রাকিব ও নদী ডাউন টাউন প্লাজাতে মৌনতার জন্য ড্যান্সিং অ্যান্ড সিংগিং ডল খুঁজে পায়নি। এমনকি টয় ওয়ার্ল্ডেও না। কিন্তু হ্যামিল্টন সেন্ট্রালের কে-মার্টে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে পুতুলটা খুঁজে পেয়েছে। পুতুলটা খুঁজে পাওয়ার পর মৌনতার সে কী খুশির চেহারা! মৌনতা রাকিবের ঘাড় ধরে ঝুলে পড়ে।
পুতুলটা টয়ওয়ার্ল্ডে পেলে বা কিনতে গেলে বেশ দাম পড়ত। কমপক্ষে এক শ ডলার হতো। কিন্তু কে-মার্টে বেশ সস্তায় পেয়ে গেছে। মাত্র চল্লিশ ডলার। পুতুলের দামটা নদীই দিতে চেয়েছিল। রাকিব খানিকটা মিনতি করে নিজেই পতুলটার দাম দেয়।
ওরা কে-মার্ট থেকে আর কিছু কেনেনি। পুতুলটা কিনে সরাসরি বের হয়ে আসে। হ্যামিল্টন সেন্ট্রাল শপিং মলের দিঘল করিডর ধরে ওরা এখন পাশাপাশি হাঁটছে। মৌনতার এক হাত নদীর হাতে। রাকিবেরও ইচ্ছে হলো মৌনতার অন্য হাতটা ধরতে। কিন্তু মৌনতা তার অন্য হাতে পুতুলটা ঝুলিয়ে হাঁটছে। ওরা এখন হ্যামিল্টন সেন্ট্রাল শপিংমলের একেবারে লাগোয়া বার্গার কিং ফার্স্টফুড রেস্টুরেন্টে ঢুকবে।
করিডর ধরে হাঁটতে হাঁটতে রাকিব ঘড়িতে সময় দেখল। প্রায় একটা বাজে। তার বেশ ক্ষুধা পেয়েছে। বার্গার কিংয়ের গ্রিল-চিকেন বার্গার তার খুব পছন্দ। রাকিব নদীর পছন্দটা জানে না। নদীকে নিয়ে সে বার্গার কিংয়ে কখনো খায়নি। মৌনতার পছন্দও সে জানে না। হয়তো মৌনতা কোনো একটা কিডস মিল পছন্দ করবে। ওদের দৃষ্টি সব সময় বার্গার কিং বা ম্যাকডোনাল্ডসের খেলনার দিকে থাকে। খাওয়াটা ওদের কাছে মূলত গৌণ। খেলনাটাই মুখ্য।
রাকিব এ সব ভাবতে ভাবতে বের হচ্ছে, ঠিক তখনই খানিকটা দূরে দেখল, এক জোড়া দম্পতি গায়ে-গায়ে আঁটসাঁট বেঁধে এমনভাবে এগিয়ে আসছে, মনে হচ্ছে ওরা একে অপরের কাছ থেকে একটুর জন্য বিচ্ছিন্ন হলে পৃথিবীতে ধ্বংস নেমে আসবে। ওরা যেন চার পায়ে হাঁটছে না, দুজন তিন পায়ে হাঁটছে। বাকি একটা পা উধাও!
রাকিব একটু ভালো করে তাকাতেই দেখল, এ তো আতিক! বউটা ছোটখাটো বলে যেন আতিকের গায়ে একেবারে লেপটে রয়েছে। শপিংমল, ফুটপাত বা পার্কে এমনভাবে জড়িয়ে ধরে হাঁটার অভ্যাস শুধু এ দেশি সাদা চামড়ার পাকিহাদেরই। ভারত উপমহাদেশের, এমনকি মাউরি আদিবাসীদেরও এমনটা দেখা যায় না।
কাছাকাছি হতেই আতিক নিজ থেকে গলা বাড়িয়ে বলল, আরে রাকিব যে, কী খবর দোস্ত?
রাকিব বলল, খবর ভালোই। তোমাদের খবর কী?
: ওই তো, চলছে ভালোই। খাই-দাই আর ঘুরছি।
: হুম, তাই তো দেখছি।
আতিকের বউ পাশ থেকে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন ভাইয়া?
রাকিব বলল, জি, ভালো। আপনি?
: জি, আমিও ভালো। আপনি তো আর বাসায় এলেন না?
