Thank you for trying Sticky AMP!!

৬৪ ঘরের দুনিয়ায় প্রণবরা পারলেও ফাহাদরা কেন পারেন না

ছেলের খেলা তখনো শেষ হয়নি। বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় বাবা। উদ্বেগ তেমন ছিল না তাঁর মনে। জানতেন ছেলে জিতেই দিনের খেলা শেষ করবে। ১৭ বছর বয়সী ছেলে প্রণব ভেংকটেশের ওপর বাবা মাদিয়ালা ভেংকটেশের এমনই আস্থা। চেন্নাইয়ের বাসিন্দা বাবা-ছেলেকে দিন কয়েক আগে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে পাওয়া গেল পল্টনে বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের ক্রীড়াকক্ষে, যেখানে চলছিল প্রিমিয়ার দাবা লিগ।

প্রণব ২০২১ সালে প্রথমবার ঢাকায় আসে শেখ রাসেল গ্র্যান্ডমাস্টার দাবা টুর্নামেন্ট খেলতে। তখন সবে সে আন্তর্জাতিক মাস্টার হয়েছে, বয়স ১৫ পূর্ণ হয়নি। পরের বছর ২০২২ সালে আসে ঢাকা প্রিমিয়ার দাবা লিগে শাহীন চেস ক্লাবের পক্ষে খেলতে। তখনো গ্র্যান্ডমাস্টার হয়নি। সে বছরই আগস্টে রোমানিয়ার লিমপেদিয়া কাপে তৃতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার নর্ম পূরণ হয়ে যায় তার। মাত্র ১৫ বছর ১০ মাস বয়সে ভারতের ৭৫তম গ্র্যান্ডমাস্টার হয় কিশোর প্রণব। ১৬ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব পাওয়াটা যে অনেক বড় ব্যাপারই। নিজের দাবা প্রতিভাকে ৬৪ ঘরে সাফল্যে রূপান্তরিত করে প্রণব আজ ভারতীয় দাবায় উজ্জ্বল মুখ।

বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন আয়োজিত এবারের প্রিমিয়ার দাবা লিগে প্রণব খেলতে এসেছিল বাংলাদেশ বিমানের হয়ে। ১১ দলের টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ। বিমানকে রানার্সআপ করতে অগ্রণী ভূমিকা প্রণবের। লিগে বিমানের দ্বিতীয় বোর্ডে খেলেছে ২৬১১ রেটিংধারী প্রণব। ১০ ম্যাচের ৯টি জয়, একটি মাত্র ড্র। লিগে দ্বিতীয় বোর্ডে প্রণবই হয়েছে সেরা খেলোয়াড়।

ভারতে এমন দাবাড়ু অনেকেই আছে। তবে একজনের কথা আলাদা করে বলতেই হবে, রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দ। মাত্র ১২ বছর বয়সে গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছেন, বিশ্বের দ্বিতীয় কনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার তিনি। ১৭ বছর বয়সে গত বছর বিশ্বকাপ দাবার ফাইনালে খেলে সাড়া ফেলে দেন। দাবাময় পরিবেশেই তাঁরা বড় হন।

Also Read: মৃত্যুর ৫৮ বছর পর গ্র্যান্ডমাস্টার হলেন দাবার ‘সুলতান’

প্রণব ভেংকটেশদের এত অল্প বয়সে গ্র্যান্ডমাস্টার হয়ে যাওয়া নিয়ে কৌতূহল থেকেই তাঁর সঙ্গে কথা বলা। কথোপকথনের শুরুটা তার বাবার সঙ্গে। প্রণব তখন হল ঘরে খেলায় ব্যস্ত। ৪২ বছর বয়সী বাবা মাদিয়ালা ভেংকটেশ চেন্নাইয়ে একটি আইটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে হলেও ছেলের ছায়াসঙ্গী থাকেন দেশে-বিদেশ। তবে মাদিয়ালা ভেংকটেশের ভাষায় তাঁর ছেলের দাবাড়ু হয়ে ওঠা আসলে একটা ‘অ্যাকসিডেন্ট’। তবে এখানে ‘অ্যাকসিডেন্ট’ মানে দুর্ঘটনা নয়। হঠাৎ ঘটে যাওয়া এক ঘটনা, যা তাঁর ছেলের জীবনের গতিপথ স্থির করে দেয়।

বাবা মাদিয়ালা ভেংকটেশের সঙ্গে দাবাড়ু ছেলে প্রণব ভেংকটেশ

মাদিয়ালা বলতে থাকেন, ‘প্রণবের জন্ম ২০০৬ সালের ১৩ অক্টোবর। ওর বয়স যখন ৬ বছর, একদিন আমরা ওকে নিয়ে আমাদের এক আত্মীয়ের বাড়ি যাই। সেখানেই সে প্রথম দাবার বোর্ড দেখে। দেখে দুজন বোর্ডের দুই পাশে বসে দাবা খেলছে। খেলাটার প্রতি ওর আগ্রহ জন্মে। বাড়ি এসে বায়না ধরে দাবা বোর্ড চায়। আমি বোর্ড কিনে দিই এবং চাল শেখাই। এরপর আস্তে আস্তে আমার সঙ্গে খেলতে শুরু করে, যদিও আমি দাবাড়ু নই। খেলাটা টুকটাক জানতাম এই আরকি! পরে আমি টানা প্রায় ১০টি ম্যাচ ওর কাছে হেরে যাই। তখনই সে দাবার বিভিন্ন ওপেনিংয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়।’

সেই যে শুরু আর পেছন ফিরতে হয়নি। চেন্নাই শহরের বিদ্যাশ্রম স্কুলে পড়েছে প্রণব, যেখানে দাবা চর্চা হয়। চেন্নাইয়ে স্থানীয় দাবা একাডেমিতে ভর্তি হওয়া, অনূর্ধ্ব-১১ বিভাগে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি রেটিংধারী খেলোয়াড় হওয়া—সব ঘটে যেতে থাকে স্বপ্নের মতো। চেন্নাইয়ে অনেক দাবা টুর্নামন্টে হয়। চেন্নাই ওপেনের কথা তো অনেকেই জানেন। বাংলাদেশের দাবাড়ুরা সেখানে খেলতে যান। এসব টুর্নামেন্টে খেলেই নিজেকে তৈরি করেছে প্রণব।

Also Read: বারবার কেন স্বপ্নভঙ্গ ফাহাদের

বেশ কয়েকজন কোচের অধীনে নিজের দাবা প্রতিভা মেলে ধরার সুযোগ পেয়েছে সে। যার মধ্যে আছেন তামিলনাড়ুর বিখ্যাত দাবা কোচ কামেস্মরণ বিশেস্মরণ। লক্ষ্মণ, সেথুরামন, জি আকাশ, কিদাম্বিসহ  তামিলনাড়ুর অনেক গ্র্যান্ডমাস্টারই তাঁর হাতে তৈরি। ভারতের ৩০ জনের বেশি গ্র্যান্ডমাস্টার তৈরিতে ভূমিকা আছে তাঁর।

তামিলনাড়ু রাজ্যকে ভারতের দাবাড়ুদের খনিই বলা যায়। বর্তমানে দেশটির ৮৪ জন গ্র্যান্ডমাস্টারের ৩০ জনই তামিলনাড়ুর। অনেক বিখ্যাত দাবাড়ুই এই অঞ্চলের। পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বিশ্বনাথন আনন্দ, হালের মহাতারকা রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দদের বাড়ি চেন্নাই। পাশের মহারাষ্ট্র, কর্ণাটকের মতো রাজ্যগুলো থেকেও উঠে আসছে একের পর এক দাবাড়ু। মাদিয়ালা ভেংকটেশ বলেন, ‘চেন্নাই মানে ক্রিকেট, মহেন্দ্র সিং ধোনি। অনেক বছর চেন্নাই সুপার কিংসের অধিনায়ক। তবে চেন্নাই মানে দাবাও বলতে পারেন। বিশ্বনাথন আনন্দ আর আমার বাড়ি ২০-২৫ কিলোমিটার দূরত্বে। প্রজ্ঞানন্দের বাড়িও আমার বাড়ি থেকে প্রায় একই দূরত্বে।’

দাবাড়ু ফাহাদ রহমান

বাবার সঙ্গে গল্পের এ রকম সময়ে ছেলে এসে গেল খেলা শেষ করে। তার কাছেও জানতে চাওয়া হলো কীভাবে দাবার সঙ্গে পরিচয়? প্রণব পেছন ফেরে এবং বাবার মতো সে–ও ‘অ্যাকসিডেন্ট’ শব্দটা উচ্চারণ করে বলল, ‘এক আত্মীয়ের বাড়িতে বাবা-মায়ের সঙ্গে গিয়ে প্রথমবার দাবার বোর্ড দেখে আমার ভালো লেগে যায়। তখনই খেলাটার প্রতি ভীষণ আগ্রহ জন্মে।’

গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার পথটা কেমন ছিল, সেটাও শোনা হলো প্রণবের মুখে, ‘২০১৬ সালে অনূর্ধ্ব–১০ বিভাগে আমি ছিলাম বিশ্বসেরা। আমি ফিদে মাস্টার খেতাব নিইনি। ২০২১ সালে আইএম হই, এক বছরের মধ্যে গ্র্যান্ডমাস্টার। কিছু ক্ষেত্রে আমার যাত্রা সহজ ছিল। আবার কখনো কখনো কঠিন। কিছুদিন আমার রেটিং এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল। তখন সময়টা ভালো যায়নি।’

বিশ্বনাথন আনন্দকে দেখে ভারতের অনেক কিশোর-তরুণই দাবায় এসেছে। প্রণবও ব্যতিক্রম নয়। আনন্দের সঙ্গে কখনো তার খেলা হয়নি, তবে আনন্দের হাত থেকে চেন্নাইয়ের বিভিন্ন টুর্নামেন্টে পুরস্কার নিয়েছে।

গ্র্যান্ডমাস্টার হতে অনেক আর্থিক বিনিয়োগ প্রয়োজন। ছেলেকে এই পর্যায়ে আনতে সেই লড়াইটা করতে হয়েছে মাদিয়ালা ভেংকটেশকেও, ‘বন্ধুবান্ধবেরা সহায়তা করেছে। ভারতের দাবা ফেডারেশনের সহায়তা পেয়েছি। তামিলনাড়ু সরকার সহায়তা করেছে। ইউরোপে যেতে–আসতে অনেক খরচ। স্থানীয় ব্যবসায়ী কৈলাশ নাদনও সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন।’

Also Read: দাবার আলোয় দুই বোন

গ্র্যান্ডমাস্টার নর্মের জন্য অল ইন্ডিয়া চেস ফেডারেশন প্রণবকে সহায়তা করেছে ইউরোপ যেতে। আইএম থেকে জিএম হওয়ার মাঝখানে এক বছর ১২টি টুর্নামেন্ট খেলেছে। বেশির ভাগই সার্বিয়া, হাঙ্গেরি, ফ্রান্স, রোমানিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। সব সফরেই বাবা ছিলেন ছেলের সঙ্গে। গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার পর নামিলনাড়ু রাজ্য সরকার প্রণবকে ৫ লাখ রুপি পুরস্কার দেয়। পুরস্কার দেয় ভারতের দাবা ফেডারশনও।

ভারতের দাবাড়ুদের উঠে আসার পথটা এখন এ রকম মসৃণ হলেও ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের দাবার গর্ব নিয়াজ মোরশেদ যখন গ্র্যান্ডমাস্টান হন, ভারতে তখন কোনো গ্র্যান্ডমাস্টারই ছিলেন না। ১৯৮৮ সালে ভারত প্রথম বিশ্বনাথন আনন্দকে গ্র্যান্ডমাস্টার হিসেবে পায়। এর পর থেকে সেখানে দিন দিন গ্র্যান্ডমাস্টার বেড়েই চলেছে। ২০২৩ সালেই হয়েছেন ৭ জন। অথচ বাংলাদেশ থমকে আছে এক জায়গায়।

১৫ বছর ধরে বাংলাদেশ পায়নি কোনো গ্র্যান্ডমাস্টার। ২০১৯ সালের মার্চে ফাহাদ রহমান আন্তর্জাতিক মাস্টার হওয়ার পর প্রায় পাঁচ বছর হতে চলল। কিন্তু আজও কোনো গ্র্যান্ডমাস্টার নর্ম পাননি ২০ বছরের তরুণ। বেশ কয়েকবার খালি হাতে ফিরেছেন। আবু সুফিয়ান শাকিল ২০১১ সালের মার্চে আন্তর্জাতিক মাস্টার হওয়ার পর ১২ বছর পেরিয়েছে, কিন্তু এখনো গ্র্যান্ডমাস্টার হননি। একই বছর শেষ দিকে আন্তর্জাতিক মাস্টার হন মিনহাজউদ্দিন সাগর। তিনিও এক যুগে পারেননি গ্র্যান্ডমাস্টার হতে।

Also Read: আর কত দিন খেলবেন জানেন না নিয়াজ মোরশেদ

প্রণবের সঙ্গে বাংলাদেশ বিমানে খেলা আন্তর্জাতিক মাস্টার আবু সুফিয়ান শাকিলের মতে, ‘২০০৯ সালে দাবা ফেডারেশনে যে কমিটি এসেছিল, তারা দাবার উন্নয়নে কোনো কাজ করতে পারেনি। উল্টো অনেকে তখন রাগে–ক্ষোভে খেলেননি। রাকিব-রাজীবরা সরে যায় দাবা থেকে। খেলা না থাকায় অনেকের রেটিং কমে যায়। কারও কারও ২০০ রেটিংও কম। যার মধ্যে আমিও ছিলাম। সেই শূন্যতা গেছে কয়েক বছর ধরে। ওই কমিটি বিদায় নেওয়ার পর এর প্রভাব আমার ওপরও পড়েছে।’

ফাহাদ গত বছর প্রায় ১০টি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলেও কাঙ্ক্ষিত প্রথম নর্মটাই এখনো পাননি। শেষ ধাপে গিয়ে স্নায়ুচাপে ভেঙে পড়েন। অন্তত ৪-৫টি টুর্নামেন্টে এমনই দেখা গেছে। প্রণব ভেংকটেশদের স্নায়ুর জোর অনেক। আর এখানেই ফাহাদরা পিছিয়ে যান। সুযোগ–সুবিধার কথা নাই-বা বলা হলো।

Also Read: ‘আমরা আলতু–ফালতু জিনিস নিয়ে আছি’