প্লাস্টিক বর্জ্যের ক্ষতির দিক আবারও মনে করিয়ে দিতে হবে
সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) দুবাইয়ে গত ৩০ নভেম্বর শুরু হয়েছে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৮)। বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকার প্রক্রিয়ায় লাগাম টেনে ধরার উপায় নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা সেখানে ইতিমধ্যে বিতর্কে জড়িত রয়েছেন।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনে নানা রকম যেসব প্রক্রিয়া অবদান রেখে যাচ্ছে, তার প্রায় সব কটির মূলেই আছে মানবজীবন সহজ ও আরামদায়ক করে নিতে বিশ্বজুড়ে মানুষের নেওয়া পদক্ষেপ। সে রকম পদক্ষেপের ক্ষতিকর দিকগুলো শুরুতে নজর এড়িয়ে গেলেও সমস্যার গভীরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় একসময় যখন নিজ ঘরের পাশে সেটাকে নিয়ে আসে, তখন নজর ফিরিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। সমাধানের পথ খুঁজে বের করা নিয়ে তখন হিমশিম খেতে হয়। প্লাস্টিক বর্জ্য হচ্ছে সে রকম এক সমস্যা। সমুদ্রদূষণে এর বড় অবদান এখন আর অজানা নয়। পাশাপাশি প্লাস্টিক পুড়িয়ে ফেলা যে ক্ষতিকর গ্যাসের নিঃসরণ বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে, সেটাও এখন সহজেই জানা যায়। তবে তা সত্ত্বেও সমাধানের প্রক্রিয়ায় খুব বেশি যে অগ্রসর হওয়া গেছে, তা অবশ্য বলা যায় না।
প্রতিবছর আনুমানিক ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে ফেলা হচ্ছে। প্লাস্টিক পচনশীল পদার্থ না হওয়ায় সমুদ্রের পানিতে তা দ্রবীভূত হয় না, বরং ভেঙে টুকরা হয়ে যাওয়ার পরও সাগরে এর উপস্থিতি থেকে যায়। বিজ্ঞানীরা হিসাব করেছেন, প্লাস্টিক দূষণ সামাল দেওয়ার সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করে চলমান গতিতে প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে ফেলে দেওয়া চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রে জমা হওয়া প্লাস্টিকের পরিমাণ হবে মাছের চেয়ে বেশি।
জাপানে বছরে জনপ্রতি ১০৬ কিলোগ্রাম প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, যা চীন, ভারতসহ অবশিষ্ট এশিয়ায় জনপ্রতি (৯৪ কিলোগ্রাম) প্লাস্টিক বর্জ্যের চেয়ে বেশি।
এই সমস্যার দ্রুত সমাধান এখন পৃথিবীর পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এ কারণেই জাতিসংঘের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ও দেশ প্লাস্টিক বর্জ্য সমস্যা নিয়ে বিশ্ববাসীকে সতর্ক করে দেওয়া ছাড়াও সমাধানের নানা রকম পথের সন্ধান করে আসছে।
বিশ্বজুড়ে এখন পর্যন্ত যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তার অধিকাংশই হচ্ছে সমস্যার ব্যাপ্তি চাপা দিয়ে রেখে ভিন্নপথের অনুসন্ধান অব্যাহত রাখা।
গত মে মাসে জাপানের হিরোশিমা শহরে বসেছিল বিশ্বের প্রভাবশালী সাতটি দেশের জোট জি-৭–এর বার্ষিক সম্মেলন। বিশ্বের সেই স্বঘোষিত মোড়লেরা সেখানে পরিবেশ সমস্যা নিয়ে তারা যে কতটা চিন্তিত, তা তুলে ধরার জন্য সম্মেলনের শেষে প্রচারিত চূড়ান্ত ঘোষণায় টেকসই বিশ্বের লক্ষ্য অর্জনের জন্য সমুদ্রে প্লাস্টিক বর্জ্যের দূষণ সমস্যার সমাধানে কী করা দরকার, সেই উপদেশ বিশ্ববাসীর গোচরে এনেছে। তারা বলেছে, ২০৪০ সালের মধ্যে অতিরিক্ত প্লাস্টিক দূষণ শূন্যের ঘরে নামিয়ে আনতে নেতারা সম্মত হয়েছেন। ঘোষণায় আরও বলা হয়েছে, সাগরে জমা হতে থাকা প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ হ্রাসে সক্রিয় পদক্ষেপ সাতটি দেশ গ্রহণ করবে।
প্রথম বাক্যে যা বলা হয়েছে, তা হলো ‘অতিরিক্ত প্লাস্টিক দূষণ শূন্যের ঘরে নামিয়ে আনা হবে।’ অর্থাৎ ধরে নেওয়া যায়, এখন পর্যন্ত যতটা প্লাস্টিক জমা হয়েছে, তা নিয়ে খুব বেশি মাথাব্যথা সেসব দেশের নেই। যদিও পরিসংখ্যানগত হিসাবের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, সমুদ্রে প্লাস্টিক বর্জ্যের দূষণের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রয়েছে এদের।
প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি করার মাথাপিছু পরিমাণের হিসাবে বিশ্বের ১ নম্বর দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এবং এর ঠিক পরেই জাপানের অবস্থান। জাপানে বছরে জনপ্রতি ১০৬ কিলোগ্রাম প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, যা চীন, ভারতসহ অবশিষ্ট এশিয়ায় জন প্রতি (৯৪ কিলোগ্রাম) প্লাস্টিক বর্জ্যের চেয়ে বেশি।
প্লাস্টিকের মাথাপিছু ব্যবহারে এগিয়ে থাকা দেশ জাপান একই সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্লাস্টিক সামগ্রী উৎপাদনকারী দেশও। একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক জাপানে প্রধানত খাদ্যসামগ্রীর বেলায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। জাপানের সুপারমার্কেটে বিক্রি হওয়া ফল ও সবজিও কয়েকটি ধাপের প্লাস্টিক মোড়কে আচ্ছাদিত থাকে। এর বাইরে খাবার পানিসহ নানা পানীয় প্লাস্টিকের বোতলেই কেবল পাওয়া যায়। ফলে হালকা ও সহজ ব্যবহারের এই পণ্যের প্রচলন জাপানে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অবশ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবহৃত প্লাস্টিকের যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে নিতে বেশ কিছু আইন জাপানে কার্যকর করা হয়েছে। এর কিছু সুফল দেখা গেলেও সমস্যার সার্বিক সমাধানের পথ তা করে দিচ্ছে না। এই ক্ষেত্রে জাপানের সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে বিভিন্ন রকমের পানীয়র জন্য ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বোতল রিসাইকেল (পুনর্ব্যবহারযোগ্য) করে নেওয়ার দিক থেকে।
জাতিসংঘের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ও দেশ প্লাস্টিক বর্জ্য সমস্যা নিয়ে বিশ্ববাসীকে সতর্ক করে দেওয়া ছাড়াও সমাধানের নানা রকম পথের সন্ধান করে আসছে।
সাধারণভাবে জাপানে পেট বোতল নামে পরিচিত প্লাস্টিকের বোতল রিসাইকেল করে নেওয়ার হার বর্তমানে প্রায় ৮৮ শতাংশ। ফলে বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের মতো সমুদ্রের পাড়ে কিংবা অন্যত্র এখন প্লাস্টিক বোতল পরে থাকা খুব একটা চোখে পড়ে না। অন্য আরেকটি দিকে আংশিক যে সাফল্য জাপান নিশ্চিত করতে পেরেছে, তা হলো প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার হ্রাস করা। জাপানের দোকানে আজকাল কেনাকাটা করার পর পণ্য বহনের জন্য প্লাস্টিকের ব্যাগ বিনা মূল্যে সরবরাহ করা হয় না, বরং অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধ করে তা কিনে নিতে হয়। মূল্য যৎসামান্য হলেও প্লাস্টিক ব্যাগের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে মানুষকে তা মনে করিয়ে দেয় বলে ক্রেতাদের অনেকেই দোকানে, বিশেষ করে সুপারমার্কেটে কেনাকাটা করতে যাওয়ার আগে নিজেদের কাপড়ের ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন।
চলমান গতিতে প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে ফেলে দেওয়া চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রে জমা হওয়া প্লাস্টিকের পরিমাণ হবে মাছের চেয়ে বেশি।
প্লাস্টিকের ব্যবহার হ্রাসের আরেকটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের সার্বিক পরিমাণ হ্রাসে অবদান রাখা। প্লাস্টিক বর্জ্যের ব্যবস্থাপনার সহজ একটি দিক হলো এগুলো পুড়িয়ে ফেলা। তবে প্লাস্টিক পোড়ানোর প্রক্রিয়া বিপুল পরিমাণ ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাস বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দেয়। ফলে প্লাস্টিকের ব্যবহার সীমিত করা সেদিক থেকে হচ্ছে উপকারী একটি দিক। এই ক্ষেত্রেও জাপানের সাফল্য খাটো করে দেখার উপায় নেই।
প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করায় এসব সাফল্য সত্ত্বেও জাপানের প্লাস্টিক শিল্পের অন্য যেদিকটি সাধারণত মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়, তা হলো রপ্তানির জন্য প্লাস্টিক উৎপাদন। নিজের দেশে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারের ওপর রাশ টানা হলেও প্লাস্টিক রপ্তানির বেলায় নিয়ন্ত্রণ জাপানে একেবারে নেই বললেই চলে। অনেক দিন থেকেই বিশাল পরিমাণের প্লাস্টিক সামগ্রী জাপান প্রধানত এশিয়ার দেশগুলোয় রপ্তানি করে আসছে। চীন একসময় ছিল জাপানের প্লাস্টিকের বিশাল এক বাজার।
তবে চীন সরকার ২০১৭ সালে প্লাস্টিক আমদানি নিষিদ্ধ করলে সেই বাজার জাপানকে হারাতে হওয়ায় প্লাস্টিকের রপ্তানি আংশিকভাবে হ্রাস পেলেও এশিয়ার অন্যান্য দেশে ক্ষতিকর এই পণ্যের রপ্তানি এখনো প্রায় সমমাত্রায় বজায় আছে। ফলে এশিয়ার অনেক দেশে রপ্তানি হওয়া জাপানের প্লাস্টিকের বড় এক অংশের সর্বশেষ গন্তব্য হচ্ছে সাগর, সামুদ্রিক জীবনের ওপর হুমকি যা ক্রমেই আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে প্লাস্টিক বর্জ্য পোড়ানোর প্রক্রিয়াও মনে হয় পরিবেশসংক্রান্ত সমস্যার বোঝা আরও কিছুটা ভারী করে দিচ্ছে। ফলে এই সমস্যার দিকে আরও বেশি মনোযোগী হয়ে সমাধানের উপায় নিয়ে ভেবে দেখার দিকগুলো মনে হয় কপ-২৮ আবারও মনে করিয়ে দিতে সক্ষম হবে।
আরও পড়ুন
-
রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারচর্চার খোঁজ নিলেন লু
-
নতুন করে রিজার্ভ চুরি হয়নি: বাংলাদেশ ব্যাংক
-
‘যুদ্ধশিশু’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন মেরিনা, পিতার নাম ছাড়াই সব সুবিধা পাবেন তিনি
-
ছাত্রলীগের ওপরে কোনো সন্ত্রাস নাই, কোনো শক্তি নাই: জাজিরা ছাত্রলীগের সভাপতি
-
‘সন্তান দুনিয়াতে আসবে, দেখতে পাব কি না, জানতাম না’