোয়াড়ের গোল্ডেন বল জেতেন ক্রুইফ।

টোটাল ফুটবল দর্শন অনুযায়ী প্রয়োজনমতো যেকোনো পজিশনে খেললেও ক্রুইফ মূলত ছিলেন মাঝমাঠের খেলোয়াড়। মাঝমাঠের খেলোয়াড় হলেও ক্রুইফকে বিপক্ষ দলের রাখতে হতো কড়া নজরদারিতে। যেকোনো মুহূর্তে গোল করে ফেলতে পারতেন তিনি। আর ক্রুইফ গোল করতে পারলেই কেল্লা ফতে। কেননা ক্রুইফ গোল পেয়েছেন এমন ম্যাচে কখনোই হারেনি হল্যান্ড। ক্রুইফ জাতীয় দলের হয়ে ৪৮ ম্যাচ খেলে করেন ৩৩ গোল।

আর্জেন্টিনায় ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপটা খেলেননি ক্রুইফ। মাত্র ৩০ বছর বয়সে ক্যারিয়ারের মধ্যগগন থেকে তিনি ১৯৭৭ সালেই বিদায় জানান ফুটবলকে। অবসরের আগে তিনি জাতীয় দলকে পার করে যান বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের বাধা। তার পরও ক্রুইফ বিশ্বকাপটা খেলেননি। হল্যান্ড টানা দ্বিতীয়বারের মতো হয় রানার্সআপ। ফাইনালে এবার তারা হারে স্বাগতিক আর্জেন্টিনার কাছে।

অপরিণত বয়সে ক্রুইফ কেন বিদায় নিয়েছিলেন? দীর্ঘ প্রায় তিন দশক এ ব্যাপারে মুখে কুলুপই এঁটে ছিলেন এই ডাচ তারকা। তবে ২০০৮ সালে তিনি স্বীকার করেছিলেন জীবনের প্রতি হুমকি আসাতেই ফুটবলটা ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে। তিনি নিজের মুখেই বলেছিলেন, ‘মাঝেমধ্যে জীবনটা ফুটবলের চেয়েও বড় হয়ে দেখা দেয়।’

চুয়াত্তরের বিশ্বকাপটা চিরদিনই পুড়িয়ে যাবে নিখাদ ফুটবলপ্রেমীদের। শ্রেষ্ঠ দল যে সব সময় বিশ্বকাপ জেতে না—চুয়াত্তরের বিশ্বকাপ বোধ হয় ব্যাপারটি ভালোভাবেই বুঝিয়ে ছেড়েছিল ফুটবলপ্রেমীদের। তবে হল্যান্ড সমর্থকদের দুঃখটা অন্য জায়গায়। আজও তাঁদের আফসোস, ১৯৭৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে ক্রুইফের কল্যাণে পাওয়া পেনাল্টি শটটি কেন ক্রুইফ নিজেই না নিয়ে নেসকেনকে দিলেন। গোলটি ক্রুইফ করলেই তো না পাওয়ার বেদনায় পুড়তে হয় না তাঁদের। ক্রুইফের গোল করা ম্যাচে কখনোই যে হারেনি হল্যান্ড!