টিয়ে রাজকন্যার আখ্যান-পাঁচ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আজ শনিবার হলেও কারি পট রেস্টুরেন্টে এখনো তেমন ভিড় নেই। হয়তো সবে সাড়ে সাতটা বাজে বলে। রাকিব আর নদী কোণের একটা টেবিল দেখে বসল। রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার ও ওয়েটার তাদের চেনা। ম্যানেজার দূর থেকে সৌজন্যের হাসি দিলেন। ওয়েটার কাছে এসে কিছু না জিজ্ঞেস করেই মৃদু হেসে চলে গেল।

নদী বলল, আমাদের মনে হয় খাবারের মেনু পরিবর্তন করা দরকার।

রাকিব জিজ্ঞেস করল, কেন?

: দেখেন না, আমরা সব সময় একই ধরনের খাবার খাই বলে ওরা কেমন হাসে? সেই তন্দুরি চিকেন, নান রুটি, রাইতা...!

: একই খাবার খাই বলে ওরা আমাদের ছোট করার জন্য হাসেনি। ওটা ওদের সৌজন্য হাসি।

: তা জানি, কিন্তু?

: কিন্তু কী?

: কিছু না। আমি এমনিই বললাম।

: তোমার এই খাবারটা ভালো লাগে না?

: অবশ্যই ভালো লাগে। আমি কথার কথা বললাম। আচ্ছা, আমরা অন্য প্রসঙ্গে যাই।

: কী প্রসঙ্গ?

: মার প্রসঙ্গে বলি।

: হ্যাঁ, বলো।

: মার দুটো খবর আছে। প্রথম খবরটা হলো, মা কলেজে তার ডিপার্টমেন্টে চেয়ারম্যান হয়েছেন। আর প্রমোশনও পেয়েছেন। তিনি এখন ফুল প্রফেসর।

রাকিব বলল, বাহ, দারুণ খবর তো! তাহলে তুমি একদিন আমাকে খাওয়াবে।

নদী জিজ্ঞেস করল, একদিন কেন, তাহলে আমি আজই রেস্টুরেন্টে খাবারের বিলটা দিই?

রাকিব বলল, তুমি কী পাগল হয়েছ যে আমি থাকতে তুমি বিল দেবে? এমনিতে একবার-দুবার রেস্টুরেন্টে বিল দিয়েছ, ওটা অন্য ব্যাপার।

: আপনি কি সারা জীবনই এভাবে রেস্টুরেন্টের বিল দিয়ে যাবেন?

: হ্যাঁ, সারা জীবনই দেব। কোনো অসুবিধা?

নদী হেসে বলল, না, কোনো অসুবিধা নাই। কিন্তু আপনি যে আমাকে একটু আগে খাওয়াতে বললেন?

রাকিবও মৃদু হেসে বলল, তুমি বাসায় এসে রান্না করে খাওয়াবে।

নদী বলল, আপনার বাসায় এসে?

: আর কার বাসায় গিয়ে রান্না করবে?

: নাবিদ ভাইয়া ও জুঁই ভাবির বাসায় গিয়েও তো করতে পারি। শিমুল ভাবিদের বাসায়ও করতে পারি।

: হ্যাঁ, তা করতে পার। কিন্তু?

: কিন্তু কী?

: না, কিছু না।

: আহা, বলেন না।

: না থাক। আসলে মৌনতার পাকনা পাকনা কথাগুলো মনে পড়ে গেল।

: মৌনতা আসলেই পাকনা পাকনা কথা বলে। আমার কী যে ভালো লাগে! মৌনতা সেদিন কী বলে জানেন? সে বলে, আচ্ছা ফুফি, তোমার বেবি হবে কবে? তুমি রাকিব আংকেলকে বলো না, তোমাকে একটা বেবি দিতে, প্লিজ...! বলে নদী তৎক্ষণাৎ নিজেই লজ্জা পেয়ে গেল। নদী দৃষ্টি নামিয়ে তাড়াতাড়ি বলল, সরি, আমি এসব কী বলছি!

রাকিব এক মুহূর্তের জন্য চুপ থেকে মৃদু হেসে বলল, মৌনতা খুব ইন্টেলিজেন্ট হবে।

নদী না তাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হু!

রাকিব কথাটা সহজ করার জন্য বলল, হ্যামিল্টনে তুমি তোমার নাবিদ ভাই, জুঁই ভাবি ও মৌনতাকে পেয়ে ভালোই হয়েছে। তোমার এত কাছের মানুষ...!

নদী দৃষ্টি তুলে বলল, জি, আপনি ঠিকই বলেছেন। ওদিকে মা প্রথম দিকে পজেটিভলি মেনে নিতে না পারলেও এখন বেশ মেনে নিয়েছেন। মাঝেমধ্যে নাবিদ ভাইয়া ও জুঁই ভাবির সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে কথা বলেন। নাবিদ ভাইয়া ও জুঁই ভাবিও এখান থেকে ফোন দেন। মৌনতাও মার সঙ্গে কথা বলে। বিশ্বাস করবেন না, মৌনতা মার সঙ্গে কী পাকনা পাকনা কথা বলে! সে মাকে বলে, দাদি, তুমি নদী ফুফিকে জন্ম দিয়েছ কীভাবে? নদী ফুফি কত বড়! তুমি কি জায়ান্ট বুড়ি? তোমার স্টমাক কি ইয়া বড়...?

ওয়েটার চিলার থেকে একটা ঠান্ডা পানির জগ এনে টেবিলের মাঝখানে রেখে খাবারের প্লেটগুলো সাজিয়ে দিয়ে গেল। রেস্টুরেন্টে আজ শনিবার বলেই একটু ধুমধাড়াক্কা ধরনের গান বাজছে। যদিও গানগুলো খুব নিম্ন ভলিউমে বাজছে। উইক ডেতে রাতে ওরা খেতে এলে বরাবরই এখানে পুরোনো দিনের হিন্দি গান শোনে।

রাকিব জিজ্ঞেস করল, তোমার মার দ্বিতীয় খবরটা তো বললে না?

নদী বলল, ও আচ্ছা। মার দ্বিতীয় খবরটা হলো, তার একটা পাঁচ শ পৃষ্ঠার কবিতা সমগ্র বের হবে। বাছাই কবিতা নিয়ে সমগ্রটা।

: এ তো দারুণ একটা সংবাদ।

: হ্যাঁ, মা খুব খুশি। প্রকাশকও এই বইটার জন্য বেশ বড় অঙ্কের রয়্যালটি দেবেন। আমি মাকে আপনার কথাও বলেছি।

রাকিব জিজ্ঞেস করল, আমার কথা! আমার কী কথা?

নদী বলল, আপনি যে নতুন কবিতার বই বের করার পরিকল্পনা করছেন।

: তোমার মা কী বললেন?

: তিনি খুব খুশি হয়েছেন। বলেছেন, আপনি আপনার এই প্রতিভাটা ধরে রাখলে একদিন অনেক ওপরে যাবেন।

: তোমার কি মনে হয় তোমার মা ঠিক বলেছেন?

: অবশ্যই।

: আমার কিন্তু মনে হয় না। একদিন হয়তো হুট করে নিজেকে হারিয়ে বসব। তখন কবিতা থেমে যাবে। আগে যেমন কয়েকবার কবিতার জগৎ থেকে হারিয়ে গিয়েছিলাম।

: আমি আপনাকে হারাতে দেবই না!

: তুমি কি সব সময় পাশে থাকবে?

: পাশে থাকব না কেন?

: দূরেও তো যেতে পার?

: প্রয়োজনে যাব। কিন্তু দূরে থেকেও আপনার সঙ্গ ছাড়ব না। কবিতা লেখা আপনি ছাড়তে পারবেন না।

: বেশ। তাহলে ছাড়ব না।

ওয়েটার খাবার নিয়ে এল। একটা বড় প্লেটে আস্ত একটা তন্দুরি চিকেন। কিন্তু ছোট ছোট টুকরো করে কাটা। চিকেনের ওপর গোল গোল করে কাটা পেঁয়াজ ও লেবুর টুকরো। পাশেই একটা ছোট্ট বাটিতে রাইতা ও একটা টুকরিতে চারটা নান রুটি।

রাকিব নিজের প্লেটে একটা নান রুটি ও এক টুকরো চিকেন নিয়ে নদীর প্লেটেও বেড়ে দিল। নদীর প্লেটে ছোট্ট চামচে রাইতা দিতে দিতে বলল, তোমাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম।

নদী জিজ্ঞেস করল, কী কথা?

: আমি তোমাকে কিছু দিতে চাচ্ছিলাম। তুমি যদি না নিতে চাও, নিয়ো না। কিন্তু তুমি রাগ করতে পারবে না, প্লিজ!

: কী, আপনি আপনার নতুন গাড়িটা আমাকে দিয়ে দেবেন?

: আহা, এখানে গাড়ির কথা আসছে কেন?

: তাহলে আপনি কী দেবেন? নতুন গাড়িটাই তো বাকি আছে।

: তুমি কি নতুন গাড়িটা নেবে?

: আপনার নতুন গাড়িটা আমি কেন নেব?

: তা আমি কী করে বলব?

নদী এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গিয়ে কী ভেবে বলল, দেখুন, আমি এত বিলাসিতার মধ্যে বড় হইনি। বিলাসিতা আমার পছন্দও নয়। আপনি আপনার আগের গাড়িটা দিয়েছেন, এতে প্রয়োজন মিটেছে। সম্ভব হলে আস্তে আস্তে আপনার সেই গাড়ির টাকাটা দিতাম। কিন্তু আপনি মনে কষ্ট পাবেন বলে দিচ্ছি না। আমি চাই না আমার কোনো কারণে আপনি মনে কষ্ট পান। তাই হুটহাট করে আমার জন্য কিছু কিনবেন না।

রাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হু!

নদী জিজ্ঞেস করল, কই, আপনি এখন কী দিতে চাচ্ছেন, বলেন?

রাকিব বলল, না, থাক।

: থাকবে কেন?

: আহা, থাক না।

নদী মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আচ্ছা।

ওরা নিঃশব্দে কিছুক্ষণ খাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে উঠল। রেস্টুরেন্টে আস্তে আস্তে লোকজন বাড়ছে। তখনো লো ভলিউমে ধুমধাড়াক্কা হিন্দি গান বাজছে। খিঁচ মেরা ফটো তো, খিঁচ মেরা ফটো। খিঁচ মেরা ফটো তো, খিঁচ মেরা ফটো। খিঁচ মেরা ফটো তো, খিঁচ মেরা ফটো...।

রাকিব বুঝতে পারল না, এই হিন্দি গানটার বাকি শব্দ বা বাক্যগুলো কোথায়? শুধু একই বাক্য কেন বারবার বলছে, খিঁচ মেরা ফটো তো, খিঁচ মেরা ফটো...!

নদী রাকিবের দিকে সরাসরি দৃষ্টিতে তাকাল। নদী বাম হাত বাড়িয়ে রাকিবের একটা হাতটা ধরল। আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, আপনার মন খারাপ হয়ে গেছে?

রাকিব মৃদু হাসল। কিছু বলল না।

নদী বলল, আপনি কী এনেছেন, দেখান তো।

রাকিব বলল, আমি তাহলে এখন গাড়ি থেকে নিয়ে আসি। ওটা গাড়িতে রেখেছি।

নদী জিজ্ঞেস করল, কী, আমার ভয়ে?

: ঠিক ভয়ে নয়। এমনিই।

: তাহলে এখন গাড়িতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আগে খাওয়াদাওয়া শেষ করুন। খাওয়ার পরে দেখব।

রাকিব বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে। কিন্তু পরক্ষণই কী ভেবে বলল, না, আমি ওটা এখনই নিয়ে আসি।

নদী জিজ্ঞেস করল, এখনই কেন?

রাকিব মৃদু হাসল। কিছু বলল না।

: বললাম না, আপনি আমাকে ভয় পান। হি হি হি!

: ভয় না, রেসপেক্ট।

: ওই একই কথা। আচ্ছা, কী এনেছেন বলেন তো?

রাকিব বলল, আমি ওটা আগে গাড়ি থেকে নিয়ে আসি। তখন না হয় দেখ?

নদী মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আচ্ছা।

রাকিবের গাড়িটা রেস্টুরেন্টের সামনেই দিঘল গ্রে স্ট্রিটের এক পাশে পার্ক করা। নদীর গাড়িটা তার পেছনেই। রাকিব উঠে গিয়ে গাড়ি থেকে গয়নার সেটটা নিয়ে এল। নিজের চেয়ারে বসে নদীকে দিতে দিতে বলল, আজ দুপুরে এটা তোমার জন্য কিনেছি।

নদী মাইকেল হিল জুয়েলার্সের বাক্স দেখেই বলল, আপনি কোনো অরনামেন্ট কিনেছেন নাকি?

রাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ।

নদী হাত বাড়িয়ে নিয়ে বলল, দেখি কী কিনেছেন। বলেই নদী গয়নার বাক্সটা খুলল। খুলেই বলল, ও মাই গড। আপনি এই সেটটা কিনেছেন?

: এই সেটটা মানে?

: এই সেটটা মানে, এই সেটটা...।

: এই সেটটা মানে কি?

: না, কিছু না।

রাকিব বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। কিছু না হলে কিছু না...! এখন বলো, তোমার সেটটা পছন্দ হয়েছে?

নদী আস্তে করে বলল, পছন্দ মানে, খুবই পছন্দ হয়েছে।

রাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আমার খুব ভালো লাগল জেনে।

নদী এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, রাকিব ভাই, একটা কথা। বিশ্বাস করেন, আমি গত পরশুদিনই শিমুল ভাবির সঙ্গে ডাউন টাউন প্লাজায় গিয়েছিলাম। শিমুল ভাবির প্রয়োজনেই গিয়েছিলাম। ওখানে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মাইকেল হিল জুয়েলার্সের ডিসপ্লেতে এই সেটটা দেখি। দেখেই পছন্দ হয়ে যায়। এই পছন্দ হওয়ার পেছনে কারণ ছিল একটাই। এম্যারল্ডের এই সেটটা আমার টিয়ে রঙের শাড়ির সঙ্গে খুব মানাবে বলে। কিন্তু দাম দেখে দমে গিয়েছিলাম।

: আমিও আজ ডাউন টাউন প্লাজার মাইকেল হিল জুয়েলার্সে গিয়ে এই সেটটা দেখে সঙ্গে সঙ্গে পছন্দ করে ফেলি। আমি আর দেরি না করে কিনে ফেলি।

: এটা তো অনেক দাম।

: আমি জানি। কিন্তু কখনো কখনো পছন্দের জিনিস দাম হলেও কিনে নিতে হয়।

নদী সায় দিয়ে মাথা ঝাঁকাল। বলল, বেশ ভালো কথা। আমি এই অরনামেন্ট সেটটা আপনার কাছ থেকে নিচ্ছি। আপনার পছন্দের টিয়ে রঙের শাড়িটার সঙ্গে মানিয়ে পরব। কিন্তু একটা অনুরোধ। আপনি পরবর্তীতে আমার জন্য কিছু কিনতে হলে আমাকে আগে জিজ্ঞেস করবেন। এতে আমি অনেক খুশি হব।

রাকিব মৃদু হেসে বলল, আচ্ছা। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: