সন্তান ৫

Untitled-3
Untitled-3

সকালের চা হাতে নিজের বাড়ির বারান্দায় বসেছেন আব্বাস আলী। সঙ্গে পরোটা আর ডিম ভাজাও আছে। সাধারণত বাবা-ছেলে একসঙ্গেই নাশতা করেন। তবে সেদিন নাজমুলকে কোথাও দেখতে না পেয়ে হাঁক দিলেন আব্বাস:
‘নাজমুল...ও নাজমুল আলী, কহনে গেলিরে ব্যাটা?’


অসভ্য নাজমুল আলী শুধু নিজের বাবার সঙ্গেই কিছুটা সভ্য। বাড়ির কোথাও থেকে সাড়া দিল সে, ‘জে, বাজান, আসতি ছি।’ 
‘একা একা খাতি তো ভালো লাগে নারে বাপ, আয়!’ 

বছর ত্রিশের নাজমুল এমনিতে বেশ সুপুরুষ, একটু পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন হলে বেশ লাগে। নতুন পাঞ্জাবি- লুঙ্গিতে বেশ দেখাচ্ছিল তাকে, সামান্য একটু আতরও মেখেছে। ঘন চুলগুলো পরিপাটি করে আঁচড়ানো। 
‘ওরে বাপ রে, আমার বাজানে রে তো সিনেমার হিরু লাগতেসে আইজ!’ আব্বাসের কণ্ঠ স্নেহাদ্র। 
একটু যেন ইতস্তত করছে নাজমুল আলী, ‘বাজান, আপনে কলি আইজ একবার আম্মার কবরে জাতাম...’ 
একমুহূর্তে হাসি হারিয়ে গেল আব্বাস আলীর চেহারা থেকে: 

‘অই ছেমড়া অই... আম্মা কারে কয়? হে? সোমত্ত ব্যাটা আর সোয়ামি রে ছাইরে যে রাইতের আন্ধারে পলায়, অই বেডি রে আম্মা কয়? হে?’
নাজমুল বুঝতে পারল, না চাইতেও বাবার দুর্বল জায়গায় আঘাত করে ফেলেছে সে: ‘বাজান, যে মানুষডা মইরে গ্যাসে, তারে...’
আব্বাস আলীর সঙ্গে সুখে ছিলেন না তার স্ত্রী। আব্বাস তখন এখনকার মতো এতটা বিত্তবান ছিলেন না। তার ওপর আব্বাস আলীর স্ত্রী ছিলেন চোখধাঁধানো সুন্দরী। অভাবের সংসারে যুদ্ধ করতে করতে ১২ বছরের নাজমুল আর আব্বাসকে ফেলে প্রতিবেশী

প্রেমিকের হাত ধরে সুখের খোঁজে বাড়ি ছেড়ে ছিলেন সেই সুন্দরী। তাই তখন থেকেই আব্বাস প্রচণ্ড মাত্রায় ঘৃণা করেন নারীদের, আর ভালোবাসেন শুধু টাকা কে।
তবে এমনিতে নাজমুল যেমনই হোক, সে ভুলতে পারেনি তার আম্মাকে। তাই এখনো মাঝেমধ্যে বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে মায়ের কবর জিয়ারতে যায় নাজমুল আলী, বাবা জানলে যেতে দেন না কিছুতেই। 
এখন এই অগ্নিশর্মা আব্বাস আলীকে শান্ত করতেই নাশতার সামনে বসল নাজমুল। পরোটার টুকরোয় ডিম ভাজা ভরে মুখে পুরে চিবুতে চিবুতে বলল, ‘আইজ মিডাই নাই ক্যারে?’ 
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন আব্বাস আলী, ‘আনোয়ারের মাইয়া ডারে কেমন লাগে রে তোর? নাজমুল?’

‘কি ডা? ওই কালী ডা? চালু মাল এক খান!’ জিনাতের কথা মনে হতেই চকচক করে ওঠে নাজমুলের চোখ। একটু থমকায় সে। ‘তয় বাজান, ওর লগে জামাইল্লার ওই মুটি ডা. এক্কেরে জোঁকের মতন লাইগে থাহে, নয় কালী ডারে এ টু চাইহে দেখতাম! একলা পাওয়া যায় না উ ডা রে...’ জিনাত প্রসঙ্গে বাবার সামনেও নাজমুলের মুখে কোনো লাগাম থাকে না। 
ছেলের কাঁধ ধরে ঝাঁকালেন আব্বাস আলী, ‘চল ব্যাটা এক জাগা যাই।’

প্রতিদিন সকাল আটটা সাড়ে আটটার দিকে জামাল উদ্দিনের বাড়ির পাশ দিয়ে যে কেউ গেলেই সুমধুর কোরআন পাঠের শব্দ শুনতে পায়, জিনাতের কণ্ঠ সবার চেনা। 
কোরআন পড়তে গিয়ে আজও থেকে থেকে আটকে যাচ্ছে ফাতেমা, ‘অই ছেমড়ি তুই এমন গড় গড়াইয়া পড়িস ক্যামনে? আমি তো এহন ও শব্দ কই শেষ হইল, আর ক্যামনে কী পড়া লাগে, তাই ঠিক পাই না!’
সইয়ের কথায় ওর হাতে মৃদু চাপ দেয় জিনাত, ‘ও পড়তি পড়তি ঠিক হইয়ে যাবে নে, তুই চিন্তা করিস না। তুই তো কলেজের বই পারলি মুখস্থ কইরে ফালাশ, ইডাও পারবি ইনশা আল্লা।’

আজ আমেনা বেগম খুকুকে নিয়ে ফাতুর বাড়ি এসেছেন, শরিফাকে ঢেঁকিতে ধান ভানতে সাহায্য করবেন বলে। সদরে যদিও চালকল আছে, তবু ঢেঁকিছাঁটা চাল পছন্দ সবার। শরিফা বানু ঢেঁকিতে পা চালাচ্ছেন, আর নিচে বসে আধা ছাঁটা চাল নেড়ে দিচ্ছেন আমেনা। দুই বড় বোন উঠানে মাদুরে বসে কোরআন পড়ছে, জিনাত পড়াচ্ছে ফাতেমাকে। কাছেই নীল কামিজ-পায়জামা পরা, রাবার ব্যান্ড দিয়ে ছোট্ট ছোট্ট দুই ঝুঁটি করা খুকু একটা নতুন কাপড়ের পুতুলে মগ্ন, ঘুম পাড়াচ্ছে পুতুলকে। জামাল-আনোয়ার চা খাচ্ছেন ঢেঁকিঘরের পাশে বসে, প্রয়োজনে সাহায্য করবেন স্ত্রীদের। 

জামাল উদ্দিন দূরে কিছু একটা দেখতে পেয়ে চেঁচালেন, ‘ও আম্মারা, তুরা ঘরের মদ্দি যা রে, মেম্বার আইতাসে, লগে নাজমুলও আসে।’ 
জামালের কণ্ঠস্বরে আমেনাও সচকিত হয়ে ওঠেন, ‘মেম্বার হারামজাদায় কি চায় জামাল ভাই ডি? লগে আবার ওই কুত্তার পোলাডা আইসে ক্যা?’
‘কী জানি রে বুন, দেহি কী কয়।’ 

খুকুর হাত ধরে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে জিনাত-ফাতেমা। পুতুলটাকে বুকে চেপে রেখেছে খুকু। 
ঘরে গিয়ে খুকুর দিকে হাত বাড়ায় ফাতেমা, ‘তুমার মাইয়ার নাম কী রাখস? বুজান?’ বাড়ানো হাতের ইঙ্গিত বুঝেই খুকু ততক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ফাতেমার বুকে, দুহাতে জড়িয়ে ধরেছে গলা। 
“ইডা? ওর নাম মিনু। মিনুরে ফাতু বু বানাই দে সে’ (খুকুর বয়স এখন প্রায় সাড়ে তিন, তার কথা আগের চেয়ে স্পষ্ট)। 
এদিকে জিনাত-ফাতেমার কানে তখন টুকরো টুকরো কথা ভেসে আসছে উঠান থেকে: 
‘কী কন মেম্বার সাব? বিয়া? তাও সেলিমের লগে?’ বিস্ময় ঝরে পড়ে আনোয়ার মিয়ার কণ্ঠে। 
‘না না, আমাগো জিনাতের এহনও ১৮ বছর বয়স হয় নাই, আর মাইয়া গো মেলা শখ উরা কলেজ পাস দিব, ও গে বিয়া এহন আমরা দিমু না!’ প্রায় আর্তনাদ করে ওঠেন শরিফা বানু। 
আব্বাস আলী নাছোড় বান্দা: ‘হয় নাই তো কী? হবি তো! কাজী সাবেরে টাকা দিলিই আঠারো লেইখে দিবেনে।’
‘আরে নাজমুল তো জিনাতের তে কত্ত বড়...বয়সডা দেখতি হবি না?’ ভদ্রভাবেই জামাল উদ্দিন মিষ্টি এগিয়ে দিলেন আব্বাস আলীর দিকে। 

ঘরের ভেতর জিনাতের চোখ তখন প্রায় ফেটে পড়ার অবস্থা: ‘আপনেরা কেউ মেম্বারের কথায় রাজি হইয়েন না গো, রাজি হইয়েন না...’ একমনে প্রায় জপছে সে। 
ফাতেমা বুঝেছে সইয়ের মনের অবস্থা, ‘আরে আরে ছেরি, খাড়া! ভাইঙ্গে পড়লি হবি না নে!’ জিনাতের পিঠে হাত রাখে ফাতেমা। 
খুকু ছোট্ট চিরুনি দিয়ে আঁচড়াচ্ছে তার মিনুর সুতোর চুল। এবার যেন ফুঁসে উঠল নাজমুল আলী: 
‘আ লো অই জামাইল্লা, জিনাতে তগো কী লাগে? তোর বউর অতো গা জ্বলে ক্যারে? ওই কালীরে বিয়া করব কীডা? শোকর কর বিয়া করতি চাই সি উ ডা রে...’ সজোরে মাটিতে পা ঠোকে নাজমুল। 
আব্বাস আলীও হার মানতে নারাজ: ‘বিটা মানষির আবার বয়স কিসির? আর শরিফা বানু, তুমার ফাতু সুন্দর হোলি কি হবি, তুমি জন্ম তো দিসও এটা বাঁজা হাতির বাচ্চারে! জিনাতের তো তাও শরিলি কিসু আসে, ফাতেমারে কোনো কালে বিয়া দিবার পারবা মনে করসও?’ দম নিলেন আব্বাস। ‘জামাল, তায় তোমার ডা ভাইডি ভাইডি কইরে ঘোরে ওই বেজন্মা আব্দুল করিমের লগে। কেমন যে ভাইডি, ও আমরা জানি...’
ঘরের ভেতর ওড়নার আড়ালে চোখের জল লুকায় ফাতেমা, ‘মানষি আমারে মুটি কয়, বাঁজা কয় সব মানি, তয় মেম্বারে এ কেমুন কতা কইল আব্বারে? আস্তাগফিরুল্লাহ!’ 

জিনাত বুকে জড়িয়ে ধরে ফাতেমাকে, ‘আল্লায় তোরে যা দেয় নাই, তা তো তোর দোষ না রে বুন ডি।’ 
খেলতে খেলতে আবার হাজির হয় খুকু, ‘ফাতু বু, আমার মিনুর চুল বাইন্ধে দাও, পারি না আমি।’
ফাতেমা জানে, বড় দুবোনের কারও চোখে পানি দেখলে হাজারটা প্রশ্ন করে খুকু, তাই বাধ্য হয়েই ঠোঁটে লম্বা হাসি টানে ফাতু, ‘দে, বুজান।’

ওদিকে এতক্ষণ আব্বাস-নাজমুলের সঙ্গে জিনাতের হয়েই লড়ছিলেন জামাল-শরিফা। তাই আনোয়ার-আমেনা মাঝ থেকে কোনো কথা বলেননি। তবে এবার আর সহ্য করতে পারলেন না আনোয়ার মিয়া:
‘মেম্বার সাব, এক্ষণ আমার বাড়ি ত্তে বাইর হন আপনের পোলা রে নিয়া! কালী হোক মুটি হোক ওই মাইয়া দুইডা আমাগে জন্নি জান্নাত, বুজসেন? ও গো বিয়া কহন দিমু আমরা বুঝুম! আর মাইয়া গো মত ছাড়া কিসসু হইব না!’
স্বামীর কথায় সায় দেন আমেনা ও, ‘সংসদে গিয়া কি গেরামের মাথা কিন্না নেসেন, মেম্বার সাব? যা কবেন তা ই হতি হবি নাকি? বাইরান বাড়ি ত্তে!’
নাজমুল সঙ্গে করে আনা মিষ্টির প্যাকেট তুলতে গেলে তার হাতে চড় মেরে সরালেন আমেনা, 

‘রাখ রাখ, বাজান! বাপে-পোলায় মিলা যে এত্ত ডি তিতা কথা কইলা, এই মিডাই তিশিডা রে মিডা কইরবেনে!’
‘কামডা ঠিক হইল না তমাগে!’ ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন আব্বাস আলী। 
দুই বান্ধবীর তখন মুখে হাসি, চোখে পানি। ‘মাবুদে আইজ বড় বাঁচা বাঁচাইসেন আমারে’ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে জিনাত। 
এদিকে মিষ্টির প্যাকেট দেখে খুকু মহা খুশি, ‘বু, মিডাই! দেহ, কত্ত মিডাই!’
খুকুকে সামনে রেখে একজন আরেজনকে ধরে ট্রেন হয়ে গেল তিনজনে। ‘চল খুকু আইজ রেল গাড়ি হইয়ে মিডাই খামু আমরা!’
খুশিতে খুকু মুখে কু ঝিক ঝিক শব্দ তুলে চলল মিষ্টি খেতে। আর রেলগাড়ির ছোট্ট ইঞ্জিনের পেছনে বড় দুজন তো আছেই।

* আব্বাস আলী আর নাজমুল আলী কি ছেড়ে দেবে ওদের? নাকি কোনো ভয়াবহ প্রতিশোধ অপেক্ষা করে আছে? মিনহাজ হোসেনের কি ভূমিকা এ গল্পে? চোখ রাখুন পরের পর্বে। চলবে...

আরও পড়ুন
সন্তান ৪