টিয়ে রাজকন্যার আখ্যান-চার

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দোকানে বসে থেকে নদীর যেন সময়টা যেতেই চাচ্ছে না। বিকেলের দিকে কাস্টমার তুলনামূলক বেশি থাকে। আজও পনেরো-বিশ মিনিট পরপর কাস্টমার আসছে। তারপরও তার সময়টা কাটতে চাচ্ছে না। নদী কতক্ষণ মোবাইলে ফেসবুক দেখল। তার ফেসবুকের প্রতি খুব একটা আগ্রহ যে আছে, তা নয়। কালেভদ্রে দু-একটা স্ট্যাটাস শেয়ার করে। নিজ থেকে খুব একটা ছবি পোস্ট দেয় না। তবে ফেসবুক থেকে তার একটা উপকার হয়েছে। বুয়েটের বন্ধুরা তো আছেই, স্কুল ও কলেজের বেশ কিছু বন্ধুর খোঁজ নদী পেয়েছে। এ ছাড়া, ফেসবুক মেসেঞ্জার ব্যবহার করে নদী অনেকের সঙ্গে কথা বলতে পারছে।

দোকানে একজন কাস্টমার ঢুকতেই নদী ফেসবুক বন্ধ করে মোবাইলটা পাশে রেখে দিল। নদী অযথাই দোকানের এদিকওদিক তাকাল। দোকানটা যে খুব বেশি বড়, তা নয়। তুলনামূলক অন্য কনভিনিয়েন্স স্টোরের চেয়ে ছোট। তবে বেশ গোছাল। হয়তো জুঁই ভাবি গুছিয়ে রাখেন বলে দোকানটা এত গোছাল।

এবারের কাস্টমার সিগারেট ও একটা ওয়াইকাটো টাইমসের উইকএন্ড এডিশন কিনতে এসেছিল। এ সব কনভিনিয়েন্স স্টোরের কাস্টমারগুলো এমনই। সিগারেট, দুধের কন্টেইনার, পত্রিকা, ম্যাগাজিন বা একটা কী দুটো সফট ড্রিংকস কিনতে আসে। তারপরও দেখা যায়, দিনের শেষে বেশ ভালো লাভ হয়। এই লাভ হওয়ার পেছনে কারণও আছে। যে জিনিসটা বড় সুপারমার্কেটগুলোতে এক ডলার, সেই একই জিনিস কনভিনিয়েন্স স্টোরগুলোতে দুই বা আড়াই ডলার রাখা হয়। কখনো কখনো তিন ডলারও রাখে। তবে এ সব কনভিনিয়েন্স স্টোরগুলোতে সবচেয়ে বেশি লাভ সিগারেট ও পত্রিকা ম্যাগাজিন বিক্রি করে।

কাস্টমার চলে যাওয়ার পর নদী আবার কাউন্টারে ঝুঁকে টুলে বসল। কী ভেবে নদী দোকানের সামনের দরজা দিয়ে বাইরে তাকাল। তার বসার স্থান থেকে বাইরে খুব বেশি দেখা যায় না। কিন্তু যত দূর দেখা যায় তাতে মনে হচ্ছে, আজকের দিনটা খুব চমৎকার। সবে ডে-লাইট সেভিংস শুরু হয়েছে। এখন সাতটার পরে সন্ধ্যা হয়। নদী ভাবল, আহা, এমন চমৎকার দিনে রাকিব ভাইয়ের সঙ্গে ওয়াইকাটো নদীর পাড়ে হাঁটতে কী ভালোই না লাগত! পাশাপাশি হাঁটা। হাঁটতে হাঁটতে নতুন কবিতা শোনা...! আজ হয়তো তাদের ওয়াইকাটো নদীর পাড়ে হাঁটা সম্ভব হতো না। গত এক সপ্তাহ ধরেই তারা পরিকল্পনা করে রেখেছিল, আজ তারা ম্যাটাম্যাটা হবিটন হাউস ও মুভি সেটে যাবে। কিন্তু দোকানে বসতে হয়েছে বলেই আজ সবকিছু কেমন ভেস্তে গেল।

নদী ঘড়ি দেখল। সবে সাড়ে পাঁচটা বাজে। আরও দেড় ঘণ্টা তাকে দোকানে বসে থাকতে হবে। সাতটার সময় দোকান বন্ধ করবে। দোকান বন্ধ করে নদী সরাসরি হ্যামিল্টন ইস্টে চলে যাবে। আজ রাকিব আর নদী কারি পট সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে খাবে।

এমন ভাবনার মধ্যে আরেকজন কাস্টমার দোকানে ঢুকল। এবারের কাস্টমারটা একটা দুই লিটার দুধের কন্টেইনার ও একটা রুটি কিনল। কাস্টমার চলে যেতেই নদী কাউন্টার ছেড়ে অফিস রুমটা ঘুরে এল। এমনিই। কাউন্টারে ফিরে এসে মোবাইল হাতে নিয়ে এবার নতুন আসা ইমেইলগুলো দেখল। তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো ইমেইল নেই। কয়েকটা জাঙ্ক মেইল। একটা মেইল তার সুপারভাইজারের কাছ থেকে এসেছে। তিনি একটা অ্যাসাইনমেন্টের ফলোআপ দিয়েছেন। এ ছাড়া, ব্যাংকের একটা ইমেইল আর ওয়ার্ল্ড জার্নালের একটা ইমেইল।

নদী ইমেইলগুলোর ভেতরে ঢুকল না। মোবাইলটা পাশে রেখে দরজা দিয়ে আবার বাইরে তাকাল। এ সময় নদীর মায়ের কথা মনে পড়ল। মার সঙ্গে গতরাতেই নদী মেসেঞ্জারে কথা বলেছে। মার একটা সুখবর আছে। তিনি সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক হয়েছেন। এ ছাড়া, তিনি বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন। মার আরও একটা সুখবর হলো, আগামী বইমেলায় তার বাছাই কবিতা নিয়ে পাঁচ শ পৃষ্ঠার একটা কবিতা সমগ্র বের হবে।

এদিকে রাকিবও একটা কবিতার বই বের করবে বলে অনেকগুলো কবিতা গুছিয়েছে। রাকিব আজকাল বেশ কবিতা লিখছে। আর রাকিব কবিতা লিখছে বলে নদীর বেশ ভালো লাগছে। মার ভালো লাগাগুলো যেমন নদীর একান্ত ভালো লাগা, তেমনই রাকিবের ভালো লাগাগুলোও তার একান্ত ভালো লাগা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদী প্রতিনিয়ত মনে করে, রাকিবের প্রতিটা কবিতাই যেন তাকে স্পর্শ করে লেখা। কী এক অদৃশ্য স্পর্শ! কিন্তু স্পর্শগুলো অলৌকিক। কেমন অনুভবের। আবার কেমন অদ্ভুতও!

নদী মোবাইলটা হাতে নিল। কিন্তু মোবাইলটা হাতে নিয়েই রেখে দিল। তারাপর ঘড়ি দেখল। ছয়টা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। নদী একটা অস্ফুট শব্দ করল, ধ্যাত! তার সময়টা যেন যেতেই চাচ্ছে না। আরও এক ঘণ্টার ওপরে বসে থাকতে হবে!

ঠিক তখনই দোকানের সামনের দরজা দিয়ে কেউ একজন ঢুকল। দোকানের সেন্সর মেট শব্দ করে উঠল টুং টুং, টুং টুং। নদী দোকানের কাস্টমার মনে করে দরজার দিকে তাকাল। আর তাকানো মাত্রই কী এক ভালো লাগা এসে জড়িয়ে ধরল। রাকিব দরজা দিয়ে দোকানে ঢুকেছে। নদীর সঙ্গে সঙ্গে কাউন্টার ছেড়ে দৌড়ে গিয়ে রাকিবের হাত ধরতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু নদী কেন জানি কাউন্টার থেকে এক পাও নড়তে পারল না।

রাকিব যে এই দোকানে আগে আসেনি, তা নয়। বেশ কয়েকবার অকল্যান্ড আসা-যাওয়ার পথে কাস্টমার হিসেবে এসেছে। তবে নদী এই দোকানে কাজ শুরু করার পর এই প্রথম এল।

রাকিব নদীর কাছে এসে বলল, শনিবারের এই দিনটা প্রায় সব সময় তোমার সঙ্গে কাটাই বলে আজকে সময়টা কেন জানি যেতে চাচ্ছিল না। তাই দোকানে চলে এলাম।

নদী একটা দিঘল হাসি দিয়ে বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছিল, সাতটা বাজতে যেন সাত যুগ লাগছে।

রাকিব হেসে ফেলল। বলল, তাই!

: হ্যাঁ, তাই! আসলে শনিবারে কখনো কাজ করিনি তো।

: আমিও তোমাকে খুব মিস করছিলাম। তুমি সাতটার সময় যাবে জেনেও এই এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে পারিনি। তাই দোকানে চলে এসেছি।

নদী মাথা ঝাঁকাল। একটু নরম হাসলও। জিজ্ঞেস করল, চা খাবেন? কফিও বানিয়ে দিতে পারি।

রাকিব বলল, এখন আবার এই ঝামেলা করবে কেন?

: ঝামেলার কিছু নেই। আপনি তো ব্ল্যাক কফি খান। কাপে ইনস্ট্যান্ট কফি নিয়ে হট ওয়াটার জগ থেকে পানি ঢেলে দিলেই হয়। পেছনের অফিস রুমে সব ব্যবস্থা আছে।

: তাহলে এক কাপ কফি বানাও। এখন পর্যন্ত কফি খাইনি।

: আমিও না। খাব-খাচ্ছি করে খাওয়া হয়নি।

: তাহলে তোমার জন্যও বানাও।

নদী বলল, আপনি কী মনে করেন শুধু আপনার জন্যই কফি বানাব? না, আমার জন্যও কফি বানাতে যাচ্ছি। তবে আপনার মতো চিনি ছাড়া ব্ল্যাক কফি না। আমি চিনি ও দুধ দিয়ে ঘন করে বানিয়ে কফি খাই। খানদানি কফি। আমি চৌধুরী বাড়ির মেয়ে। হি হি, হি হি!

রাকিব আবার হাসল। কিছু বলল না। তখনই দোকানে একজন কাস্টমার ঢুকল।

নদী পেছনের অফিস রুমে ঢুকতে গিয়ে আবার ফিরে এল। এবারের কাস্টমারও দুধ আর রুটি নিতে এসেছে। সঙ্গে অবশ্য একটা নিউজিল্যান্ডে হেরাল্ড উইকএন্ড এডিশন কিনেছে।

কাস্টমার চলে যেতেই রাকিব কাউন্টারের সামনের একটা টুল টেনে বসল। তার বসার স্থান থেকেই অফিস রুমের ভেতরের অনেকটা দেখা যায়।

রাকিব একটু গলা বাড়িয়ে বলল, এখানে আসার আগে জাহিদ ফোন দিয়েছিল।

নদী অফিস রুম থেকেই জিজ্ঞেস করল, কেন? তিনি কি আজ হ্যামিল্টনে আসবেন?

: না। আজমল স্যারের একটা খবর দেওয়ার জন্য ফোন দিয়েছিল।

: আজমল স্যারের কী খবর?

: আজমল স্যারের নতুন কোনো খবর নেই। ওই একই খবর, তাকে বাংলাদেশের উদ্দেশে ডিপোর্ট করার সব প্রোসেসিং চলছে। আসছে মঙ্গলবারের পরের মঙ্গলবারে তাকে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসে বাংলাদেশ পাঠিয়ে দেবে।

: তিনি এখন কোথায়?

: তিনি এখনো অকল্যান্ডের সেন্ট্রাল পুলিশ স্টেশনের অস্থায়ী প্রিজনে আছেন।

: জাহিদ ভাই আজমল স্যারের জন্য কিছুই করতে পারলেন না?

: না, জাহিদ অনেক চেষ্টা করেছে। অকল্যান্ডের অনেকের কাছেই স্যারকে সহযোগিতা করার জন্য ফোন দিয়েছে। কিন্তু তেমন কোনো সাড়া পায়নি। আসলে কী জান, এখানে মানুষ তেলের মাথায় তেল ঢালে। আর যার মাথায় তেল নেই, তার মাথায় বেল ভাঙে।

নদী হেসে ফেলল। বলল, হুম, আপনি একদম ঠিক কথা বলেছেন।

রাকিব মাথা ঝাঁকাল। এমনিই। এক মুহূর্ত চুপ থেকে কী ভেবে বলল, আরেকটা কথা। জাহিদ আমাকে অকল্যান্ড যেতে অনুরোধ করেছে।

নদী জিজ্ঞেস করল, কখন?

: আজমল স্যারকে অকল্যান্ড এয়ারপোর্টে বিদায় জানাতে।

: আপনি যাবেন?

: আমার মঙ্গলবারে অফিস থাকে না?

: তা থাকে। কিন্তু আপনি আজমল স্যারকে বিদায় জানাতে গেলে তিনি খুশি হবেন।

: তুমি তো জাহিদের মতো কথা বলছ। আমি গেলে তুমি যাবে?

নদী একটু ভেবে বলল, আচ্ছা, দেখি। আমার মঙ্গলবারে অবশ্য ক্লাস থাকে না। মাঝেমধ্যে সুপারভাইজারের সঙ্গে বসতে হয়। আজমল স্যারের ফ্লাইট কখন?

রাকিব বলল, দুপুর দুটোয়। তবে স্যারকে নাকি সকাল দশটার সময়ই নিয়ে যাবে। আমরা গেলে একটু আগেই চলে যাব। এগারোটার মধ্যে ওখানে থাকব।

নদী কফির দুটো কাপ নিয়ে কাউন্টারের পেছনে নিজের টুলে এসে বসল। একটা কাপ রাকিবের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, আপনি কোথাও যেতে বললে আমি কি না করি? আপনার সঙ্গে যাওয়া মানেই তো আনন্দের।

রাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, এবার পাক্কা কথা, তোমাকে নিয়ে অকল্যান্ড যাবই যাব। প্রয়োজনে এই সোমবারে অফিসে গিয়েই আগে আগে ছুটি নিয়ে রাখব। আগেরবার আতিকের বউকে অকল্যান্ড এয়ারপোর্ট থেকে পিক করার জন্য তোমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যেতে পারিনি। এবার মিস হবে না।

নদী কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে সায় দিয়ে হাসল। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: [email protected]

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: