সবুজ মেঘের ছায়া-পাঁচ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

তারা তিনজন তিন কাপ চা নিয়ে ডেকের আউটডোর সেটিংয়ের তিনটা চেয়ার নিয়ে বসতেই নাবিদ সরাসরি নদীর বাবার প্রসঙ্গটাই টানল। নাবিদ বলল, নদী, তোমার বাবা যে কী সুন্দর আর কী সুপুরুষ ছিলেন!

নদী মৃদু হেসে বলল, তাই নাকি?

: তাহলে আর কী বলছি? আমাদের চৌধুরী বাড়ির মা-চাচিরা তাকে দুষ্টামি করে ডাকতেন বুলবুল আহমেদ। একবার রাজীব চাচা চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালে কক্সবাজার ঘুরতে গিয়েছিলেন। তখন সেখানে কী একটা বাংলা সিনেমার শুটিং চলছিল। রাজীব চাচা শুটিং স্পটে শুটিং দেখতে উপস্থিত হন। শুটিং স্পটে তাকে দেখে সেই বাংলা সিনেমার পরিচালক সরাসরি পরবর্তী ছবির নায়ক হওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বসেন।

: বাবা তখন কী করলেন?

: তিনি আর কী করবেন? সঙ্গে সঙ্গে না করে দিলেন। তিনি সিনেমার নায়ক হবেন, খেয়ে দেয়ে আর কাজ নেই...! তোমার দাদাকে তো তুমি দেখনি। জমিদারি রক্তটা মনে হয় তার ভেতর টগবগ করত। তোমার বাবাসহ বাড়ির সবাই তাকে খুব ভয় পেত। আর চৌধুরী বাড়িতে তিনিই একমাত্র মুরব্বি, যিনি বাড়িতে থাকতেন।

নদী মাথা ঝাঁকাল। এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেল। বলল, দাদাকে কোনো দিন দেখিনি, ওটাই ভালো। এ কালে মানুষের এমন চরিত্র কে মেনে নেয়?

জুঁই সায় দিয়ে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ নদী।

নদী জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসল।

নাবিদ বলল, আচ্ছা, নদী, তোমার দাদার প্রসঙ্গ বাদ দাও। রাজীব চাচার সম্বন্ধেই গল্প করি। তোমার বাবা যখন কলেজে পড়তেন তখন এলাকার কত মেয়ে যে তার জন্য পাগল ছিল! এদের মধ্যে আমাদের চৌধুরী বাড়ির দু-একজনও ছিল। তারা আমাকে দিয়ে গোপনে চিঠি লিখে পাঠাত। চিঠির বাহক হিসেবে আমি সঙ্গে একটা আধুলি বা এক টাকা পেতাম।

নদী আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, সেই চিঠি আপনি কি বাবার কাছে পৌঁছে দিতেন?

: হ্যাঁ, দিতাম।

: বাবা সেই চিঠি নিয়ে কী করতেন।

: তিনি কিছুই করতেন না। একটা মুচকি হাসি দিয়ে চিঠিগুলো টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দিতেন।

: বাবা কি চিঠিগুলোর উত্তর দিতেন না?

: না, কখনো না। চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালেও তিনি যখন বাড়িতে আসতেন, তখনো ঠিক এমনটাই হয়েছে। আমি তখন অবশ্য বড় হয়ে গেছি। তখন আর চিঠির বাহক হতাম না। কিন্তু আমাদের চৌধুরী বাড়ির মেয়েরা তার আশপাশে ঘুরঘুর করত। এলাকার মেয়েদের কথা বাদই দিলাম। আমার তখন মনে হতো, রাজীব চাচা নিজের ব্যাপারে একটু অহংকারী। কিন্তু অনেক পরে বুঝতে পারি, তিনি ইউনিভার্সিটিতে চুটিয়ে তোমার মার সঙ্গে প্রেম করছেন।

: আপনি কি বাবা-মার সম্পর্কের কথাটা জানতেন?

: প্রথম প্রথম জানতে বা বুঝতে পারিনি। পরে অবশ্য তোমার বাবাই আমাকে বলেন। তোমার বাবা আর আমার মধ্যে বয়সের পার্থক্য থাকলেও আমরা বন্ধুর মতো ছিলাম। চৌধুরী বাড়িতে শুধু আমিই তোমার বাবা-মার সম্পর্কটা জানতাম। তোমার দাদা বা বাড়ির অন্যেরা আগে থেকে জানলে রাজীব চাচার জন্য ভালোই হতো। হঠাৎ করে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো না।

: হঠাৎ করে কী পরিস্থিতি?

: ওই যে, বাড়ি থেকে তোমার দাদার বের করে দেওয়া বা তোমার বাবার চলে যাওয়া। তবে তোমার বাবাও খুব রাগী ছিলেন। আমার সঙ্গে তোমার বাবার বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক ছিল বলে চলতে ফিরতে কখনো কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু বাড়ির ছোটরা তাকে খুব ভয় পেত। বড়রাও অনেকে সমীহ করতেন। সেদিন তিনি যদি একটু নরম হতেন, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অন্য হতো।

নদী জানে না, সেদিন পরিস্থিতি আর কেমন হতো। সে তার মার কাছে সেই পরিস্থিতিটা নিয়ে বহুবার বহু কথা শুনেছে। প্রতিবারই মা সেই পরিস্থিতির বর্ণনা করতে গিয়ে মন খারাপ করেছেন। অনেক সময় কেঁদেছেনও। মার কান্নায় তারও চোখ ভিজে আসত।

নাবিদ বলল, চাচি কিন্তু অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন। ফরসা চেহারা। বড় বড় চোখ। দেখতে অনেকটা প্রতিমার মতো ছিলেন। যদিও আমি তাকে জীবনে একবারই দেখেছি। রাজীব চাচা যখন তাকে বিয়ে করে বাড়িতে আনেন, তখন। আচ্ছা নদী, চাচি কি এখনো সেই সুন্দর আছেন?

: না ভাইয়া। মার বয়স হয়েছে না?

: হ্যাঁ, বয়স তো হয়েছেই। সেই ছাব্বিশ-সাতাশ বছর আগে দেখেছি। তখন আমার বয়স কতই বা ছিল, পনেরো কী ষোলো।

জুঁই এতক্ষণ চুপ থেকে চা খেতে খেতে তাদের কথা শুনছিল। এবার সে বলে উঠল, নাবিদ, তোমারও তো বয়স কম হয় নাই?

নাবিদ বলল, তোমার সঙ্গে চৌদ্দ বছর ধরে সংসার করছি। বয়স তো হবেই।

জুঁই জিজ্ঞেস করল, বয়সটা কী আমার সঙ্গে চৌদ্দ বছর সংসার করার কারণে হয়েছে, নাকি অন্য কারণে?

: ওই একটা কারণে হলেই হলো। তোমার সঙ্গে চৌদ্দ বছর সংসার করার কারণেও হতে পারে। অন্য কারণেও হতে পারে।

: অন্য কারণটা কী শুনতে পারি?

: হ্যাঁ, শুনতে পার।

: তাহলে বল।

: না, এখন বলা যাবে না। এখানে আমার বোন আছে। সে প্রথম আমার বাসায় এসেছে।

জুঁই ঝামটি মেরে বলল, ঢং!

নদী হেসে ফেলল। নদীর সঙ্গে সঙ্গে নাবিদও হেসে ফেলল।

জুঁই অবশ্য ঝামটি মারলেও পরক্ষণ সে হেসে ফেলল।

নদী কী ভেবে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করার জন্য জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া, বাবাকে নিয়ে আপনার কোনো স্মৃতি মনে আছে?

নাবিদ বলল, আরে, রাজীব চাচার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। কয়টা বলব?

নদী অনুরোধের গলায় বলল, দু-একটা বলেন না, প্লিজ।

নাবিদ মাথা ঝাঁকিয়ে একটু ভেবে বলল, হ্যাঁ, রাজীব চাচা চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালে এক-দুই মাস পর পর তিনি বাড়ি আসতেন। বাড়িতে এলে তিনি প্রায়ই আমাকে নিয়ে তিতাসের পাড়ে হাঁটতে যেতেন। তিতাসের পাড়ে ছিল সারি সারি কলাবাগান। আমরা তিতাস নদীতে একবার নৌকা বাইতে গিয়ে মাঝনদীতে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম। কারণ, রাজীব চাচার নৌকা বাওয়ার হাত ছিল একেবারে কাচা। আমারও একই অবস্থা। যদিও আমরা পানির দেশের মানুষ। আমি নৌকা বাইতে জানতাম না।

নদী জিজ্ঞেস করল, তারপর?

: তারপর আর কী, পরে মাঝিরা নৌকা নিয়ে এসে উদ্ধার করে।

: আর কোনো স্মৃতি?

: রাজীব চাচার কাছে আসা প্রেমের চিঠিগুলোর গল্প তো তোমাকে আগেই বলেছি। হা হা হা।

নদীও হাসল। বলল, মা তো বলেছেন, বাবা নাকি শ্যামলা ছিলেন। আমি বাবার মতো হয়েছি।

নাবিদ বলল, পুরুষ মানুষের এত ফরসা হওয়া মানায় না। শ্যামলা হলেই ম্যানলি মনে হয়। রাজীব চাচা শ্যামলার মধ্যে সুন্দর তো ছিলেনই। বরং বলা যায়, তিনি ম্যানলি বেশি ছিলেন। আর তুমি শ্যামলা হলেও বেসিকেলি তুমি অনেক সুন্দর। তোমার এই ভাবি, জুঁইও তো শ্যামলা। কিন্তু আমি মনে করি সে পৃথিবীর সেরা সুন্দরী। কী ঠিক বলিনি জুঁই?

জুঁই একটু নাক ফুলিয়ে বলল, হয়েছে। তোমার বোন সামনে বলে কিছু বলছি না। নদী আরেকটু পুরোনো হোক। তারপরে তার সামনে-পেছনে সব জায়গায়ই বলব।

নদী শব্দ করে হেসে উঠল।

নাবিদ ও জুঁই দুজনই হাসল।

নদী হঠাৎ তার দাদার প্রসঙ্গে আবার ফিরে এল। জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা ভাইয়া, দাদা আমার বাবা-মাকে কেন বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন?

নাবিদ বলল, তোমার দাদা তো তোমার বাবা-মাকে বাড়ি থেকে ঠিক বের করে দেননি। বরং তোমার বাবা কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে তোমার মাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। আসলে ওখানে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। তোমার দাদা যেমন মেজাজি ছিলেন, তোমার বাবাও একই রক্তের ছিলেন। তোমার বাবা তোমার মাকে হুট করে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে ওঠেন। তিনি এভাবে না উঠে একটু আলোচনা করে উঠলেই পারতেন। আর সেদিন তিনি একটু চুপ থেকে ধৈর্য ধরলেও পরিস্থিতি এমন হতো না।

: আচ্ছা মানলাম আমার বাবা একটু ধৈর্য ধরলে পরিস্থিতি একটু অন্য হতো। কিন্তু আমার বাবা মারা যাওয়ার পর দাদা বা দাদার বাড়ির কেউ তো একটা খবরও নেয়নি?

: তোমার মাকে নিয়ে তোমার বাবা বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর তোমার দাদা কিন্তু তাকে খুঁজে বের করতে অনেক চেষ্টা করেছেন। তোমার মাকে বাড়িতে ফিরিয়ে সম্মান দিয়ে ফিরিয়ে আনবেন বলে এমন একটা পরিকল্পনাও করেছিলেন। তোমার বাবা-মা তখন খুব সম্ভব ঢাকার ডেমরার কোথাও থাকতেন। কিন্তু পরে তোমার দাদা যখন খবর পান যে, তোমার বাবা মানে রাজীব চাচা মারা গেছেন, তখন তিনি খুবই ভেঙে পড়েন। রাজীব চাচার সেই মৃত্যুর সম্পূর্ণ দায়ভার ও দোষটা তোমার মার ওপরে গিয়ে পড়ে।

: কিন্তু মা তো বলেছেন, বাবার মৃত্যুটাও একটা রহস্য।

: তুমি রহস্য বলতে কী বোঝাতে চাচ্ছ?

: এত অল্প বয়সে হঠাৎ করে কেউ ঘুমের মধ্যে মারা যায়?

: এসব ব্যাপারে আমি জানি নদী। তোমার বাবা মারা যাওয়ার খবর শোনার পর ওই ব্যাপারগুলোতে আমি কৌতূহল হারিয়ে ফেলি। পরে আমিও চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়ে ওই ব্যাপারগুলো থেকে আরও দূরে সরে যাই।

: বাবা মারা যাওয়ার পর দাদা বা দাদার বাড়ির কেউ আমাদের একটা খবর নেয়নি কেন?

: তা জানি না। হয়তো এই ভেবে যে, ছেলে নেই, ছেলের বউয়ের খবর নিয়ে আর কী লাভ?

: স্ট্রেঞ্জ, ভেরি স্ট্রেঞ্জ। আচ্ছা, দাদা কি এখনো বেঁচে আছেন?

: নাহ, সেই কবে মারা গেছেন। সতেরো-আঠারো বছর তো হয়ে গেছে।

নদী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চুপ হয়ে গেল। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন