একটি সরল নদীর গল্প-দশ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রাকিবের অফিসে আজ অলিভার এসেছিল। বেশ কয়েক মাস পরে ওদের মধ্যে দেখা। অলিভার শেষবার এসেছিল তার কনস্ট্রাকশনের সাপ্লাই নিতে। আজ অবশ্য সে অন্য একটা কাজে এসেছে। তার ব্যক্তিগত ব্যাপারে। সে বিয়ে করতে যাচ্ছে।

অলিভার বিয়ে করতে যাচ্ছে বলে সে খুব খুশি। পাশাপাশি রাকিবও খুশি হয়েছে। অলিভার বিয়ের অনুষ্ঠানের নানা পরিকল্পনার কথা জানাল। তার অনেক আগে থেকেই ইচ্ছে ছিল, বিয়ের পর হানিমুন করলে ভারতের আগ্রা যাবে। জ্যোৎস্না রাতে স্ত্রীকে নিয়ে তাজমহলের সামনে বসে থাকবে। চাঁদের আলোতে তাজমহলের যে প্রতিবিম্ব, তা নাকি অকল্পনীয়!

রাকিব অবশ্য কখনো তাজমহল যায়নি। সে মূলত বাংলাদেশের বাইরে নিউজিল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া বাদে আর কোথাও যায়নি। প্রায় এগারো বছর আগে নিউজিল্যান্ড আসার সময় তার ট্রানজিট যখন মালয়েশিয়া পড়ে, তখন কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্ট ও আকাশ থেকে কুয়ালালামপুর শহরটা দেখেছিল।

তবে রাকিব একবার হলেও আগ্রা যাবে। নদীকে যদি কাছে পায়, তাকে নিয়ে তাজমহল দেখতে যাবে। তার আরেকটা স্থানেও যাওয়ার খুব ইচ্ছে। শান্তি নিকেতন। নদী নিশ্চয়ই তার সঙ্গে সেখানেও যেতে চাইবে? নদীর যা ঘোরাঘুরির ইচ্ছে!

অলিভারের সঙ্গে রাকিবের পরিচয় মাউন্ট মাঙ্গানুই বিচে। অলিভার যেচে এসেই তার সঙ্গে কথা বলেছিল। তখন রাকিব কিছুদিনের জন্য মাউন্ট মাঙ্গানুই শহরে বসবাস করেছিল।

অলিভারের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর রাকিবের একধরনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আস্তে আস্তে তার বাসায় আসা-যাওয়ার মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক আরও গভীর হয়। অলিভার ছিল গান পাগল। রাকিবও সংস্কৃতমনা বলে তাদের বন্ধুত্ব খুব তাড়াতাড়িই গভীর হয়ে ওঠে।

অলিভারের বাসাতেই এমির সঙ্গে রাকিবের পরিচয়। ওরা বেশ আগে থেকেই একত্রে বসবাস করত। তখনই দশ বছর হয়ে গিয়েছিল। অলিভার ও এমি দুজনের বোঝাপড়াটা বেশ ভালো ছিল। অলিভার একজন কন্সট্রাকশন বিল্ডার আর এমি একটা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। তাদের তখনই সাত বছরের একটা ছেলে ছিল। ছেলেটা অবশ্য তার নানার বাড়িতে থাকত। পরে তাদের আরেকটা ছেলে হয়। তাদের দ্বিতীয় ছেলের বয়স এখন চার বছর।

অলিভার আর এমির বিয়ের কথা শুনে রাকিব খুশি হওয়ার পাশাপাশি বেশ অবাকও হয়েছে। রাকিব ভাবল, ষোলো বছর সংসার করে, দুটো ছেলের জন্ম দিয়ে ওরা এত দিনে একজন অন্যজনের বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছে। বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে। ব্যাপারটা কী সত্যি অবাক হওয়ার মতো নয়? রাকিব জানে, বিয়েটা একটা বিশ্বাসের। বন্ধনটা ভালোবাসার। কিন্তু ওদের ষোলো বছর লাগল? আর ষোলো বছর একত্রে বসবাসের পর আজ অলিভার বিয়ে করতে যাচ্ছে বলে, তার এত খুশি হওয়ার কী আছে?

অলিভার ও এমির বিয়ে তাওরাঙ্গা শহরে হবে। তবে এখনো বেশ সময় বাকি আছে। আরও দুই মাস বাকি। ওরা বসন্তের বিকেলে সাদা বিছিয়ে থাকা চেরি ফুলের গাছের নিচে ধর্মযাজক ঢেকে বিয়ে করতে চায়। বিয়ের পর বেশ বড় করে অনুষ্ঠান করবে। তারপর হানিমুনের জন্য ভারতের আগ্রায় উড়ে যাবে।

রাকিবের অফিসে দুপুরের পর আজ তেমন কাজ ছিল না। অলিভার এসেছিল সাড়ে তিনটার দিকে। আধা ঘণ্টা বসে থেকে বিয়ের গল্প করে চলে গেছে।

অলিভার চলে যাওয়ার পর রাকিব অফিসে বেশিক্ষণ কাটাল না। পৌনে পাঁচটার সময়ই সে অফিস থেকে বের হয়ে গেল। বাইরে তখন বিকেলের স্পষ্ট রোদ। শীতের প্রায় শেষ। বসন্ত আসছে বলে দিনটা একটু একটু বড় হচ্ছে। রাস্তার পাশের দু-একটা গাছে পাতা আসার আগেই ফুল ফুটতে শুরু করেছে। ম্যাপল ও ওক গাছে ছোট ছোট পাতার সবুজ কুঁড়ি মেলছে। কোনো কোনো কুঁড়ি আবার টকটকে লাল রঙের।

রাকিব আজ বাসায় পনেরো মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেল। সাধারণত তার অফিস থেকে বাসায় ফিরতে বিশ মিনিট, কখনো পঁচিশ মিনিটও লেগে যায়। আজ খুব তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এল। বাসায় ঢুকে সে কাপড়চোপড়ও ছাড়েনি। বাসার টেলিফোনটা বেজে উঠল।

রাকিব কর্ডলেসটা খুঁজতে গিয়ে সোফার একপাশে পেল। টেলিফোন সেটটার পাশাপাশি কর্ডলেস সেটটাও বাজছে কিরিরিৎ কিরিরিৎ, কিরিরিৎ কিরিরিৎ।

রাকিব কর্ডলেস সেটটা হাতে নিয়ে টক বাটন চাপতেই ওপাশ থেকে মার গলা ভেসে এল। মা এবার প্রায় তিন সপ্তাহ পর ফোন দিয়েছেন। মাঝখানে তিনি বেশ অসুস্থ ছিলেন। দুবাইয়ের একটা হাসপাতালে পর্যন্ত গিয়েছিলেন। হাসপাতালে যাওয়ার আগে মা একবার ফোনে কথা বলে গেছেন। হাসপাতালে গিয়েও একবার কথা বলেছেন। কিন্তু রাকিব পরে একবারও মাকে ফোন দেয়নি। তার যে মাকে ফোন দিতে জড়তা পেয়ে বসে, তা নয়। কিন্তু সে ফোন দিতে ভুলেই গিয়েছিল।

মা জিজ্ঞেস করলেন, বাবা, তুমি ভালো আছ তো?

: জি ভালো। আপনি কেমন আছেন?

: আমি এখন একটু ভালো। বাসায় ফিরেছি। আজ সকালেই ফিরলাম।

: আমি খুব দুঃখিত, আমি আপনাকে ফোন দিতে ভুলে গিয়েছিলাম।

: না না, অসুবিধা নেই। তুমি কত ব্যস্ত থাক!

: আমি খুব একটা ব্যস্ত ছিলাম না। নিজ থেকে সহজে কাউকে ফোন দেওয়ার অভ্যাস নেই তো। তাই ভুলে গিয়েছিলাম।

: অসুবিধা নেই বাবা। তুমি বলেছ, এতেই আমি অনেক খুশি হয়েছি। তুমি কী এখন বাসায় না অফিসে?

রাকিব একটু চুপ থেকে নিজে নিজে মৃদু হাসল। আস্তে করে বলল, আপনি কিন্তু আমার বাসার ল্যান্ড নম্বরে ফোন দিয়েছেন।

ওপাশ থেকে মা হেসে ব্যস্ত গলায় বললেন, ও, তাই তো! আসলে তোমাকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলে চেষ্টা করেছিলাম তো। তাই এখন মনে হয়েছিল, মোবাইলেই ফোন দিয়েছি।

রাকিব বলল, সরি, অফিসে মাঝেমধ্যে মোবাইল সাইলেন্ট করে রাখি। আজ অফিসে সার্ভিস ম্যানেজারের সঙ্গে একটা মিটিং ছিল। তখন মোবাইল যে সাইলেন্ট করেছিলাম, তারপর রিং টোন অন করতে ভুলে গেছি।

: আমি বুঝতে পেরেছি। তুমি কখন অফিস থেকে ফিরেছ?

: এই তো, কিছুক্ষণ আগে। বাসায় ঢুকতেই ফোন বাজছে দেখে ধরলাম।

: তুমি অফিস থেকে ফিরে কিছু তো খাওনি। আমি এখন তাহলে ফোন রাখি। এক ঘণ্টা পরে আবার ফোন দেব, কী বলো?

: না না, অসুবিধা নেই। আমি অফিস থেকে ফিরে কখনো কিছু খাই না। বড়জোর কফি খাই। এখন একটু পরে কফি খেলেও হবে।

মা টেলিফোনের ওপাশে এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেলেন। তারপর আস্তে করে বললেন, বাবা, তোমাকে একটা কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছি।

রাকিব জিজ্ঞেস করল, কী কথা?

মা আবারও একটু সময় নিয়ে বললেন, আমার দুই ছেলে দুই দেশে থাকে। মনটা খুব অস্থির থাকে। কবে মারা যাই, ঠিক নেই। শরীরটা এমনিতেই ভালো যাচ্ছে না। কয়েক দিন পরপরই হাসপাতালে যাচ্ছি। তোমাদের কাছ থেকে একবার ঘুরে আসতে চাই।

রাকিবও এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কবে আসতে চান?

: খুব সম্ভব আগামী দু-এক মাসের মধ্যে আসব। অস্ট্রেলিয়ার মাল্টিপল ভিসা তো আমার আছেই। এবার নিউজিল্যান্ডের ভিসা নেব। নিউজিল্যান্ডের ভিসা নিতে তোমার ঠিকানাটা আমার দরকার।

: আমি এখনই আপনার মোবাইলে আমার ঠিকানাটা এসএমএস করে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এ ছাড়া আর যদি কোনো কাগজপত্র লাগে আপনি বলবেন। স্পনসরের প্রয়োজন পড়লেও আমি পাঠাব।

মা আবেগের গলায় বললেন, আমি খুশি হলাম, বাবা। খুবই খুশি হলাম। তবে স্পনসর বা কাগজপত্র লাগবে কিনা আমি তো জানি না। এটা নয়ন ভালো বুঝবে।

রাকিব বলল, আচ্ছা, আমি নয়নের সঙ্গে কথা বলব।

টেলিফোন রাখার পর রাকিব লাউঞ্জে একটা সিঙ্গেল সোফায় ঝিম মেরে বসে রইল। বেশ কিছুক্ষণ বসে থেকে সে প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করল। আজ সকাল এগারোটার সময় সে সার্ভিস ম্যানেজার ম্যালকম ফক্সের সঙ্গে মিটিংয়ের আগে সেই যে মোবাইলটা হাতে নিয়ে সাইলেন্ট করে রেখেছিল, তারপর আর মোবাইলটা হাতে নেয়নি। দুপুরের সময়টা কাটিয়েছে ডেভিড ইটনের সঙ্গে একটা প্রোজেক্ট নিয়ে আলাপ করে। বিকেলের দিকে অলিভার এসেছিল। তাই আজ মোবাইল দেখার সময়ই পায়নি।

রাকিব মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল, মোবাইলে আটটা মিস কল। এরই মধ্যে পাঁচটা মার মিস কল, তিনটা ছোট ফুফুর। নদী সাধারণত উইক ডেতে অফিসের সময় তাকে ফোন দেয় না। অফিস ছুটি হওয়ার পরই ফোন দেয়।

রাকিব তার বাসার ঠিকানাটা মাকে এসএমএস করে দিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সে আপাতত অফিসের কাপড়চোপড় ছেড়ে গরম কাপড় ও গাউন পরে কফি হাতে ব্যালকনিতে দাঁড়াতে চায়। সন্ধ্যার পূর্বক্ষণে হিমেল হাওয়ায় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে গরম ব্ল্যাক কফি, আহা!

রাকিব বেডরুমে ঢুকে অফিসের কাপড়চোপড় ছাড়তে ছাড়তে মনে মনে নিজের একটা পুরোনো কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করল।

বিকেলের ভিজে ওঠা বুবুদের দেহে কোনো পাপ নেই।
কাঁচকলা রং, দিঘল পাড়ের আঁচল, বুবুরা ভিজে ওঠা শরীরের ভাঁজে
পুরুষের দেহ পুণ্য করে, পুণ্য হয়। বুবুদের মনে কোনো পাপ নেই...। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন