বন্ধন-দুই

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মৃত্যু কী, বুঝে ওঠার আগেই আচমকা সেই শেষ দেখার ধকল সইতে পারিনি সেদিনের সেই ছোট্ট আমি। ওই কুঁচকে যাওয়া চামড়া আর শামুক ভরা কান দেখে চোখের সামনে কালো পর্দা নেমে এসেছিল জীবনে প্রথমবার। আঞ্চলিক ভাষায় যাকে বলে দাঁত লাগা। এরপর বহু বছর দুঃস্বপ্নের হানা, রাতে চোখ বুজলেও দেখতে পেতাম শেষ দেখা সেই মুখ। চমকে জেগে উঠতে হতো।

লেলু মারা যাওয়ার পর বেশ কিছু বছর বাড়িতে ওর জন্মদিন আর মৃত্যুদিনে মিলাদ মাহফিল করা হতো (এখন এ আয়োজন মসজিদে করা হয়, বাড়িতে নয়)। এই মিলাদের তদারকির ভার বড়দের সঙ্গে আমারও থাকত। মিলাদ মানেই কিছুটা থমথমে, একটু অন্য রকম পরিবেশ। অন্তর্মুখী আমি তখন একটু একটু করে সবার সঙ্গে মিশতে শিখছি। আছে কিছু বন্ধু-বান্ধবীও, যারা আমায় বেশ বুঝত।

তেমনি এক মিলাদের দিন, সাল ২০০৬। আমি বড়দের সবার চোখের আড়ালে, নিজের উথলে ওঠা আবেগকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টায় ছিলাম। সবার সামনে কান্নাকাটি পোষায় না আমার। নকিয়া ১১১০-এর আওয়াজে ঘোর কাটল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল একটা নাম, যে মানুষটা আজ আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ—রিফাত।

পাঠক ভাবছেন কী? প্রেমে পড়েছি আমি! হা, হা! মোটেও না। শুনুন তবে।

সে আমার সহপাঠী, ২০০৫ থেকে। বয়সে আমার থেকে প্রায় আড়াই বছরের ছোট যদিও। তত দিনে বেশ ভালো বন্ধুও বটে। আমি তো স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছিলাম।

হুট করেই প্রশ্ন, ‘কী হলো কী? গলা কাঁপে কেন তোর?’

: কাঁপে মানে? বেশি শুনিস কানে? কাঁপবে কেন?

এবার ওর কণ্ঠে কিছুটা শাসন, আমি তোর গলার স্বর চিনি। তোর গলা কাঁপা মানেই কোনো সমস্যায় আছিস, ঝেড়ে কাশ, নয়তো ফোন কাটলাম কিন্তু!

আর পারলাম না। বন্ধুবান্ধবদের থেকে লেলু কাহিনি আড়ালেই ছিল। কারণ এ বিষয়টা নিয়ে কথা বলতাম না বললেই চলে। তবে সেদিন ওকে বলতেই হলো এবং উনি ভদ্রলোক, কথার মাঝে কান্নাও বুঝতে পারলেন।

পুরোটা সময় নিয়ে শুনল সে। তারপর তার একটাই কথা, ‘মৃত্যুকে এখনো হয়তো দেখিনি তোর মতো, জানি না। কিন্তু এটা জানি, আমার কোনো বড় বোন নাই। বলছি না, ওনার জায়গাটা আমাকে দিয়ে দে, সেটা সম্ভবও না কোনো দিন। তবে আমাকে যদি যোগ্য মনে করিস, তবে তোর মনে আমার জন্য একটা জায়গা বানাস। তোর কান্না থামবে, আমিও বোন পাব।’

ওর কণ্ঠে আকুলতা ছিল। থমকে গিয়েছিলাম শুনে। কিছুটা রেগেই জবাব দিলাম, কী চাইছ, বুঝে চাইছ তো ছেলে? আবেগ বাড়িয়ে ধাক্কা দেওয়ার ধান্দা নয় তো এটা?

হালকা হাসি শুনতে পেলাম অপর প্রান্তে, বুঝেই বলছি।

এরপর থেকে বন্ধু থেকে পরিচিত, সবার এক প্রশ্ন শুনে আসছি, রক্তের সম্পর্ক নেই, তবু এরা পারে কী করে? একজনের মুখ থেকে কথা পড়ার আগেই আরেকজন বুঝে নিচ্ছে, চিন্তাধারা প্রায় এক এদের। যে মেয়ের আশপাশে যেকোনো ছেলে যাওয়ার আগেও বিশবার চিন্তা করে, এই একটা মানুষকে সেই মেয়ে কেমন পরম স্নেহে জড়িয়ে ধরতে পারে। আর এ ছেলেও তো কম না, এমনিতে কারাতের প্যাঁচে যে কাউকে ধরাশায়ী করে ফেলা, একটু গম্ভীর, ধীরস্থির মানুষ, বোনের সামনে সে চার বছরের শিশু হয়ে যায়? কিসের টানে? দূরত্বও এদের সম্পর্কে প্রভাব ফেলে না? এ যুগে এটা হয়?

এখন যেমন আমি যুক্তরাষ্ট্রে আর রিফাত বাংলাদেশে। তেমনি ২০০৯-২০১২ সালে রিফাত ছিল যুক্তরাজ্যে আর আমি তখন বাংলায়। কারণ? কী আবার? লেখাপড়া! তবে যা-ই হোক না কেন, মুঠোফোনের বার্তা বাক্সে একজন আরেকজনের জন্য কিছু না কিছু রেখেই দিই। হোক সে গান, ছোট্ট চিঠি বা ছবি। গানে লেলুর মতো রিফাতও বেশ সুরেলা। ওর সেই মৃদু হাসির মায়ায় বাঁধা পড়েছিলাম, আজও বেঁধেই রেখেছে। কখনো অভিমানে যদি বলেও বসি, যাহ, চলে যা, ফেলে দিলাম তোকে, হালকা হাতে জড়িয়ে বলবে, ‘ফেলে দিবি? ফেলে দেখা তো।’ বলেই সেই হাসি। আজ লেলুকে মনে পড়ে তো লম্বা ডাক ছাড়তে পারি, রিফু, কই রে আমার বিলাইটা? সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর আসে, ‘এই যে আপু, আছি তো।’

ফেলে দেব একে? আমার ঘাড়ে কটা মাথা? একে ফেলতে গেলে নিজেই আহত হতে হবে। ভালো থাকুক পৃথিবীর সব ভাইবোন। ভালোবাসি তোকে, রিফু।

দ্রষ্টব্য: একজনের কথা বলেছি এ পর্বে। এমন আরেকজন আছে জীবনে, আরও কিছুটা ছোট সে আমার থেকে। এদের জন্য আজ প্রতি মুহূর্তে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাই, আর লেলুর আত্মার শান্তি কামনা করি।

ধারাবাহিক এ লেখার আগের পর্ব দেখতে ক্লিক করুন