কোনার্ক সূর্যমন্দির

সূর্যমন্দিরে শিল্পকর্ম
সূর্যমন্দিরে শিল্পকর্ম

সকালবেলায় ঘুম ভাঙল বৃষ্টির শব্দে। স্নান সেরে বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি শেষ না হতেই দরজায় কলিং বেলের শব্দ শোনা গেল। জলখাবার নিয়ে প্রবেশ করল চৈতন পট্টসানির বদলে এক তরুণ। সুচরিত নাম জিজ্ঞেস করতেই বলল, শম্ভু নায়েক। ছেলেটি রোগা। খুব লম্বাটে গড়ন। বড় দুটি চোখের ছায়ায় কৌতূহল ফেটে পড়ছে। খাবার নামিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করল, দুপুরে খাবেন তো? না। ফিরতে অনেক দেরি হবে। রাতে? আজ প্রভুজীর ‘একাদশীর পাবন’, মহারাজজী তাই জিজ্ঞেস করছিলেন। মহারাজজী? তাঁকে চেনেন না? ওই যে কাল দুপুরবেলায় যে খাবার খেলেন সে তো মহারাজজীই দিয়েছিলেন। ও, তাই বুঝি? ভারী চমৎকার ছিল। হবেই তো। প্রভুজীর প্রসাদ যে। তাহলে কী বলব? মহারাজজীকে আমাদের প্রণাম জানিয়ে বলো, রাতে প্রসাদ গ্রহণ করব।

নির্দিষ্ট সময়ে গেটে পৌঁছে দেখা গেল, ট্যাক্সি নিয়ে বুনু মোহান্তি আসেনি। সময় উড়ছিল। সুচরিত অধৈর্য হলো, দেখেছ বুনুর কাণ্ড? একে তো বৃষ্টি, তার ওপর লেট! হঠাৎ ভাঙা বাংলায় হাত নেড়ে কথা বলতে বলতে ট্যাক্সি থেকে নেমে বলরাম এগিয়ে এল। তার মাথায় প্লাস্টিকের আচ্ছাদন নয়। ঝকঝকে নতুন ছাতার আড়াল। সুচরিত খুশি হয়ে বলল, বুনু দামের কথা বলেছে বলরাম? কিসের দাম? এই ছাতার। বুনুই তো কিনে পাঠিয়েছে? আজ্ঞা, বুনুর ধার কী আমি ধারি? এই ছাতা আমার নিজের পয়সায় কেনা। আচ্ছা বেশ। দাম কত পড়ল? ওই আর কী স্যার। গরিবগুরবো মানুষ। বেশি দাম দিয়ে তো কেনার সাধ্য নেই। তা হোক। না জানালে দাম দেব কী করে? দাম আপনি দেবেন? হ্যাঁ। বুনুকে তো কাল বলেইছিলাম ছাতা কিনে দিতে। বুনুর প্রসঙ্গ আসায় বলরাম আবারও অপ্রসন্ন হলো, বুনু কী বলেছিল জানি না। তবে কালকের পরে আমাদের আর কথা হয়নি। বুনু মানুষটা সুবিধের নয়। শতপতি স্যার আমায় বলেছিলেন আপনাদের নিয়ে আসতে। অথচ ওর কাণ্ডটা দেখুন। শতপতি স্যার কিন্তু বুনুর কথাই আমাদের বলেছিলেন বলরাম। বলরাম এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় মন্তব্য না করে ট্যাক্সিতে উঠতে বলতেই সুচরিত উষ্ণ হলো, ছাতা ছাড়া কী করে উঠব? সান টেম্পলই বা দেখব কী করে? প্রশ্ন শুনে মুহূর্তের জন্য বলরাম আকাশের দিকে চঞ্চল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এক ঝলক কী দেখল কে জানে। পরক্ষণেই বলল, বৃষ্টি নিয়ে ভাববেন না। খানিকটা যেতেই দেখবেন, ঝলমলিয়ে রোদ উঠেছে। তাই বললে হয়? অনুমান করে কিছু বলা যায়? আজ্ঞে অনুমান নয়, অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা যে অন্য কথা বলছে। অসুবিধে নেই। দরকার হলে আমারটাই ব্যবহার করবেন। আমি তো ট্যাক্সিতেই থাকব। বলেই বলরাম নিজের ছাতাটি বাড়িয়ে ধরল।