: আসলে সময় পাই না।
আতিক হেসে বলল, সময় আর পাবে কোথায়? পাঁচ দিন অফিস নিয়ে ব্যস্ত। শনিবারে...!
রাকিব থামিয়ে দিয়ে বলল, হয়েছে। তুমি এখানেই থাম। আর বেশি বলতে হবে না।
আতিক শব্দ করে হেসে উঠল, হা হা, হা হা।
নদী মাঝখান থেকে বলে উঠল, উনিই ভাবি, তাই না?
আতিক বলল, হ্যাঁ।
আতিকের বউ নদীকে জিজ্ঞেস করল, আপনি?
নদী কিছু বলার আগে আতিক বলল, উনি রাকিবের বন্ধু। আমি তোমাকে তার কথা বলেছি।
আতিকের বউ মুখ টিপে হাসল। কিছু বলল না।
মৌনতা মাঝখান থেকে বলে উঠল, সবাই নিজেদের ইন্ট্রুডিউজ করাচ্ছ। আমাকে ইন্ট্রুডিউজ করাচ্ছ না কেন?
আতিক একটু জিজ্ঞেস করল, তুমি কে গো?
রাকিব বলল, নদীর ভাগনি। গ্লেন ভিউতে নাবিদ ভাই থাকেন না? তার মেয়ে।
আতিক বলল, ও, আচ্ছা। তুমি নাবিদ সাহেবের কথা বলছিলে। যার টিরাপাতে একটা ডেইরি শপ বা মিনি মার্ট আছে।
রাকিব বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, তারই মেয়ে। তা তুমি এ সময় হ্যামিল্টন সেন্ট্রালে?
: কে-মার্টে যাচ্ছি। কিছু কেনাকাটা করব।
: আজ ট্যাক্সি চালাচ্ছ না?
: রাতে চালাব।
: তোমার না নিজের ট্যাক্সি? তুমি এখনো রাতে চালাও?
: অন্যদিন চালাই না। শুধু শনিবার রাতে চালাই। বোঝো না, শনিবারে এক রাতেই পাঁচ শ ডলার আসে।
: বলো কী, একরাতে পাঁচ শ ডলার!
: কখনো শনিবার রাত ভালো হলে, কোনো রাগবি বা ইভেন্ট থাকলে ছয় শ ডলারও হয়ে যায়।
: ট্যাক্সিতে এত টাকা?
: তোমাকে আর কী বলব, হ্যামিল্টনে একেকজন ট্যাক্সি চালিয়ে তিনটা-চারটা বাড়িও করছে।
: তা বুঝতে পারছি।
মৌনতা রাকিবের কাছে এসে হাত টেনে বলল, আংকেল, তুমি না একটু বেশি কথা বলছ। আমরা বার্গার কিংয়ে যাব না? আই অ্যাম রিয়েলি হাংরি।
রাকিব একটা লজ্জার হাসি দিয়ে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, এখনই যাচ্ছি। সরি আতিক, পরে কথা হবে।
আতিক মৃদু হেসে বলল, ওকে। এনজয়...!
বার্গার কিং ফার্স্টফুড রেস্টুরেন্টে ঢুকে রাকিব গ্রিল-চিকেন বার্গারের অর্ডার দিল। নদীও তার দেখাদেখি গ্রিল-চিকেন বার্গারের কথা বলল। মৌনতা যথারীতি কিডস মিলের চিকেন রয়্যাল অর্ডার দিল।
ওরা কোণার একটা চার চেয়ারের টেবিল নিয়ে বসল। শনিবার বলে কিনা, আজ বার্গার কিং প্রায় ফাঁকা। সেন্ট্রাল সাউন্ড সিস্টেমে লো-ভলিউমে এলভিস প্রিসলির গান বাজছে—আই উইল লেট ইউ গো লিটল ডার্লিং, আই উইল নেভার স্ট্যান্ড ইন ইউর ওয়ে...!
নদী জিজ্ঞেস করল, গানটা সুন্দর না?
রাকিব অন্যমনস্কের গলায় বলল, হু!
নদী আবার জিজ্ঞেস করল, কী ভাবছেন?
রাকিব হেসে তাড়াতাড়ি করে বলল, না না, কিছু না।
রাকিব কিছু ভাবছে না বললেও আসলে সে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আতিকের কথাই ভাবছে। কী আমূল পরিবর্তন এই আতিকের মধ্যে...! মাত্র আট-নয় মাস বা এক বছর আগেও কেউ কী বিশ্বাস করত, সেই আতিক আর এই আতিক এক? একটা জীবনে আতিক জীবনটাকে উড়নচণ্ডীর মতো আনন্দ করেছে। এখন সে কী সুন্দরভাবেই না গুছিয়ে নিয়েছে। এখন ওই সবের সবকিছুই অতীত। বছর ঘুরতেই ছেলেমেয়ে হলে সে এসব কথা মনেই রাখবে না। পেছনের উড়নচণ্ডী অতীতটা মনে রেখে লাভ কী?
নদী একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল, মাথায় কি কোনো কবিতার লাইন ভিড় করেছে?
রাকিব বলল, আরে না!
: আজ তো নতুন কোনো কবিতার কথা বললেন না?
: বিকেলে নদীর পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে বলব।
: হুম। আচ্ছা, একটা কথা বলি।
: কী কথা?
: আতিক ভাইয়ের বউটা কিউট না?
রাকিব বলল, হ্যাঁ।
নদী বলল, কী সুন্দর করে শাড়ি পরেছেন?
রাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ। তুমিও তো সেদিন খুব সুন্দর করে শাড়ি পরেছিলে।
: কোনদিন, মৌনতার জন্মদিনে?
: হ্যাঁ, শাড়ি পরারও একটা আর্ট আছে।
: আপনি এত কিছু জানলেন কীভাবে?
রাকিব হেসে বলল, এসব জানতে হয় না। কমনসেন্স।
নদী বলল, আমি বাংলাদেশ থেকে আসার সময় মা ছয়-সাতটা শাড়ি ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তবে আমি তিনটা নিয়ে আসি। সেদিন যে শাড়িটা পরেছি, ওটা মার কিনে দেওয়া শাড়ির মধ্যে একটা।
: তোমার টিয়ে রঙের শাড়ি নেই?
: না। একটা লাল। একটা বাসন্তী রঙের। এর অন্যটা সাদা রঙের। তবে সাদা রঙের শাড়িটা লাল পাড়ের। পয়লা বৈশাখে পরব বলে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু এখানে বাঙালি কমিউনিটির মধ্যে পয়লা বৈশাখ কখন হয় তা দুই বছরে টেরই পাইনি। বাসন্তী রঙের শাড়িটা এনেছিলাম বসন্ত কালে পরতে। এখানে বাঙালিদের বসন্ত কাল উদ্যাপনটাও টের পাইনি।
: মনে হয় এখানে বাঙালি কমিউনিটি ছোট বলে টের পাওয়া যায় না। অকল্যান্ডে কিন্তু ব্যাপকভাবে হয়।
: এখানেও হয় বলে শুনেছি। তবে তারা নিজেদের মধ্যে আলাদা আলাদা গ্রুপ করে পালন করেন। হ্যামিল্টনে বাঙালিদের ছোট্ট কমিউনিটি, এদের আবার আলাদা আলাদা গ্রুপ!
: ছোটবড় বলে কথা নয়, বাঙালিদের এই গ্রুপিংটা সারা বিশ্বে। পৃথিবীর কোথাও দশজন বাঙালি একত্রে থাকতে পারে না। এটা আজকালকার কথা না। এটা শত শত বছর ধরেই হয়ে আসছে।
: হুম, ঠিকই বলেছেন। আচ্ছা, আপনি হঠাৎ টিয়ে রঙের শাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলেন যে?
: তুমি মৌনতার জন্মদিনে হ্যামিল্টন লেকের পাড়ে যে শাড়িটা পরে এসেছিলে, ওটা তুমি খুব সুন্দর করে পরেছিলে। কিন্তু ওই শাড়ির রংটা তোমাকে ঠিক মানায়নি।
: ওমা, সবাই তো বলেছে শাড়িটা নাকি আমাকে দারুণ মানিয়েছিল।
: আমি আমার ওপিনিয়ন দিচ্ছি, অন্যের না। অনেস্ট ওপিনিয়ন দিচ্ছি।
নদী এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেল। তারপর মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল, মনে হয় আপনার টিয়ে রংটার প্রতি দুর্বলতা আছে?
রাকিব বলল, ঠিক দুর্বলতা নয়। ভালো লাগা আছে। আমার মনে হয়েছিল, তুমি সেদিন টিয়ে রঙের শাড়ি পরলে খুব দারুণ মানাত। টিয়ে রংটা শ্যামলা মেয়েদের পরনে দারুণ মানায়।
নদী মাথা ঝাঁকাল। মৃদু হাসলও। বলল, তাই! ভালো ভালো। এ জন্যই আমি যখন টিয়ে রঙের সালোয়ার-কামিজটা পরে আসি, তখন আপনি আমার দিকে খুব মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন?
রাকিব হাসল। খানিকটা লজ্জার হাসি। সরল স্বীকারোক্তি করল, হ্যাঁ।
: টিয়ে রংটা আমার মারও খুব পছন্দ। সেই টিয়ে রঙের সালোয়ার কামিজটাও মা কনে দিয়েছিলেন। সব কবিদের পছন্দ একই।
: সব কবিদের পছন্দ এক না।
: আচ্ছা মানলাম, সব কবিদের পছন্দ এক না। কিন্তু আমি টিয়ে রঙের শাড়ি পাব কোথায়?
: আমি যদি কিনে দিই?
: আপনি কোথায় থেকে কিনে দেবেন?
: হ্যামিল্টনে দুটো ইন্ডিয়ান শাড়ির দোকান আছে। ওখানে যদি না পাই তাহলে অকল্যান্ড থেকে কিনে নিয়ে আসব।
: এমনই গাড়িটা দিয়ে আমাকে ঋণী করেছেন।
: গাড়ির সঙ্গে শাড়ির সম্পর্ক কী?
: গাড়ি, শাড়ি ও নারী, এই তিনটার মধ্যে গভীর সম্পর্ক আছে। হি হি, হি হি।
নদীর হাসিতে রাকিবও হাসল। তবে শব্দ করে নয়।
মৌনতা তাদের কথার মাঝখানে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কী আলাপ করছ?
মৌনতার কথায় নদী বা রাকিব গুরুত্ব দিল না। এরই মধ্যে বার্গার কিংয়ের একজন ক্রো তাদের খাবারের নম্বর বলতেই রাকিব উঠে গিয়ে ট্রে ভর্তি বার্গার চিপস ও ড্রিংকসগুলো নিয়ে এল।
মৌনতা তার খেলনাটার দিকে হামলে পড়ল।
নদী একটা চিপস নিয়ে মুখে দিল।
রাকিবও একটা চিপস মুখে দিয়ে খেয়ে বলল, নদী, তোমাকে একটা অনুরোধ করি।
নদী জিজ্ঞেস করল, কী অনুরোধ?
: তুমি কখনো গাড়ির প্রসঙ্গ টানবে না।
: কেন টানব না? আপনি গাড়িটা দেওয়ার সময় বলেছিলেন, আমি আস্তে আস্তে টাকা দিলেই হবে। গাড়ির মালিকানা চেঞ্জ করার পর সরাসরি বলে বসলেন, গাড়ির কোনো টাকা দেওয়া যাবে না।
রাকিব সামনে খানিকটা ঝুঁকে নদীর হাত মুঠো করে ধরে বলল, প্লিজ, এ নিয়ে আগেও বেশ কয়েকবার বলেছ। আর বলো না। গাড়ির প্রসঙ্গ আর কখনো না টানলে আমি খুশি হব। তোমাকে নতুন গাড়ি কিনে দিইনি। পুরোনো গাড়িটা দিয়েছি। ওটাকে নিয়ে এত বলার কিছু নেই।
নদী শব্দ করে না হেসে মৃদু হেসে বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে। তবে শাড়িটা আমি কিনব। আপনার জন্য। টিয়ে রঙের শাড়ি। মাকে বলব, বাংলাদেশ থেকে কিনে পার্সেল করে পাঠিয়ে দিতে। বাংলাদেশ থেকে পার্সেল আসতে তো বেশি দিন লাগে না।
রাকিব সায় দিয়ে হাসল।
মৌনতা আবার জিজ্ঞেস করল, তোমরা দুজন হাত ধরেছ কেন? তোমরা শাড়ির কী আলাপ করছ?
নদী জিজ্ঞেস করল, কেন মৌনতা?
মৌনতা বলল, মা আসার সময় বলে দিয়েছে, তোমরা দুজন কী কর, তা দেখতে। তোমরা কী আলাপ কর তা অ্যাটেনশান নিয়ে শুনতে।
নদী চোখ বড় বড় করে তাকাল। রাকিবও। (ক্রমশ)
মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>
ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: