কথোপকথন- সময় ২০৬০ সাল

-আচ্ছা তুমি তো ভাইরাল এপিডেমিওলজির ইতিহাস নিয়ে বিস্তর পড়ালেখা করেছ একসময়, তাই না?

-হ্যাঁ, করেছি বৈকি, কিন্তু কেন?
-আমাকে একটু বল তো ২০২০ সালে যে একটা ভাইরাল প্যান্ডেমিক সারা পৃথিবীর মানুষকে একযোগে নাকানিচুবানি খাইয়েছিল, ব্যাপরটা আসলে কী ঘটেছিল? শুনেছি, তখন নাকি মানুষ কিসব ফেসিয়াল মাস্ক ব্যবহার করত, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলত, একজন আরেকজনের সাথে হ্যান্ডশেক, কোলাকুলি এসব কিছুই করতে পারত না। করলে নাকি জরিমানাও হতো। আমার দাদুর কাছে শুনেছি, তারা একনাগাড়ে ছয় মাস বাসা থেকেই বের হয়নি, কারও সঙ্গে দেখা করেনি। ব্যাপারটা কি ফানি না? আসলে দেখো, এখন থেকে মাত্র ৪০ বছর আগে মানুষ কত বোকা ছিল।

-বোকা বলছো কেন? এখনো কি আমরা খুব বুদ্ধিমান হয়েছি?
-হয়েছি তো, অবশ্যই হয়েছি। তাই বলে একটা ভাইরাসের ইনফেকশন থেকে বাঁচার জন্য মানুষ এসব বোকামি করবে?

-দেখো সহজ ব্যাপারটা হলো মানুষ তখনো এই ‘ইনভিজিবল বডি শিল্ড’ বিষয়টি আবিষ্কার করেনি। এখন আমরা ইনভিজিবল বডি শিল্ড ব্যবহার করে ভাইরাসসহ সব রকমের অণুজীব এমনকি ন্যানো পার্টিকল থেকেও নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারছি, বলতে পারো মানুষ ভাইরাসের মতো একটা ক্ষতিকর জীবাণুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার একটি কৌশল আবিষ্কার করেছে মাত্র। তা–ও আমাদের এই ইনভিজিবল ফেস শিল্ড শুধু এয়ারবর্ন ডিজেসের বিরুদ্ধেই কার্যকর। এর মানে কি এই যে আমরা সবকিছুকে আবিষ্কার করতে পেরেছি? আমরা এতটা বুদ্ধিমান এখনো হইনি যে আমরা সব জানি। জানার অনেক বাকি। আবিষ্কারের অনেক কিছুই এখনো বাকি।

-কিন্তু দেখো তখন নাকি ক্যানসারেও অনেক মানুষ মারা যেত।
-হ্যাঁ, এটা বলতেই পারো। গত ১০ বছরে সারা পৃথিবীতে ক্যানসারে কোনো মানুষ মারা যায়নি। কিন্তু এর মানে এই নয় যে মানুষ সব রোগব্যাধিকে জয় করেছে।
-এ কথা কেন বলছ?
-বারে, বলব না? মাত্র দুই বছর আগেই তো ঘটল ব্যাপারটা, মনে নেই?

-কোন ব্যাপারটার কথা বলছ? ও বুঝেছি, ২০৫৮ এর গ্লোবাল ট্রেড সামিটের (GTS-৫৮) সেই দুর্ঘটনার কথা বলছ? কী এক অজানা রোগে ২০০০০ মানুষ মারা গিয়েছিল। কি ভয়ংকর না?
-আহা ওটা দুর্ঘটনা নয়। ওটাও একটা ইনফেকশাস ডিজিজ। তবে ভাইরাল অথবা ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের মতো নয়।

নিউরোলজিক্যাল ইনফেকশন। আর ওটা শুধু গ্লোবাল ট্রেড সামিট এই ঘটেছে তা কিন্তু নয়। এর পরে ছোট–বড় আকারে আরও কয়েকবার ঘটেছে। মানুষ এই দুই বছরে বেড় করতেই পারলো না রোগটা আসলে কী, কীভাবে ঘটল? তার প্রতিকারই বা কি? এখনো একদল বোকা মানুষ বলে যাচ্ছে ওটা বেল'স পালসির অ্যাডভান্সড স্টেজ। কেউ কেউ বলছে অ্যাকিউট পেরিফেরাল ফেসিয়াল পালসি (APFP)। এই দুটি রোগ নিয়েই বহুযুগ ধরে অনেক গবেষণা হয়ে আসছে। আর এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে মারা যেতে পারে—এ রকম কোনো ইতিহাস জানা ছিল না। এটা ভাবারও অবকাশ নেই। এই দুটি রোগই নিউরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার। ওপরের যেকোনো একটা ডিজঅর্ডার হলে মানুষের মুখের আকৃতি হঠাৎ পরিবর্তিত হয়ে যায়। মুখের চামড়া কুঁচকে যায়। আক্রান্ত ব্যক্তি মুখের কোনো এক্সপ্রেশন দেখাতে পারে না, খাবার খাওয়া বা কোনো কিছুই পান করতে পারে না, মুখের মাংসপেশিগুলো কুঁচকে যায়, drooling হয়, তীব্র মাথাব্যথাসহ আরও নানান উপসর্গ দেখা যায়। বলতে পারো মানুষের মুখটাই প্যারালাইজেড হয়ে যায়। কিন্তু এই লক্ষণগুলোর অনেক ধরনের চিকিৎসা বহু বছর যাবৎই প্রচলিত আছে। গ্লোবাল ট্রেড সামিট–৫৮–এ যার ওই নতুন রোগের শিকার হয়েছিল, তাদের সবারই ওপরের লক্ষণগুলো ছিল। অতিরিক্ত যেটা হয়েছে আক্রান্ত সবাই মৃত্যুবরণ করেছে।

কিন্তু একটা বিষয় সত্যি আমাদের এতো এতো রকমের প্রটেকশন থাকার পরেও মানুষ কেন এবং কীভাবে ওই রোগে আক্রান্ত হতে যাবে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। আরও মজার বিষয় হলো, বেল'স পালসি বলো আর APFP যেটাই বল না কেন, এই রোগের যেসব জানা কারণগুলো রয়েছে, তার দ্বারা আমাদের পূর্বপুরুষেরা বিভিন্ন সময়ে আক্রান্ত হয়েছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, আমাদের কারও পূর্বপুরুষেরা যদি কখনো এমন কোনো রোগে ভুগে থাকেন, তবে আমাদেরও কোনোনা কোনো সময়ে ওই ফ্যাটাল APFP তে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

-বলো কি? তা সেই রোগগুলো কী কী?
-অনেক লম্বা লিস্ট। যেমন ধরো, চিকেন পক্স অথবা সিঙ্গেলস, সাইটোমেগালোভাইরাস, জার্মান মিজেলস, মাম্পস্, এপস্টেইন বার, হ্যান্ড ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজেস এবং এমনকি সাধারণ ফ্লুসহ আরও অনেক। এমনকি কোভিড-১৯–এর সারভাইভ,র যারা তাদেরও প্রজন্ম।
-কী ভয়ানক কথা। আমার হাত–পা কাঁপছে। দাঁড়াও, তুমি যেসব রোগের কথা বলছ, এর প্রায় সব কটি তো বিলুপ্ত। সব কটিরই ভ্যাকসিন আছে।
-ভ্যাকসিন তো শুরু হয়েছে কোনো নোটা হয়তো আজ থেকে এক শ বছর আগে। কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষেরা মানে কি শুধু ১০০ বছর? আমার দাদা, তার দাদা, তার দাদা।
-কি বলো? তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? তাহলে তো মনে হচ্ছে ব্যাপারটা অনেক সহজ। রোগটা জেনেটিক। হিউমান জেনেটিক্সের কোনো কিছুই তো আর আজকে অজানা নয়।

-সমস্যা ওখানেই। আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে এই রোগের কোড আমাদের শরীরে বহন করছি কিন্তু আমাদের ইনডিভিজুয়াল জেনোমিক অ্যানালাইসিস তাকে আইডেন্টিফাই করতে পারছে না। সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় হলো যখন অনেক বড় একটা জনসমাগম হচ্ছে, ঠিক সেখানেই মানুষের মধ্যে হঠাৎ করে এই রোগটি দেখা যাচ্ছে। অবশ্য ছোটখাটো জনসমাগমেও এটা দু–একবার হয়েছে। একজন আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার চারপাশে থাকা হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারে। তবে আবার সবাই কিন্তু আক্রান্ত হচ্ছে না। তার মানে কি? একজন আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা আরেকজন তখনই আক্রান্ত হবে, যদি তার শরীরেও সেই অজানা কোডটি থাকে।

-বলো কি? এটাকি তাহলে মলিকুলার সিগনালিং? মানুষে মানুষে মলিকুলার সিগনালিং এমন কথাতো শুনেছি বলে মনে পড়ে না। আচ্ছা বল তো তাহলে এই রোগ বিস্তারের মেকানিজমটা কি? রোগটা ইনিশিয়েট হচ্ছে কীভাবে? কোনো ইনফেকশন পিরিয়ড নেই? নিমেষেই মৃত্যু অবধারিত? আর তুমি যে কোডের কথা বলছ সেটা কী ধরনের কোড? জেনেটিক কোড তো নয় বুঝতে পারছি।

-আমরা জানি না, এখনো জানি না। তবে হয়তো খুব শিগগিরই জানতে পারব। আর হ্যাঁ, তুমি যেটা বললে, হিউমান তো হিউমান মলিকুলার সিগন্যালিং ব্যাপারটাকে বিজ্ঞানীরা উড়িয়ে দিচ্ছেন না।
-এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

-আপাতত জানা নেই। অপেক্ষা করতে হবে। তবে একবার ভেবে দেখো, তুমি যে কোভিড-১৯–এর কথা বলছিলে, ওরা তো তবু কিছুদিন সময় পেত, ওরা জেনেছিল কীভাবে এই সংক্রমণ থেকে বাঁচা যাবে। আমরা এরপর আরও সভ্যতার ৪০ বছর পার করার পরেও এখনো এমন একটা মারাত্মক রোগ সম্পর্কে বলতে গেলে এখনো কিছুই জানি না। শুধু জানি, এই রোগ হলে নিস্তার নেই। মৃত্যু অবধারিত।

- তুমি কি জানো এ কারণে তোমাকে আমি চিকিৎসাবিজ্ঞানবিষয়ক কোনো প্রশ্ন করতে চাই না। আমি যতটুকু জানতে চাই তুমি তার চেয়ে অনেক বেশি জানিয়ে দাও।
-আসলে কি জানো, আমি গত কদিন হলো এই বিষয়টা নিয়েই ভাবছিলাম। আমার ইন্টার্নি শেষ হলে আমি এই রোগটা নিয়েই গবেষণা করব। প্রফেসরের সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে।
-কি বলছ তুমি?

-হ্যাঁ ঠিকই বলেছি। তোমাকে শিগগিরই জানাতাম।
-চলো আমার মাথা ঘুরাচ্ছে। এসব ভালো লাগছে না। অন্য কিছু বলো।