জানালায় আসে না কেউ-পাঁচ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সন্ধ্যা হলে জসিম আসত। রৌশনবাণী সিনেমা হলের ইভিনিং শোতে নয়, ম্যাটিনিতেও নয়। কুংফু ক্যারাটে আর অ্যাকশন দেখাতে তো নয়ই। জসিম আসত পাটের দড়ি দিয়ে বাঁধা তিন বাটির অ্যালুমিনিয়ামের টিফিন ক্যারিয়ার হাতে।

এই জসিম কোনো দিন বাংলা সিনেমার ভিলেন জাম্বুর মাথায় বেল ভাঙেনি। ইলিয়াস কোবরার হাত উল্টো করে মোচড়ায়নি। ঘুষি মেরে ফাটায়নি রাজিবের নাক! এই জসিম কোনো দিন শাবানার জন্য কাঁদেনি। স্বামী কেন আসামি ছবিতে মদের বোতল হাতে গায়নি গান—এ জীবন কেন এত রং বদলায়/ কখনো কালোমেঘ,/ কখনো ঝোড়োবেগ/ কখনো প্রেমের আবেগ এসে,/ নিজেকে জড়ায়। এই জসিম রিকশা চালিয়ে, ইট ভেঙে, ঠেলাগাড়ি টেনে গার্মেন্টসের মালিক হয়নি।

জসিম শুধুই বয়। বক্সি মিজির পোলের পাশের মায়া হোটেলের বয়। তিন বাটির টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে রোজ সন্ধ্যায় আমার টিনের দরজায় কড়া নাড়ে। আমার ঘুম ভাঙায়। বেবি নাজনীনের মরার কোকিলের মতো!

ওপরের বাটিতে ভাত। তারপরের বাটিতে ডিম-আলুর ঝোল। শেষ বাটিতে ডাল অথবা লাউ তরকারি! এই হলো আমার প্রতিদিনের মেন্যু।

নশ্বর পৃথিবীতে রোজ কত কিছু ঘটে। চেয়ারম্যানের মেয়ে ভাগে রিকশাওয়ালার হাত ধরে। মঙ্গলগ্রহে বসতি গড়তে রকেট নিয়ে ছোটে আমেরিকান জ্যোতিষি। লেংটি পরা নাক চ্যাপ্টা সুমো কুস্তিগিরও প্রেম করে হলিউডের নায়িকার সঙ্গে। আমি শুধু একই থাকি। একই থাকে খাবারের মেনুটাও! কখনো নড়চড় হয় না।

পাহাড়ের গুহায় ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসীরা বছরের পর বছর একই খাবার খান। মায়া হোটেলের একই মেন্যু খেয়ে আমারও তাই গর্ব হয়। নিজেকে সন্ন্যাসী ভাবি মনে মনে। অজন্তা-ইলোরা গুহায় ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসীরা খাবারের আগে পুকুরে তিন ডুব দিয়ে আসতেন কিনা জানি না। কিন্তু আমি দিতাম। সাবু উকিলের পুকুরে গিয়ে ডুব দিয়ে আসতাম। লাইফবয় সাবান গায়ে মেখে!

পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে ছিল মোটা আমগাছ। বাঁকা ডাল ঝুলে থাকত জল ছুঁই ছুঁই। পশ্চিম পাড়ে বাতাবি লেবুর ঝোপ। তার পাশেই বুনো চালতা। চালতার ডালে লাল ঠোঁটের মাছরাঙা। আমি গেলে সেও বুঝি আসত। আর আসত উকিল সাহেবের মেয়ে জিনাত। মাঝে মাঝে জানালায়!

তাকে আমার প্রতিমার মতো মনে হতো। মনে হতো অনেক শীতে সাইবেরিয়া থেকে ছুটে আসা সাদা পাখি সে। যে পাখি সাত-সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে মায়া দিতে উড়ে আসে। যে পাখির পালকে মেঘ আর মায়া লেপ্টে আছে। সে কেবল আমার পাখি। সে আমার একলা পাখি!

আড়চোখে আমার গোসল করা দেখত জিনাত। চোখে চোখ পড়লে লজ্জায় পালাত। আমি অতটা লাজুক না। পৈতৃক সূত্রে অনেক কিছুই পেয়েছি। লজ্জা ছাড়া!

উকিল সাহেবের সুন্দরী মেয়েকে দেখার পর আমি তখন স্কটল্যান্ডের রাজা জ্যাকব। যুদ্ধের ঘোষণা না দিয়েই পুড়িয়ে চলি আইরিশ সাগর পাড়ের পুরোনো শহর, বাড়িঘর, সরাইখানা। ঘোড়ার গাড়িতে বন্দী করে নিয়ে আসি সোনালি চুলের সুন্দরী সব রমণীকে, আমারই হেরেমখানায়। মখমলের গালিচা বিছানো ঘরে তারা ঘাগড়া-জড়োয়ায় সাজে। নীল পাথরের ঝুমকা আর রুপার পায়েল পরে নাচে। শরাবের পেয়ালা হাতে পুকুরে ডুব দিয়ে আমি তাদের নাচ দেখি!

ভেসে ওঠার পর ঘোর কাটে না অনেকক্ষণ। চোখ খুললে আমি আর আমি থাকি না। স্কটিশ রাজা জ্যাকব থেকে ঝাঁকড়া চুলের কুদ্দুস বয়াতি হয়ে যাই। সাবু উকিলের কচুরিপানায় ভরা পুকুরটা হয় যমুনা।

আমি যমুনার পাড়ে কৃষ্ণ হয়ে রাধাকে খুঁজি না। বেণি করা চুল, কাজল কালো চোখের জিনাতকে খুঁজি। আর গান গাই-আমার যমুনার জল দেখতে কালো চান করিতে লাগে ভালো যৌবন মিশিয়া গেল জলে!

সেই যৌবন মেশা জলে শুকনো বাঁশপাতা ঘুরে ঘুরে পড়ে। মাইজদী স্টেশনে লোকাল ট্রেনের হুইসিল বাজে। বোর্ডিং রোডে বাবুল আইসক্রিমের গাড়িতে ঘণ্টি বাজায় দেলু চাচা। তখন মাছরাঙাটা টুপ করে ডুব দেয়। তার ঘোর কাটে। ঘোর কাটে আমারও। ডুব দিই আমিও। আমার যৌবন সাবু উকিলের পুকুরে মিশে থাকে, মিশেই থাকে! শুধু জিনাত আর আসে না জানালায়!

জিনাত না এলেও মাঝে মাঝে রতন ভাই আসে। আমার টিনের ঘরের কাঠের জানালায় গুনে গুনে তিন টোকা দেয়। নীল জিনস, ব্ল্যাক স্নিকার, আর সাদা টিশার্ট পরে আমি রতন ভাইয়ের রিকশায় উঠি। চলে যাই আপ-টু-নাইনটি নাইনে।

হাসান মাহমুদ রতন আপ-টু-নাইনটি নাইনের আবিষ্কারক। মাইজদী শহরের মানুষ প্রথম বুঝতে পারে ১ থেকে ৯৯ টাকা দিয়ে কত কিছু কেনা যায়! আমিও খুশি মনে কিনে ফেলি জিরো পাওয়ারের চশমা। মূল্য ৯৯ টাকা মাত্র!

রতন ভাই ১০০ টাকা বুঝে নিয়ে এক হাতে চশমা অন্য হাতে লজেন্স দেয়। বাকি ১ টাকার বদলে লজেন্স।

নাকের ওপর একটা চশমা থাকলে ইজ্জত সম্মান বাড়ে। ছোট ভাইয়েরা সালাম দেয়। রিকশাওয়ালারা স্যার ডাকে।

এটা ফরিদ ভাইয়ের কথা। লক্ষ্মীনারায়ণপুর থিয়েটারের নির্দেশক ফরিদ উদ্দিন আমার নাট্যগুরু। গুরুর মতো স্যার ডাক শোনার লোভে আমিও জিরো পাওয়ারের চশমা চোখে পরি। তারপর রতন ভাইয়ের দেওয়া চকলেট মুখে পুরে ঘুরে বেড়াই শহরের এদিক-ওদিক। টাউন হলের মোড় থেকে পুরান বাস স্ট্যান্ড, কচিকাঁচার মেলা থেকে সার্কিট হাউসের মোড়। সবখানে ঘুরি লাটিমের মতো। পরিচিত অনেক ছোট ভাইদের দেখা পাই। সিকি হাসি দিয়ে চলে যেতে চায় তারা।

আমি থামাই। নিজ থেকে কথা বলি, কেমন আছ? পড়াশোনা করছ ঠিকঠাক?

তারা হাসিমুখে মাথা নাড়ে।

আমি তখন জ্ঞান জাহির করি, স্বামী বিবেকানন্দ কি বলেছেন জানো? বলেছেন, শিক্ষা হচ্ছে মানুষের মধ্যে ইতিমধ্যে থাকা উৎকর্ষের প্রকাশ।

ছোট ভাইয়েরা জ্ঞানের কথা শুনে জি জি বলে। আমাকে জ্ঞানী ভাবে। কিন্তু সালাম না দিয়েই চলে যায়। দূরে গিয়ে হাসে! আমার তখন দুঃখ হয়। ৯৯ টাকা জলে গেল, কুমিরে খেল এই ভেবে!

জানি দুঃখের গল্প বলতে নেই। বললে ১৩ জন মানুষকে আছর করে। ১৩ জনই দুঃখ পায়। শুনেছি দুঃখরা ১৩ ভাই!

আমি আশপাশে সুখ খুঁজি। ইশারায় ডাকি। ন্যাড়া মাথার দাঁত ভাঙা রিকশাওয়ালা সামনে এসে দাঁড়ায়। সেই আমার সুখ!

আমি দুঃখ ভুলতে রিকশায় উঠি। পায়ের ওপর পা তুলি। নীল চেকের হাফ হাতা শার্টের বোতাম খুলে দিই। বুকের কাছাকাছি। রিকশায় ঘুরলে কিছু বাতাস বুকে লাগবে। কিছু গালে। সেই বাতাসে শিমুল তুলোর মতো উড়ে যাবে কিছু দুঃখও!

রিকশাওয়ালাকে বলি, জজকোর্টের দিঘির পাড়ে যাও।

সে শুধুই মাথা নাড়ে। জি স্যার কথাটা আর বলে না। উল্টো লুঙ্গির গিট থেকে আকিজ বিড়ির প্যাকেট বের করে ধরায়। লম্বা টান দেয়। পেছন ফিরে হাসে। আমি তার হলুদ রঙের দাঁত দেখি। চোখ ফেরাই। সে প্যাডেল চাপে। গার্লস স্কুল পেরিয়ে প্যারামেডিকেলের পেছনের রাস্তা ধরে। হুহু বাতাস আমার বুকে লাগে, গাল ছুঁয়ে চুল উড়ায়। তবুও দুঃখটা ঝুলে থাকে ভেতরে। মন খারাপ করা বিকেলের মতো। ধূসর শালিকের টলটলে চোখের মতো।

দিঘির পাড়ে নেমে ১০ টাকা দিই।

: কত দিলেন ভাই? ভাড়াতো ১৫ টাকা।

ন্যাড়া মাথার রিকশাওয়ালা উদাস হয়ে ধোঁয়া ছাড়ে। রিং বানায়। ধোঁয়ার রিং ঘুরে ঘুরে ওপরে ওঠে। আমার ওঠে রাগ।

: ভাই বলিস কাকে, আমি তোর কোন কালের ভাই। স্যার বল বেয়াদব!

রিকশাওয়ালা খিক খিক করে হাসে। তারপর বলে, মাল মনে হয় বেশি খাইছেন ভাই। কুনো অসুবিধা নাই। বাড়িত যাইয়া দুই বালতি পানি ঢালেন মাথায়। লেংটা হইয়া সারা গায়ে পানি ঢাললে অ্যাকশন তাড়াতাড়ি হইব!

রিকশাওয়ালা হলুদ দাঁত দেখিয়ে দ্রুত চলে যায়।

আমি ৯৯ টাকায় কেনা জিরো পাওয়ারের চশমা পরে জজকোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। অ্যাডভোকেট শাহজাহান শাহিনকে খুঁজি। তিনি আমার মামা। কালো বোরকা পরে কোর্টে আসেন। দেখা হলে গরুর কালা ভুনা দিয়ে ভাত খাওয়ান। মোহাম্মদিয়া হোটেলে নিয়ে। আমার পেটের ক্ষুধা আর পকেটের ক্ষুধা বোঝার চোখ শুধু তারই ছিল। আমার গভীর মমতাটুকুও তাই তার জন্য!

মামাকে পেলে রিকশাওয়ালার নামে মামলা দেওয়া যেত। আমাকে মাতাল বলায় মানহানির মামলা! শুনেছি তিনি মামলা দেওয়ায় ওস্তাদ। কিন্তু পাই না। মনের ভেতর তখনো ঘুরপাক খায় দুঃখ, মাথায় কবিতা—বাড়ি যাও মাতাল/ খাঁচা থেকে মুক্ত হয়ে/ যেখানে তুমি যাও/ সেও এক মস্ত খাঁচা/ আকাশ কিংবা পাতাল/ বাড়ি যাও মাতাল।

আমি মাতাল নই, তাই বাড়ি যাই না। যাই হকার্স মার্কেটের কোণায়। সেখানে শহরের জ্ঞানী মানুষের দল আড্ডা মারে। বাকি অথবা ফ্রিতে চা সিগারেট টানে। ফকিরের দল পয়সা খোঁজে। স্টিলের মগে বেলা বিস্কুট ভিজিয়ে খায়।

আমি খুঁজি ফরিদ ভাইকে। ৯৯ টাকা লস করানোর কারণ জানতে! আজ ফরিদ ভাইয়ের একদিন কী আমার যত দিন লাগে! খুঁজে পাই পানওয়ালার দোকানের সামনে গেলে। তিনি চায়ের কাপ হাতে আমার দিকে তাকান। বিরক্ত হন।

: কি চাস?

: কিছু না ভাই! দূর থেকে দেখে সালাম দিতে আসলাম।

ফরিদ ভাই নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়েন। গম্ভীর হন। তারপর বলেন, ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমার দুই কাপ চা, তিনটা সিগারেটের দাম দিয়ে চলে যা।

: জি, আচ্ছা।

আমি চা সিগারেটের বিল দিই। তারপর উল্টো পথে পা বাড়াই। ফরিদ ভাই পেছন থেকে ডাকেন। আমি ভয় পাই। এবার না পুরো এক প্যাকেট সিগারেট চেয়ে বসেন। এমনিতেই লসের মধ্যে আছি।

: কাচ ছাড়া চশমা পরে ঘুরছিস ক্যান?

: জি ভাই!

তিনি আমার চশমা খুলে হাতে নেন। এক পাশে খালি ফ্রেম। অন্যপাশে কাচ।

: এটার কথা বলছি।

আমি ভাঙা চশমা দেখে চমকাই। মনে মনে মন্ত্র জপি, রাম রাম রাম/ কেমনে হইল এই কাম! তারপর লজ্জা আড়াল করার মন্ত্র খুঁজি। জ্ঞানীরা নিজেদের লজ্জায় ফেলেন না। আমিও অজ্ঞানী নই।

ফরিদ ভাইকে বলি, একটা কাচ খুলে রেখেছি। দেখার সঙ্গে মনের যোগাযোগ ঠিক রাখতে। যাযাবর বলেছেন, যে দৃষ্টির সঙ্গে মনের যোগাযোগ নেই সেতো দেখা নয়, তাকানো।

ফরিদ ভাই উদাস হন। নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়েন। নিজের চশমার কাচ মোছেন গলায় ঝোলানো লাল মাফলারে! আমি মুছি কপালের ঘাম। ৯৯ টাকা লসের দুঃখ আর অপমানের দুঃখ মিলেমিশে জ্বলন্ত কয়লা তখন। কেউ একটু ফুঁ দিলেই বুঝি জলে উঠি।

পুরান বাস স্ট্যান্ডের পেট মোটা ট্রাফিক পুলিশটা ফুঁ দেয় পিতলের বাঁশি। কোর্ট বিল্ডিংয়ের কড়ই তলায় বসে নান্টু কবিরাজ ফুঁ দেয় শান্ডার তেলে। শুধু আমাকে ফুঁ দেওয়ার মানুষ পাই না। আহা, যদি বাঁশি হতাম! যদি শান্ডার...! তবে আগুন ঠিকই জলত। প্রতিশোধ নিতাম নায়ক রুবেলের মতো!

রুবেলের কথা মনে হতেই আনোয়ারার ছবি চোখে ভাসে। বাংলা ছবির বিখ্যাত মা আনোয়ারা নাকের পানি চোখের পানি এক করে রুবেলকে নয়, যেন আমাকেই বলে, প্রতিশোধ নে হিমু। প্রতিশোধ নে। এই অপমানের প্রতিশোধ না নিয়ে ঘরে ফিরলে তুই আমার মরা মুখ দেখবি!

আমি প্রতিশোধ নিতে আপ-টু-নাইনটি নাইনের দিকে দৌড়াই। আনোয়ারা মায়ের মরা মুখ দেখতে চাই না বলে। তিনি বেঁচে থাকুন। একই ডায়ালগ দিক অন্তত আরও ৯৯টা ছবিতে!

আপ-টু-নাইনটি-নাইনে ঢুকেই শ্যামলা রঙের মেয়েটাকে দেখি। ফ্লোরে দেখি জামা, জুতা, ব্যাগ, মাটির ব্যাংক, চশমা আর প্লাস্টিকের বদনার গড়াগড়ি। আর দেখি রতন ভাইয়ের বেজার মুখ। শ্যামলা মেয়ে নীল রঙের বদনা ছুড়ে মারে সে মুখে। আমি ক্যাচ ধরি! বদনার আঘাতে নাক ফাটা বড় লজ্জার ব্যাপার। ফাটাবি তো ঘুষি মেরে ফাটা!

রতন ভাই আমার পেছনে লুকান।

মেয়ে চিৎকার করে, ভালো না বাসলে চিঠি দিছিলি ক্যান? রাতে ছাদে নিয়ে যাইতি ক্যান? আম্মু না থাকলে বাসায় আসতি ক্যান?

আমি না বুঝেই বলি, ক্যান, ক্যান, ক্যান?

রতন ভাই শুধু কিছুই বলেন না। আমার দিকে তাকিয়ে মুখ কাঁচুমাচু করেন। যার অর্থ, বাঁচান ভাই! মেয়েটাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে দোকান থেকে নিয়ে যান। আমাকে বাঁচান।

কিন্তু আমি বাঁচাই না। যুদ্ধটা ভাঙা চশমা, ছেঁড়া স্যান্ডেল অথবা ফিতা ছাড়া ট্রাউজারস বিক্রির জন্য হলে বাঁচাতাম। নিজের প্রতিশোধের কথা ভুলে। এটা প্রেম যুদ্ধ। যে যুদ্ধের ফলাফল শূন্য!

আমি ক্যাশবাক্সের ওপর পড়ে থাকা রতনের ওয়াকম্যানটা হাতে নেই। হেডফোন কানে লাগাই। অ্যাডলফ হিটলারের বাণী শোনাই শ্যামলা মেয়েটাকে, তোমাদের কখনো ভালোবাসতে না বলে যুদ্ধ করতে বলব। কারণ যুদ্ধে হয় তুমি বাঁচবে না হয় মরবে। কিন্তু ভালোবাসাতে না পারবে বাঁচতে, না মরতে!

শ্যামলা মেয়ে আবার ভাঙচুর শুরু করে। রতন ভাই করেন হা-হুতাশ।

যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে সে রাতে আমি সাবু উকিলের পুকুর পাড়ে। পকেটে ওয়াকম্যান আর কানে হেডফোন নিয়ে। চাদের আলোয় ভেসে যায় বুনো চালতা, বাতাবি লেবুর ঝোপ। ভেসে যায় জিনাতের জানালা। সবুজ মখমলের চাদর। পলাতক মাছরাঙার ঠোঁটের মতো জীবন নিয়ে আমি সেই চাদরের নিচে লুকিয়ে থাকি। জিনাতের হাত ছুঁয়ে বলি, জলে কিছু ছায়া পড়ুক। মেঘগুলো মায়া হোক। পাখিগুলো ভাসুক ধূসর ডানায়। তুমি শুধু আমার হও, লেপ্টে থাকো বুকের বা পাশে...!

আহা! জিনাত শোনে না কিছুই। লেপ্টে থাকে না বুকের পাশে। শুনি শুধু আমি। রবীন্দ্রনাথ বলে যান কেবল আমারই কথা, শেওলা রঙের ফিতার টানে!

মায়বন বিহারিনী হরিণী
গহন স্বপন সঞ্চারিণী
কেন তারে ধরিবারে করি পণ
অকারণ
মায়াবন বিহারিণী!

(চলবে)

হিমু আকরাম: নাট্যকার ও পরিচালক। হাইপয়েন্ট স্ট্রিট, নর্থ ক্যারোলাইনা, যুক্তরাষ্ট্র।
ইমেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: <Himu Akram>