পুরির বঙ্গোপসাগর

পুরির সৈকত
পুরির সৈকত

পেছনের ব্যালকনিতে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল উত্তাল বঙ্গোপসাগর, তার উচ্ছল জীবনের অশ্রান্ত আবেগে কূল ছাপিয়ে আছড়ে পড়ছে নিরন্তর। দূরে আরও দূরে পাল তোলা ছোট ছোট জেলে নৌকার ঝাঁক। তরঙ্গের পর তরঙ্গের ঘায়ে হৃৎপিণ্ডের রক্তস্রোতের মতো ডোবা ভাসার কুশলী খেলায় লুকোচুরি খেলছে। সৈকতের উদ্দাম হাওয়ায় ডানা ঝাপটানির শব্দ। বৈরাগ্যের তাণ্ডব নৃত্যে ঝেঁটিয়ে নিঃস্ব করে দিচ্ছে চারপাশ। পড়ন্ত বিকেলের রক্তলাল সূর্য তখনো সন্ধ্যার শামিয়ানা ছড়িয়ে কালো করেনি আকাশকে। তখনো অস্তগামী সূর্যের সিঁদুররাঙা দেহ থেকে প্রবল প্রতাপ সাগর, মন্থন করে নিচ্ছে উদ্বেলিত রঙের ফোয়ারা। সেই অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে জীবনের অতন্দ্র স্লোগান শুনে সুচরিতরা সিঁড়ি ভেঙে নিচে এল। দীনকৃষ্ণ সামনেই বসেছিল। হেসে জানতে চাইল, সমুদ্র দেখতে যাচ্ছেন স্যার? হ্যাঁ। হ্যাঁ দেখে আসুন। খুব ভালো লাগবে। বলেই ভুবনমোহন স্মিত হাসিতে নিঃশব্দে হাসল সে।

পেছনের সিঁড়ি বেয়ে সাগর সৈকতের দিকে পা বাড়িয়েছিল দুজনে। সহসা সিঁড়ির সামনে এক বিস্ময়কর দৃশ্যে পলকহীন হলো দৃষ্টি। এক স্বর্ণকেশী সুন্দরী বাজারের ভারী ব্যাগ দুই হাতে ঝুলিয়ে পেছনের গেট দিয়ে উঠে আসছেন ওপরে। এমন দৃশ্য দেখা যাবে ভাবেনি ওরা। যদিও খানিক আগেই দেখেছে, এক ককেশাস ভদ্রলোক লাউঞ্জে বসে নিউজ পেপার পাঠ করছেন সুগভীর মনোযোগে। ক্লান্ত চরণে শ্লথ ভঙ্গিতে ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে স্বর্ণকেশী বিদেশিনী মুখোমুখি হয়ে ভদ্রতা করলেন সরাসরি তাকিয়ে, হাই! ভদ্রতায় সাড়া দিয়ে পাশ কাটিয়ে নিচে নামল ওরা। বহ্নির মনে গভীর কৌতূহল আকর্ষণে জেগে উঠেছিল। দৃষ্টির প্রখরতায় আরও একবার সে তাই পেছন ফিরে তাকাল। সেই মুহূর্তে স্বর্ণকেশীও নজর ফেললেন। তিনিও কি কৌতূহলী তারই মতো? বহ্নি দেখল অবারণ দৃষ্টির প্রবলতা দিয়েই তিনি দেখছেন তাঁকে। সুচরিতকে জিজ্ঞেস করতে নির্লিপ্ত জবাব এল, যত সব অদ্ভুত প্রশ্ন! বাজারের ব্যাগ কেন হাতে কী করে বলব? হয়তো এই হোটেলে আমাদেরই মতো উঠেছেন। কিন্তু তাতে সবজিবোঝাই ব্যাগ কেন হাতে থাকবে? অন্য কারণ নিশ্চয়ই আছে। আছে হয়তো। কিন্তু সেসব নিয়ে তুমি কেন মাথা ঘামাচ্ছ বহ্নি? এখানে ঘুরতে এসেছ, ঘুরে ঘুরে দেখো সব! কিন্তু বহ্নির ঘুরে দেখার বিষয়বস্তু তো শুধু আকাশ সাগর আর ভৌগোলিক পরিসীমার বিভিন্ন ঐতিহাসিক জায়গাই নয়। বিশ্বের প্রত্যেক সৃষ্টি কণায় অনুভূতির পরশ দিয়ে যে জানাশোনার পরিচয়, তার গভীরে ডুব দিতেই সে বেশি আগ্রহী মনে মনে। মনে মনে তাই বলল, আবার যদি স্বর্ণকেশীর দেখা পাই...।

বালুর বিছানায় পা দিয়ে খানিকটা এগোতেই দেখা গেল চারটি কিশোর তিন পাশ খোলা একটি জীর্ণ কুটিরে বেঞ্চির ওপর বসে রয়েছে। সম্ভবত এককালে কুটিরটি সমুদ্রগামী জেলেদের রাত্রিবাসের আশ্রয় ছিল। পরিত্যক্ত হওয়ায় এখন জীর্ণদশা। উন্মত্ত হাওয়ায় তার পলিথিনের আচ্ছাদন ছিঁড়েখুঁড়ে উড়ে যাচ্ছিল আকাশের দিকে। ওদের দূর থেকে দেখতে পেয়ে প্রায় একসঙ্গে ছুটে এল কিশোরগুলো। তাদের কারোর হাতে ছোট টিনের বাক্স। কারোর কাঁধে রংচটা ব্যাগ। এসেই একজন ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, ম্যাডাম, ভালো ডায়মন্ড আছে, নেবেন? এদের কাছে ডায়মন্ড? শুনেই ধন্দ লাগল বহ্নির মনে। জিজ্ঞেস করল, সত্যিই ডায়মন্ড? হ্যাঁ ম্যাডাম। খুব ভালো কোয়ালিটির। আর খুব সস্তাও। মাত্র ১০ হাজার রুপি দিলে দুটো পেয়ে যাবেন। বলেই স্ফটিক স্বচ্ছ সাদা বেদানার দানার মতো দুটি উজ্জ্বল দ্যুতি হীরকখণ্ড দেখাল সে। এত সস্তায় হিরে? বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। বহ্নি বলল, না রে এসবে আমাদের দরকার নেই। বালকের মুখের রেখায় মিনতি ঝরে পড়ল, প্লিজ ম্যাডাম নিন। এত সস্তায় অন্য কোথাও পাবেন না। ইয়ার রিং বানিয়ে পরবেন, খুব ভালো দেখাবে। সুচরিত হেসে বাংলায় মন্তব্য করল, বা, তৈলমর্দন করতেও শিখে গেছ দেখছি! ছেলেটির কচি মুখে সঙ্গে সঙ্গে হাসির ঝলক ঝিলিক মারল। একগাল হেসে বলল, স্যার, আমিও বাঙালি। কিন্তু সত্যি বলছি, সাচ্চা মাল। হ্যাঁ, সে তো বুঝতেই পারছি। তুমি একটি খাঁটি বিচ্ছু! এখানে থাকিস কোথায়? ওই ওদিকে। কিনুন না স্যার। একেবারে খনির মজুরদের কাছ থেকে ডিরেক্ট কিনে আনা। আচ্ছা এগুলো না নিলে অন্য কিছু নিন। রুবি, জেড, ক্যাটস আই...।

ওদের দেখে মন বড় কেমন করছিল বহ্নির। এতটুকু বয়সে কাঁধে সংসার নির্বাহের গুরুভার চেপেছে জেনে গলে যাচ্ছিল অন্তর। বলল, একটা ক্যাটস আই দে তাহলে। সেটা কিনে অন্যদের মুখে তাকাতেই দেখল, সেখানে অসহায় মিনতির আকুলতা গড়িয়ে পড়ছে বিগলিত হয়ে। সবচেয়ে ছোটটির মুখে নজর ফেলতে নিঃশব্দে একটি ঝিনুকের পুতুল সে–ও এগিয়ে ধরল। ওড়িয়া ছাড়া অন্য ভাষা এখনো রপ্ত হয়নি তার। সুচরিত হাসল, কী আর করবে নিয়ে নাও। তারপর অন্য দুজনের কাছ থেকেও সে কিনল বাঁকা হয়ে যাওয়া শামুকের মালা। বেঢপ সাইজের কাচের চুড়ি। কাটাচুলের মেমসাব পুতুল। মসৃণ নুড়িপাথর। সুচরিত জানতে চাইল, এসব কোনো কাজে লাগবে? বহ্নি হাসল, এসব কী আর কাজে লাগানোর জন্য?

হঠাৎ নিমেষের মধ্যে অনতিদূরে বড় একটা ভিড় জমে উঠল। কাছেই রাজস্থানী উট আর টাট্টু ঘোড়া দাঁড়িয়ে। দাম মিটতেই খুদে বিক্রেতারা দ্রুত ছুটল সেদিকে। একজনের কণ্ঠস্বরে উড়িয়া ভাষায় তখনই উল্লাসভরে উচ্চারিত হলো, এই চল! শিগগিরই চল! কালকের সাহাবরা আজও এসেছে। সুচরিত অর্থপূর্ণ দৃষ্টি ছুড়ে হাসল স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে, দেখলে তো? ওরাও তোমার চেয়ে স্মার্ট! হবেই তো। সংসারের জোয়াল কাঁধে চেপেছে যে। বলে বহ্নিও হাসল।

দূর থেকে চোখে পড়ছিল এক দঙ্গল শীর্ণ কুকুর মাটিতে গন্ধ শুঁকে বিরামহীন ঘুরছে। কখনো লাফিয়ে পড়ছে মাছের মতো। কখনো বালু খুঁড়ছে ধারালো নখের টানে। থেকে থেকে লড়াইও করছিল পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কাছে যেতে স্পষ্ট হলো কারণটা। জীবনমত্ত ঢেউয়ের তরঙ্গে হঠাৎ হঠাৎ উঠে আসছিল খুদে খুদে লাল কাঁকড়া। কুকুরগুলোর তারই জন্য অবিশ্রান্ত ছুটোছুটি। লড়াই করে কোলাহল। ভাগ-বাঁটোয়ারা হিসাব নিয়ে দ্বন্দ্ব বিবাদ। বহ্নির চোখে পড়ল বুভুক্ষু বাস্তবতা ওদের প্রত্যেকের দেহ জুড়ে যন্ত্রণার চিহ্ন রেখে গেছে। স্বামীকে বলল, আহা দেখেছ, একটা খুদে কাঁকড়া নিয়ে ওদের কেমন মারামারি! বোধ করি কেউ কখনো খেতে দেয়নি জীবনে। জন্ম থেকে এভাবেই চলছে খিদের দাপট। কাল সূর্যমন্দির থেকে ফেরার পথে শুকনা খাবার কিনে আনব। অন্তত দুটো দিন ওরা পেট পুরে খেতে পাক। আচ্ছা এনো। এখন সমুদ্রকে দেখো।

অফুরান সাগরের অফুরন্ত তেজের দিকে দৃষ্টি ছড়াল বহ্নি। কিন্তু কী করে দেখবে জীবনমত্ত সমুদ্রকে? সামনের আর্ত জীবের জীবনযন্ত্রণা তখন সাগরের ঢেউয়ের চেয়েও বেশি প্রমত্ত তার বুকের গহিনে। সাগর দেখে অনুভূতির জাগরণ তাই ঘটল না। তার বদলে মনে পড়ে গেল, স্যুটকেসে শুকনা খাবারের দুটি প্যাকেট পড়ে আছে। ছুটে গিয়ে সেগুলো নিয়ে এল সে। তারপর হরির লুটের মতো ছড়িয়ে দিল সাগর সৈকতের বালুভূমির ওপরে। মুহূর্তে বুভুক্ষুর উপবাস ভঙ্গের মহোৎসব শুরু হয়ে গেল। খাবারের গন্ধ পেয়ে দূর থেকে ছুটে এসেছিল দল ছাড়া এক কুকুর। রুদ্ররূপের ঝান্ডা তুলে মুহূর্তে প্রত্যেকেই ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। এদের মধ্যে কোমরভাঙা নেড়ি কুকুরও ছিল। সম্ভবত নৃশংস মানুষ তার কোমরসমেত পা দুটোকে ভেঙে দিয়েছিল একদিন। সামনের পায়ে ভর করে পুরো শরীরটা কোনোমতে টেনেহিঁচড়ে এতক্ষণ হেঁটে বেড়াচ্ছিল সে। বহ্নির অন্তর তারই জন্য ব্যথিত ছিল বেশি। কিন্তু এখন অপরিচিত জীবটির ওপর সে–ও অমিত বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভারী নৃশংস হতে চাইল। বহ্নির বড় বেদনায় মনে হলো, এটাই তো পশুর ধর্ম!

সুচরিত পেছন থেকে ব্যাকুলভাবে চেঁচিয়ে বলল, সরে এসো বহ্নি। কামড়ে দেবে! শিগগিরই সরে এসো। কিন্তু এই কুকুরটাকে ওরা মেরে ফেলবে যে। মারামারি ঠেকাতে হবে তো। তুমি খেপেছ? কুকুরের মারামারি মানুষ ঠেকাতে পারে? বহ্নি সরে এসে মনে মনে বলল, সত্যিই তো, যেখানে লাখ কৌশল দিয়েও সভ্য মানুষের সংঘর্ষ ঠেকিয়ে রাখা যায় না, সেখানে কুকুরের যুদ্ধ থামায় তার সাধ্য কী! ওদের সংস্কৃতিতে সভ্যতার ছোঁয়া তো লাগেনি আজও! (চলবে)

ধারাবাহিক এ ভ্রমণ কাহিনির আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন