থমকে যাওয়া জীবন, মৃত্যুর আলিঙ্গনে-৪

মানুষ লাইন ধরে আছে। ছবি: লেখক
মানুষ লাইন ধরে আছে। ছবি: লেখক

আমরা যখন দোকানে ঢুকলাম, তখন মধ্যান্হ। ভর দুপুরে লোকজন অফিস-আদালতে থাকে। কিন্তু এখন সময়টা অন্যরকম। পৃথিবী থমকে যাচ্ছে। বড় বড় কেনাকাটার ট্রলি ( shopping acrt) নিয়ে লোক সমাগম বেশি দোকানে। বেশিরভাগই অভিবাসী। ভাবছিলাম, ঘটনা কি কানাডিয়ানরা কি বাজার ঘাট সব শেষ করে ফেলেছে?

হোলসেল (whole sale) এখানকার বড় চেইন ষ্টোর, গ্রোসারী ( মুদি) দোকান । একটু দাম কম, কিন্তু কিনতে হয় পরিমানে অনেক।যাদের বেশী বাজার লাগে, তারাই মূলত এখানে বাজার করেন। সে কারনে অন্য গ্রোসারী দোকানের চেয়ে ভিড় কম। কিন্তু আজ যেন অন্য রকম চিত্র। মানুষের ভিড়, গায়ে গায়ে ধাক্কা লাগার যোগাড়। গায়ে গা লাগিয়ে সবাই ছুটোছুটি করছে। সবার ট্রলি উপচে পড়ছে। বাজারে হাত ধোয়ার তরল সাবান নেই, টয়লেট পেপার নেই, টিনে রাখা মাছ, ডালের খাবারের ক্যানগুলোও। মূলত যা ঘরে মজুদ করে রাখা যাবে সেসব খাবার কিছুই নেই। সেলফগুলো বেশিরভাগ খালি।

হঠাৎ ভীষন রকম উত্তেজনা কাজ করলো আমার ভেতরটায়। ছুটে গেলাম চাল রাখার সেলফে। পুরো তাক খালি, আমরা যে মোটা সিদ্ধ চালটা খাই, সেটি একটিও নেই। শুধু একদম উপরের তাকে লাল বাদামী হোল গ্রেইনের দুটো বস্তা পড়ে আছে পেছনে। আমি ঝাপিয়ে পড়লাম বস্তা দুটোর দিকে। কিন্তু সেগুলো এত দূরে আর উচুতে আমি কিছুতেই নাগাল পেলাম না। এজাজেরও কোনো দেখা নেই, সে কোথায় ঘুরছে কে জানে। আমি ভাতে বাঙালী। সারাদিনে একবার হলেও ভাত আমার চাই-ই চাই। না হলে মনে হয় কত বছর অভুক্ত আছি। ভীষন রাগ হচ্ছিল এজাজের উপর। সত্যি বলতে কি আমার রীতিমতো কান্না পাচ্ছিল। আমি নিচের তাকে পা রেখে উঠে আবার হাত বাড়ালাম। সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল এই বস্তা দুটো যদি না পাই, তাহলে ভাত না খেয়ে থাকতে হবে আমাকে দিনের পর দিন। ইস আমার হাত নাগাল পাচ্ছে না। আমি তবু চেষ্টা চালিয়ে গেলাম।

টিস্যু শেষ। তারই নোটিস টানানো হয়েছে। ছবি: লেখক
টিস্যু শেষ। তারই নোটিস টানানো হয়েছে। ছবি: লেখক

আবারও আরেকটু ঝুলে পড়ে হাত বাড়ালাম, তখন পেছন থেকে ভারী কন্ঠস্বর খুব চমৎকার করে ইংরেজীতে একজন বল উঠলেন, তোমার কি সাহায্য দরকার?

আমি নামতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম। আমাকে যত্ন করে কাধে ধরে নামিয়ে দিল। একটু অস্বস্তি নিয়ে তাকিয়ে দেখি লম্বা, ফর্সা দাড়িওয়ালা এক কানাডিয়ান।

আমি বললাম, হ্যা দেখো না, আমি নাগাল পাচ্ছি না। বিধস্ত কন্ঠে বললাম।

চিন্তা কর না,আমি দেখছি। সেও প্রথম তাকে পা দিয়ে হাত বাড়িয়ে চালের প্যাকেট তিনটা নিয়ে এল।

তিনটা বুঝি? তুমি একটা নাও, আমি বেশ আনন্দিত গলায় বললাম।

কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে সুপার সপে মানুষ। ছবি: লেখক
কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে সুপার সপে মানুষ। ছবি: লেখক

হাসলো, না আমি কদাচিৎ ভাত খাই। আবারও চমৎকার করে বললেন, ধন্যবাদ। আমি বুঝতে পারছি না লোকজন এতো ক্রেজি কেন? পাগলের মত সব কিনছে। দেশে ত যুদ্ধ লাগেনি।
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি হাসলাম, ঠিকই বলেছ। দেশে তো যুদ্ধ লাগেনি। তিনিও হেসে সামনে এগিয়ে গেলেন। মনে মনে হাসলাম, কথাটি মিথ্যা বলে নি। দেশে তো যুদ্ধ লাগেনি।

আমার হাসি থেমে গেল। এজাজ খালি ট্রলি হাতে এগিয়ে এল। বাজারের লিষ্টে যা ছিল, তার বেশীর ভাগই নাই দোকানে। সবগুলো সেলফই ফাকা ধু-ধু মাঠ। পচনশীল অর্থাৎ ফল, সবজী, দুধ ছাড়া আর তেমন কিছু নেই দোকানে। আমার ভিষন ভয় হতে লাগল। পিছনের শিরদাড়া দিয়ে যেন ঠান্ডা একটা সাপ উঠে এলো শরীরে। ভয়ংকর কোনো যুদ্ধের প্রস্ততি নিচ্ছে মানুষ? করোনা কি এটম বোমার চেয়েও ভয়াবহ? অদ্ভুত এক ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হতে হতে প্রায় অবশ হয়ে এল। এতোদিন, দোকান-পাটে আসিনি, বাইরেও যাইনি। কাজের জায়গায় আড্ডবাজীও কম হয়। আমি আসলে এতদিন তাহলে করোনাভাইরাস বিষয়ে অন্ধই ছিলাম?

বিরাট অনিশ্চয়তা আর শঙ্কা নিয়ে বাসায় ফিরছি। কয়েকটা চালের প্যাকেট, সবজি, দুধ আর ফলমুল গাড়ির এক কোনায় পড়ে আছে। আসলে বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে এই পৃথিবীতে। সামান্য একটা ভাইরাসকে মানুষ এতো ভয় পাচ্ছে? দোকানের খাবার, দাবার শেষ হয়ে যাচ্ছে। মানুষ কি ঘরে বসে থাকবে এখন?

পরদিন দুপুরে শাহীন ফোন দিল, আপা কসকো যাব যাবেন আপনি? সেদিনতো হোল সেলে কিছুই পান নাই।

ছোট বোন শীলা এবং তার স্বামী শাহীনের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
ছোট বোন শীলা এবং তার স্বামী শাহীনের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

বললাম যাব, নিয়ে যাও। হতাশা চেপে বসেছে আমার ভেতর। সত্যি যদি ইতালি আর স্পেনের মতো হয় কানাডার অবস্থা। কিংবা খাবার না পাওয়া যায়? আমার বাসায়তো এক সপ্তাহের খাবারও নাই। আমার মেয়েটার অভুক্ত মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠলো। ভীষন অস্থিরতা নিয়ে ওয়াকিং ক্লোজেটে কাপড় খুজতে লাগলাম। ক্লোজেট ভর্তি কাপড়, তাকে তাকে সাজানো, কিন্তু পরার মতো কোন কাপড়ই খুজে পাচ্ছিলাম না। অবশেষে আমি তৈরী হলাম। ভালো করে গলায় মাফলার জড়িয়ে, মাথায় টুপি পড়ে তৈরী হয়ে নিলাম।মাফলার পড়লে গলাটা গরম থাকে, তখন কাশি কম হয়। বাইরে বেরিয়ে তো আর কাশি দেওয়া যাবে না।

এজাজ ঘুমাচ্ছিল। আমি ওকে কিছু না বলেই চলে গেলাম। সে জানলেই বিরক্তি দেখাবে, গম্ভীর চেহারায় বলবে,
তোমার না শরীর খারাপ? তুমি বাজারে বাজারে ঘুরছো? বলছি না খাবার ষ্টক করবে না। কিছুই হবে না। এটা কানাডা। শাহীন লাল গাড়ি নিয়ে এসে বাসার সামনে দাড়াল, আমি আস্তে করে দরজা বন্ধ করে ওর পাশে গিয়ে বসলাম।

কসকো বড় ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর। এখানে ফার্নিচার থেকে সব কিছুই পাওয়া যায়। আমি এসেছি শেষ সময়ে। দু-সপ্তাহ ধরে লোকজন বাজার করছে। এখন একটু ভিড় কম। দেখা গেল লোকজনের ভিড় যেমন কম, তেমনি জিনিস পত্রের সেলফও তেমন খালি। তবে ভালোর মধ্যে এই, আজ ওদের টয়লেট পেপার আছে। তবে একটা করে কেনা যাবে। পুরো কানাডায় টয়লেট পেপার শেষ। দোকানগুলো হিমসিম খাচ্ছে টয়লেট পেপার সাপ্লাই দিতে। মানুষ নাকি প্রচন্ড হতাশা থেকে যেটি পচনশীল নয় এমন জিনিস ষ্টক করছে। খাবার কেনা শেষ, এখন তাই টয়লেট পেপার কিনছে শেষ মূহুর্তের কেনাকাটায়।

আমরা দুজন দুটো টয়লেট পেপার কিনে মনে হোল বিরাট হীরার একটি খন্ড পেয়েছি। আমার অবশ্য বাসায় আরেকটি আস্ত প্যাকেট আছে। আমি পাউরুটির তিনটার বড় প্যাকেট, লাল আটার রুটির তিন প্যাকেট আর ৬০টা ডিমের বড় বক্স কিনলাম। মনে মনে ভাবলাম, রোদেলা ডিম পছন্দ করে। যদি সত্যিই ইতালির মতো লকডাউন হয় ভাতের সাথে ডিমের তরকারি হলেও মেয়েটা, শর্করা আর প্রোটিন খেয়ে কিছুদিন থাকতে পারবে। ফ্রোজেন সবজিও শেষ হয়ে গেছে দোকানে। তবে টাটকা সবজি অবশ্য আছে। চা আমার খুব পছন্দ। সবচেয়ে বড় দু'প্যাকেট চা নিলাম। ভাতের মতো চাও না খেয়ে থাকতে পারি না আমি।

ভগ্ন হৃদয়ে ফিরে আসছি। আমার লিষ্টে যা আছে, তার অর্ধেকও আজও পেলাম না। ভীষন দুশ্চিন্তায় আর উত্তেজনায় আছে সবাই। বার বার মনে হচ্ছিল সবাইকে কি ভীষন ভীত আর অস্থির লাগছে। অথচ মানুষের কত জ্ঞান আর বুদ্ধি। সেই বুদ্ধিতে পৃথিবী জয় করে এখন মহাকাশে বসতি করার কথা ভাবছে। কিন্তু সামান্য ভাইরাসের ভয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক দেশের যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি নিচ্ছে। মানুষের এত ভয় পেলে চলে? নিজেকে নিজেই সান্ত্বনা দিলাম- এজাজের কথাই ঠিক, অযথাই মানুষ প্যানিক করছে। সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। অবশ্যই ঠিক হবে। মানুষের অসাধ্য আর কি আছে?

হয়তো আমার অলক্ষ্যে ভবিষৎ মুখ টিপে হাসছিলো, আমার বুদ্ধিহীনতায় তার করুনা হচ্ছিলো। সত্যি কথা বলতে কি, মানুষ অনেক শক্তিশালী নয়। তারও অনেক অক্ষমতা আছে, যা আমরা পৃথিবীর মানুষেরা ভুলে যাই। ভুলে যাই বলেই করোনারা আমাদের গিলে ফেলতে পারছে।

গাড়ি হাইওয়ে ধরে ছুটে চলছে। আমার শরীর এতক্ষনে টের পেল, আমার দুদিন ধরে জ্বর। জানিনা এটা কি সত্যিকারের জ্বর না করোনা জ্বর। কদিন ধরে কি সত্যি আর কি মিথ্যা কোনো কিছু বোঝা যাচ্ছে না।