হঠাৎ পেছন থেকে জোর গলার আওয়াজ শুনে কাঁধ ঘুরিয়ে তাকাল বহ্নি। শম্ভু দৌড়ে ছুটে আসছে ওদের দিকে। সেখান থেকেই চেঁচিয়ে উঁচু গলায় বলল, স্যার, দীনকৃষ্ণ স্যার ছাতাটা দিয়েছেন আপনাদের জন্য, বলেই উঁচু করে দেখাল সে। গভীর কৃতজ্ঞতায় নরম দৃষ্টিপাতে সুচরিত তাকাল বউয়ের মুখে, দেখেছ, কাল রাতে দীনকৃষ্ণকে যে বলেছিলাম বৃষ্টি ভিজলে খুব অসুবিধে হয়, দুটো ছাতা কেনা দরকার, সে কথা মনে রেখেই...বলতে বলতে শম্ভুর হাত থেকে ব্যগ্রভাবে ছাতাটা নিল সে। পরে হেসে বলল, ম্যানেজার বাবুকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এটা পেয়ে বড় উপকার হলো। কাল ট্যাক্সি ড্রাইভারকে কিনে আনতে বলেছিলাম, এখনো পৌঁছায়নি হাতে। জবাবে শম্ভু নিটোল হাসল, কেনার দরকার নেই স্যার। ফেরার পথে শুধু শুধু বোঝা বাড়িয়ে কী হবে? এখানে চাইলেই পেয়ে যাবেন। দীনকৃষ্ণ স্যার তো আপনাদের বাইরে আসতে দেখেই আমায় ডেকে বললেন, শম্ভু শিগগির যা, বাবুদের ছাতাটা দিয়ে আয়, নইলে বৃষ্টিতে খুব অসুবিধে হবে। এখন কোথায় যাচ্ছেন স্যার? সূর্যমন্দির দেখতে? হ্যাঁ। তুমিও যাবে? শম্ভু বিগলিত হাসল, না স্যার। ছুটি মিলবে না। কাল কোথাও যাবেন? হ্যাঁ, চিলিকা হ্রদে। জবাব শুনেই শম্ভু বাচ্চা ছেলের মতো আবেগে তালি বাজাল দুই হাতে, চিলিকা হ্রদ? ও দারুণ! দেখি দীনকৃষ্ণ স্যারকে বলে যদি ম্যানেজ করতে পারি, নিশ্চয়ই যাব। ওখানে খুব ভালো একটা রেস্টুরেন্ট আছে স্যার। ইয়া বড় বড় গলদা চিংড়ি খেতে দেয়। তুমি গলদা চিংড়ি খেতে খুব ভালোবাসো বুঝি? খুব স্যার।

বৃষ্টিভেজা নিরালা পথে ইতিহাস বিখ্যাত সূর্যমন্দিরের উদ্দেশে সাঁই সাঁই করে ছুটে চলেছে বলরামের মেরুনরঙা ট্যাক্সি। পথের দুই ধারে আশ্চর্য নির্জনতার নীরব সৌন্দর্যের অভিসার। যেদিকে চোখ যায় প্রকৃতির রূপের বিস্তার চারপাশের বনান্তভূমি ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিরামহীন সৌন্দর্যের তরঙ্গ হয়ে। দেখতে দেখতে বহ্নির মগ্ন চেতনা ছুঁয়ে মূর্ছনার ঢেউয়ে-ঢেউয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে আকাশের মেঘ অরণ্যের মধ্যে। সহসা কোনার্ক মেরিন হাইওয়ের অদূরে একটি রিসোর্টের দিকে ওদের দৃষ্টি আটকে গেল। নারকেল কুঞ্জের পরিবেষ্টনীর মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রশান্তির অমলিন মহিমা নিয়ে। যেন সবুজ চন্দ্রাতপের নিচে আধুনিক ভারতে জন্ম নিয়েছে প্রাচীন ঋষির আশ্রম। রিসোর্টের সামনে বিশাল গেটের ওপর সোনারঙের মেটাল হরফে বড় করে লেখা—‘তোশালি স্যান্ডস রিসোর্টস’।

সূর্যমন্দিরে শিল্পকর্ম
সূর্যমন্দিরে শিল্পকর্ম

বলরামের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই জানাল, ভেতরটা বহুত সুন্দর ম্যাডাম। নিরালা পার্ক, ওয়েডিং গ্যালারি, গলফ কোর্স, সুইমিং পুল, কনফারেন্স হল, মেডিকেল ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা, সব রয়েছে। তুমি বুঝি ভেতরে গিয়েছিলে? হ্যাঁ, সে তো কতবার! শতপতি স্যারের কাছে ফরেনাররা এলে এই রিসোর্টেই তাঁরা থাকেন। আর সাহেবরা এলেই আমার ডাক পড়ে। ফরেনারদের জন্য শতপতি স্যার অন্যদের ভরসা পান না কিনা, তাই। আচ্ছা! তার মানে খুব ভালো সার্ভিস দাও? নিজের কথা কী আর বলব ম্যাডাম। এই রিসোর্ট ফরেনারদের খুব পছন্দের জায়গা। কত রকমের গাছ। সুন্দর সুন্দর কটেজ। খুব লাকজারিয়াস। বলেই কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে খুশি গলায় বলল, একদিন তো এক সাহেব ছাড়তেই চান না। সেদিন সঙ্গে বসিয়ে খুব খাইয়েছিলেন। কী খেলে? চায়নিজ। আমাকে এত পছন্দ হয়েছিল যে যত দিন ছিলেন আমার গাড়িতেই আসা–যাওয়া করতেন। বুনুকে একদমই পছন্দ ছিল না। ওর তো আদপকায়দা জানা নেই!

বলরামের অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন করতেই হয়। কিছু সময় পরে চারপাশের সবুজ শামিয়ানা হালকা হতে দেখা দিল মেঘ ভাঙা সূর্যের দ্যুতিময় মূর্তি। বলরাম নিজের মহিমাকীর্তনে ব্যস্ত হয়ে উঠল ফের, ওই দেখুন স্যার, বৃষ্টি আর নেই। মেঘ কেটে রোদ উঠেছে! তোমার অভিজ্ঞতা তাহলে ঠিকই বলেছিল। কেন বলবে না? আকাশের চেহারা দেখেই যে বলে দিতে পারি সব। তবু ছাতা সঙ্গে এনে ভালো করেছেন। এখানকার মেঘ বড় খেয়ালি! থেকে থেকেই মুডি হয়ে ওঠে।

ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই ওরা পৌঁছে গেল প্রাচীন কলিঙ্গের কোনার্ক সমুদ্রতীরে। দূর থেকে চোখে পড়ল দুরন্ত বঙ্গোপসাগর উদ্ধত গৌরবে উত্তাল ঢেউয়ের সিঁড়ি হয়ে বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সৈকতভূমির শরীর ছুঁয়ে। তারপর বিষধর ফণিনীর মতো মাথা নুইয়ে পরক্ষণেই মিলিয়ে যাচ্ছে তরঙ্গভঙ্গ জলরাশিতে। মন্দির চত্বরে ওদের উপস্থিতি দেখে অন্য পাশ থেকে ছুটে এলেন গাইড অনন্ত রাঠ। স্মিত হেসে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, বৃষ্টিটা বন্ধ হয়েছে! আসুন বাইরে থেকে শুরু করি। কয়েক পা অগ্রসর হয়ে সুচরিত হঠাৎ মন্তব্য করল, চারপাশের অনেক ভাস্কর্যই তো ভাঙা দেখছি। ঘোড়াগুলোরও মাথা কাটা। হ্যাঁ, পনেরো থেকে সতেরো শতকের মধ্যে সুলতানদের আমলে অনেকবার ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছে জগন্নাথ মন্দিরসহ ওডিশার বিভিন্ন দেবালয়। লুটপাট করা হয়েছে যথেচ্ছভাবে। রিপেয়ার করা হয়নি কেন? প্রশ্ন শুনে রাঠ হাসলেন, সেটা অত সোজা নয়। এই মন্দির ম্যাসিভ পাথরে তৈরি। দেয়ালের গাঁথুনি পঁচিশ ইঞ্চি পুরু। এ ছাড়া অন্য কারণও রয়েছে। তবে ভালো খবর হলো, ১৯৮৪–তে ইউনেসকো একে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ মনুমেন্ট হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। বলেই খানিকটা সামনে এগিয়ে সবুজ ঘাসের মিহি চাদরে পা রেখে বললেন, প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে সোমনাথ মন্দিরের মতো কলিঙ্গের সূর্যমন্দিরও বহুবার ভাঙাগড়া হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণপুত্র শাম্ব কুষ্ঠরোগ থেকে মুক্ত হয়ে প্রথম এখানে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তখন পবিত্র চন্দ্রভাগা নদী ছিল ওখানে। বলেই সামনের প্রসারিত জায়গার দিকে আঙুল দিয়ে দেখালেন। খানিকটা থেমে পরে বললেন, সব শেষে ১২৪৩ থেকে ১২৫৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মন্দির নির্মাণ করেন গঙ্গা বংশীয় রাজা নরসিংহ দেব। এ জন্য তিনি বারো হাজার শ্রমশিল্পী নিয়োগ দিয়েছিলেন।

গাইড অনন্ত রাঠ বয়সে অনেক প্রবীণ ও মেধাবী। ইংরেজি, বাংলা, হিন্দি, ওড়িয়া ছাড়াও তিন চারটি ভাষায় অনর্গল সুচারু ব্যাখ্যায় দর্শকের মনোরঞ্জনে অভ্যস্ত। কিন্তু বহ্নি তখন রোমান্সের ডানায় অতীতের দিকে উড়ছে। যে অতীত মহাকালের গহ্বরে রহস্যের জালে বন্দী হয়ে আকর্ষণ করে তাঁকে। শাম্বপুরাণের কল্পকাহিনি ছেলেবেলায় সে শুনেছিল। সেখানে প্রজাবৎসল কলিঙ্গরাজ ইন্দ্রদ্যুন্মের বিশাল রাজ্যপাটের বর্ণনার পাশাপাশি সমস্যাজর্জরিত শ্রীকৃষ্ণপুত্র শাম্বের করুণ পরিণতির কথা রয়েছে। পিতার অভিশাপে সুন্দর তনু রাজপুত্র কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে পরিত্যক্ত হয়েছেন পরিবার ও সমাজ থেকে। নিজের চরিত্র স্খলন করে শাম্ব ক্ষমাহীন অপরাধ করেছেন। আদর্শবান যদুপতি পুত্রস্নেহেও তাই আদর্শের বিচ্যুতি সহ্য করতে রাজি নন। মহাঋষি কটকের নির্দেশে রোগমুক্তির আশায় চন্দ্রভাগার জলে স্নান সেরে রোজ তাই সূর্যের উপাসনায় কঠোর তপস্যায় নিমগ্ন হয়েছেন শাম্ব। বহ্নির মুখে সেই প্রসঙ্গ উচ্চারিত হতেই রাঠ বললেন, রাজপুত্র সেই সূর্যের তপস্যায় নিমগ্ন হতেন, যাঁর পরশ ধরণিকে প্রতিদিন পরিশুদ্ধ করে ভালোবাসায়। জীবন জাগরণ ঘটায় তাঁর অমিত কিরণ স্পর্শে। চন্দ্রভাগা কবে মরেছে কারওর জানা নেই। তবে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতি বছর মহাধুমধামে এখনও ‘চন্দ্রভাগা ফেস্টিভ্যাল’ উদ্‌যাপিত হয়। ভেতরে প্রবেশ করতে গিয়ে মন্দিরের সিঁড়িতে পা রেখেই সুচরিতের মুখে তাকালেন পণ্ডিত রাঠ, সাবধানে পা রাখবেন। সিঁড়িগুলো খুব খাড়া। খুব ম্যাসিভ মনে হচ্ছে। বা, হবে না। স্টোনের তৈরি যে। সাহেব ট্যুরিস্টদের অনেকেই তাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, প্রাচীনকালে কী করে এত ভারী পাথর অত উঁচুতে তোলা হয়েছিল? আর কী করেই বা সাজানো হয়েছিল স্তরে স্তরে? খুব যৌক্তিক প্রশ্ন। কী করে হয়েছিল? সুচরিত থমকে দাঁড়াল। সঠিক উত্তর কারওরই জানা নেই। গবেষকদের বিভিন্ন অনুমান রয়েছে। কেউ বলছেন, বিশেষ ধরনের দড়ি ব্যবহার করে ম্যানপাওয়ারই এই অসাধ্যসাধন করেছে। কারওর মতে বিশেষ ধরনের ল্যাডার ব্যবহার করা হয়েছিল।

অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে ওপরে এসে সামনে তাকাতেই চোখে পড়ল, অদূরে উদ্দাম সাগরের জীবনানুভূতি উচ্ছ্বাসের উচ্ছলতায় অহংকারে বিকশিত। মহা আলোড়নের সমারোহে চারপাশে তার আহ্বান ফেটে পড়ছে। ডান পাশে দৃষ্টি ছুঁতেই নজরে এল সিংহদুয়ারে দুটি স্তম্ভের ওপরে অসাধারণ দুটি সিংহের মূর্তি। সহস্র শতাব্দী পেরিয়েও তারা জীবন চাঞ্চল্যে বেগময়। শরীরী ভঙ্গিতে বাঙ্‌ময় হতে চাইছে চেতনার বিচ্ছুরণে। ভেতরে বিশাল আকারের সৌর সূর্য দাঁড়িয়ে। সমর্থ হাতে ধরে রেখেছেন সৃষ্টির লীলা পদ্ম। এই শিল্প কেবল যে নির্মাণকৌশলে স্থাপত্য সৌন্দর্যকে গর্জিয়াসলি প্রতিষ্ঠিত করেছে তাই নয়। তাঁদের ইঞ্জিনিয়ারিং দক্ষতাও যে একান্তভাবে নিখুঁত ছিল সেটাও প্রত্যক্ষ করে তুলেছে অনায়াসে। দেখতে দেখতে মোহিত হয়ে গেল বহ্নি আর সুচরিত। বহু শতাব্দী আগে সুচিন্তিত জীবনদর্শনকে সূক্ষ্ম কারুকার্যের দক্ষতায় পাথরের কাঠিন্য কেটে মূর্তির দেহে, মন্দির গাত্রে যাঁরা মুখর করতে পেরেছেন, তাঁদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং পরিশ্রম করার প্রতিজ্ঞার কথা মনে করে শ্রদ্ধায় কৃতজ্ঞতায় নত হয়ে গেল ওদের মাথা।

সূর্যমন্দিরে শিল্পকর্ম
সূর্যমন্দিরে শিল্পকর্ম

অনন্ত রাঠ আবার মুখ খুলেছেন, সূর্যমন্দিরের ইতিহাস বড় প্রাচীন। রামায়ণের রামচন্দ্রকে অগস্ত্য মুনি সূর্যের তপস্যায় দীক্ষা দিয়েছিলেন। অ্যাস্ট্রোলজার ও অ্যাস্ট্রোনমার বরাহ পণ্ডিত সৌর সূর্য নিয়ে আদ্যন্ত গবেষণা চালিয়েছেন। বিশ্বসৃষ্টির মূল কারণ ও নিয়ন্ত্রক হিসেবে সূর্যের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, পারস্যবাসীরাও সেটা জানতেন। তারাও সৌর সূর্যের উপাসক। গ্রিক অ্যাডমিরাল স্কাইল্যাক্স, চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙের লেখায় মূলস্থানের সূর্যমন্দিরেরও বিস্তৃত ইতিহাস রয়েছে। মূলস্থান? সেটা কোথায়? বহ্নির দুই চোখে প্রশ্নের উল্লাস। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের মুলতানই হলো মূলস্থান। প্রাচীন নাম কাশ্যপপুর। পরক্ষণেই দুদিকে মাথা দুলিয়ে প্রবীণ গাইড নিরানন্দ হাসলেন, মুলতানে মন্দির ছিল। এখন নেই। সেই তীর্থস্থান প্রথম ধ্বংস করেন লুটতরাজ করেন ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দে মুহম্মদ বিন কাশিম। কয়েক শ বছর পরে গজনীর সুলতান মাহমুদ বাকি ধনরত্ন লুণ্ঠন করে একেবারেই সেটা গুঁড়িয়ে দেন। এবার বাঁ পাশে চলুন। আর ডান দিকে যাওয়া নিরাপদ নয়। এখানে বালুর এত স্তূপ কেন? মন্দিরের ভারসাম্য রক্ষার জন্য আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে গ্রুপ বালু ঢেলেছেন ১৯০১ থেকে ১৯০৪ সাল পর্যন্ত। বারবার আক্রমণের আঘাতে, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে মন্দিরের অনেকটাই ধসে গিয়েছিল। কয়েক শ বছর ধরে সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি পরাধীন ভারতবর্ষে। ব্রিটিশ পিরিয়ডে প্রথম রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শুরু হয়। দেয়াল ফুটো করে ফানেল বসিয়ে তার ভেতর দিয়ে বালু ঢেলে মন্দিরকে খাড়া রাখার চেষ্টা চলে। এখন বছরে দুবার করে জরিপের কাজ চলে। তবে পর্তুগিজ নাবিকেরা মন্দিরের বিরাট ক্ষতি করে গেছে। সুচরিত নামার জন্য সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়েছিল। কৌতূহলে জিজ্ঞেস করল, কিসের ক্ষতি? সূর্য মূর্তি যাতে কোনো সাপোর্ট ছাড়াই শূন্যে ভেসে থাকে তার জন্য ওপরে, দেয়ালে এবং নিচে ৫২ টন ম্যাগনেট বসানো ছিল। কিন্তু এতে সাগরে দিক নির্ণয় করতে অসুবিধা হয় এই অজুহাতে সেগুলো ওরা খুলে নিয়ে গেছে। সেই যুগে এমন নির্মাণকাজও সম্ভব হয়েছিল? নিশ্চয়ই! চলুন বাইরে গিয়ে আরও কিছু দেখাচ্ছি আপনাদের। দেখবেন, সেই যুগে পৃথিবীর আর কোথাও এমন ম্যথমেটিক্যাল মনুমেন্ট তৈরি করার কল্পনাও কত দুঃসাধ্য ছিল।

খোলা সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে আসতে চোখে পড়ছে আকাশজুড়ে মেঘ রোদ্দুরের খেলা শুরু হয়েছে ফের। সেই সঙ্গে উদ্দাম হাওয়া আলুলায়িত ভঙ্গিতে ছড়িয়ে ছাপিয়ে মহাকৌতুকে ফেটে পড়ছে উন্মুক্ত চরাচর ঘিরে। বাইরে এসে শিল্পকর্ম খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে ওরা উপলব্ধি করল, এই মন্দির শুধু ধর্মীয় উদ্দেশ্য নিয়েই নির্মিত হয়নি। সমাজ-সংস্কৃতি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, ধর্ম-দর্শন, স্থাপত্য-ভাস্কর্যের বিরল সম্মিলন ঘটেছে এখানে। ইউনেসকো একে তাই ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের মর্যাদা দিয়েছে। শিল্পসৌকর্য ও বিশ্বজনীনতার গভীরতায় অনবদ্য এর উপস্থাপনা। রবীন্দ্রনাথ কি সেই কারণেই বলেছিলেন গভীরতম শ্রদ্ধায়—Here the language of stone surpasses the language of man?

সূর্যমন্দির একটি চলন্ত রথের ওপরে চলমান জীবনের প্রতীক হিসেবে নির্মিত। যে রথ সপ্ত ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে চব্বিশটি চাকায় ভর করে অবিশ্রান্ত এগিয়ে চলেছে যুগ থেকে যুগান্তরে। পেরিয়ে চলেছে কাল থেকে কালান্তর। এই রথ চলিষ্ণু সূর্যের অসীমকালের প্রতিভূ। বিশ্ব জীবন আর বিশ্বসৃষ্টির একত্রিত ইতিহাসের কথা বলছে। যারা একই সত্তা থেকে উত্থিত হয়ে সমান্তরাল এগিয়ে চলেছে মহামিলনের পথে।

তোশালি স্যান্ডস রিসোর্টস
তোশালি স্যান্ডস রিসোর্টস

ধর্মের অধ্যাত্ম দিক ও পার্থিব জগৎ দুইই এখানে স্থান পেয়েছে সমান মর্যাদায়। চলন্ত রথের দেয়ালজুড়ে যেমন নির্মিত হয়েছে অনিন্দ্যকান্তি দেবদেবীর স্বর্গীয় মূর্তি, মিউজিশিয়ান, নৃত্যরত নট ও নটি, তেমনি লাস্য ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে রয়েছে মানব–মানবীর মিথুন প্রতিচ্ছবিও। একই সঙ্গে যুদ্ধরত অকুতোভয় সৈনিক, আনন্দিত আবালবৃদ্ধবনিতা, অরণ্য প্রকৃতির জীবজন্তু। এরা প্রত্যেকে নির্দিষ্ট জ্যামিতিক ডিজাইনের মধ্যে বন্দী থেকে এক অসাধারণ শোভাযাত্রায় অন্তহীন কাল ধরে এগিয়ে চলেছে সেই অসীমের দিকে, যার থেকে জগৎ সৃষ্টি। বিজ্ঞান বলছে, সূর্য সৃষ্টির নিয়ন্ত্রক। তারই উত্তাপে জগৎ প্রাণময়। সূর্য তাই ভারতবর্ষের মননশীলদের চোখে অগ্নিময় জড়বস্তু নয়, ধরা দিয়েছে শক্তিধর বিশ্ব নিয়ন্তা হিসেবে। যার হাতে সৃষ্টির চলন্ত রথ অনাদিকাল ধরে নিয়ন্ত্রিত। অনেক মন্দিরের মতো সূর্যমন্দিরেও রয়েছে গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতিফলন। মানবসভ্যতা, সমাজ, দর্শন, ধর্ম, বিজ্ঞান, রাজনীতি এবং সংস্কৃতির সার্বিক চেতনার সম্পূর্ণ সম্মিলনেই সম্পূর্ণ হয়েছে এই মন্দির।

চলে আসার আগে অনন্ত রাঠ হঠাৎ গাম্ভীর্যের আচ্ছাদন নিয়ে বললেন, অনেক ট্যুরিস্টই জিজ্ঞেস করেন, পবিত্র মন্দির গাত্রে এসব ইরোটিক পিকচার কেন রয়েছে? তাদের বলি, যেখানে সৃষ্টির কথা বলছি সেখানে সৃষ্টির কারণ সম্পর্কে বলব না তাই কখনো হয়? ভারতবর্ষের চিন্তাশীল মানুষ জীবনের কোনো বিষয়কেই অপবিত্র বলে ভাবেন না।

শুনতে শুনতে ওদের মনে হলো, শিল্পকর্ম যদি কোনো মানুষের মনে অপবিত্রতার অনুভব বয়ে আনে, তাহলে বিশ্বজনীন এই অসাধারণ সৃষ্টিকর্ম দর্শন করায় তাদের কোনো অধিকার নেই, এমন ইঙ্গিতই হয়তো দিতে চাইছেন পণ্ডিত শ্রীঅনন্ত রাঠ। (চলবে)

ধারাবাহিক এ ভ্রমণ কাহিনির আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন